অস্তিত্ববাদ কি পুরোপুরি নিরীশ্বরবাদী? জ্যাঁ পল সার্ত্রে

২০ শতকের বিখ্যাত ফরাসি লেখক, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে বিখ্যাত হয়ে আছেন তার অস্তিত্ববাদ বিষয়ক দর্শনের জন্য। দর্শনের ইতিহাসে তার ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’ বইটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর একটি। আজ আমরা জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

অস্তিত্ববাদ কি পুরোপুরি নিরীশ্বরবাদী? জ্যাঁ পল সার্ত্রে
অস্তিত্ববাদ কি পুরোপুরি নিরীশ্বরবাদী? জ্যাঁ পল সার্ত্রে


Existentialism বা অস্তিত্ববাদে যাবার আগে ‘এসেনশিয়ালিজম’ সম্পর্কে জানতে হবে। এসেনশিয়ালিজম শব্দটির কাছাকাছি বাংলা অর্থ হতে পারে সারবাদ বা সারাংশবাদ। পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রতিটি জীব/জড়ের একটি নির্দিষ্ট পরিচয়, সত্ত্বা কিংবা নির্যাস রয়েছে যা তার অস্তিত্বের অর্থ বহন করে। এই ভাবনাকে বলা হয় এসেনশিয়ালিজম। 


একটি চাকুর হাতল কাঠের বা লোহার হতে পারে। কিন্তু কেবল হাতলের সাথে যদি কোনো ব্লেড না থাকে, তাহলে সেটিকে কেউ চাকু বলবে না। কারণ ব্লেড হচ্ছে চাকুর আসল পরিচয়। আবার মানুষ বুদ্ধি, বিবেক নিয়ে পৃথিবীতে আসে বলে সে মানুষ। বুদ্ধি না থাকলে দর্শনের ভাষায় বলায় যায় মানুষ হিসেবে তার ‘সত্তা’ নেই। আমরা সাধারণত বলে থাকি লোকটি অন্তঃসারশূন্য।


আড়াই হাজার বছর পূর্বে এসেনশিয়ালিজম নামক এই দার্শনিক মতবাদের প্রবর্তন করেন প্লেটো এবং তার শিষ্য অ্যারিস্টটল। এই তত্ত্ব বলে যে, প্রতিটি বস্তুকে নিজের অস্তিত্ব অর্থবহ করতে হলে কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য বহন করতে হয়। প্লেটোর মতে, মানুষের জীবনের অর্থ এই যে সে মানুষ। মানুষের মাঝে মানবীয় গুণাবলী তার অস্তিত্বকে সার্থক করে। সকল মানুষের মাঝেই সেসব গুণাবলী রয়েছে। যারা এসব গুণাবলীর সদ্যবহার করে, তাদের আমরা সৎ মানুষ বলি। বিপরীত দিকে রয়েছে অসৎ মানুষ।


২০ শতকে সুপ্রাচীন এসেনশিয়ালিজমের দিকে আঙ্গুল তোলেন জাঁ পল সার্ত্রে। তার মতে, আমাদের অস্তিত্ব আমাদের পরিচয়ের অগ্রবর্তী। অর্থাৎ, মানবীয় গুণাবলীর মতো উপাদানগুলোর পূর্বে আমাদের অস্তিত্ব জরুরি। অস্তিত্ব লাভ করে তবেই আমরা নিজেদের জীবনের অর্থ খুঁজি। তার এই ভাবনাই Existentialism বা অস্তিত্ববাদ নামক দর্শনের নতুন ধারার কাঠামো তৈরি করে।


সার্ত্রের এ ভাবনা খুব সহজ মনে হলেও সে সময় তা ছিল বৈপ্লবিক। কারণ, এসেনশিয়ালিজমে বিশ্বাসী মানুষ বিশ্বাস করতো তারা নিজেদের পরিচয় নিজেরা সৃষ্টি করে না, বরং সৃষ্টিকর্তা সব ঠিক করে দেন। কিন্তু অস্তিত্ববাদ মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়। এই কথায় অনেকেই ভাববে যে, অস্তিত্ববাদ পুরোপুরি নিরীশ্বরবাদী।


এই সমস্যার উত্তর জানতে হলে আমাদের জানতে হবে পরমকারণবাদ সম্পর্কে। মানুষের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে পরমকারণবাদের বক্তব্য অনেকটা এরকম, “সৃষ্টিকর্তা কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখেই পৃথিবী এবং মানুষ সৃষ্টি করেছেন।”


কিন্তু অস্তিত্ববাদ সরাসরি পরমকারণবাদকে অস্বীকার করে। অস্তিত্ববাদের দাবি হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী এবং মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে সৃষ্টি করেননি। অর্থাৎ, অস্তিত্ববাদ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে না। 


কিন্তু আপনি যখনই পরমকারণবাদ অস্বীকার করবেন, তখনই পৃথিবীতে আপনার যাবতীয় কর্মকাণ্ড এমনকি অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে পড়বে। সহজ ভাষায় বললে, সৃষ্টিকর্তা যদি মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে না রেখে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে পৃথিবীতে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী? 


নির্দিষ্ট সময়কাল পর প্রতিটি মানুষই মৃত্যবরণ করে। সেক্ষেত্রে পরমকারণবাদ অস্বীকার করা মানে মৃত্যুপরবর্তী সৃষ্টিকর্তার কোনোরূপ জবাবদিহিতায় বিশ্বাস না করা। আর যদি ব্যাপারটা এরূপই হয়ে থাকে তাহলে পৃথিবীতে সততা আর ন্যায়ের মতো ব্যাপারগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।


এরকম একটি পরিস্থিতিতে তৈরি হয় নতুন এক সমস্যা, যার নাম ‘অ্যাবসারডিটি’ বা অর্থহীনতা। দর্শনের দৃষ্টিতে এই অর্থহীনতার অর্থ প্রচলিত অর্থের মতো নয়। অর্থহীনতা হচ্ছে অর্থহীন পৃথিবীতে নিরন্তর অর্থ খোঁজা অর্থাৎ নিরুত্তর পৃথিবীতে প্রাণপণে উত্তর খোঁজা। 


একদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ায় সকল প্রকার ন্যায়, ন্যায্যতা, নিয়ম শৃঙ্খলা, আইনকানুন অর্থহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই আবার নিরন্তর অর্থ খুঁজে চলে। যেকোনো কাজের পেছনে অর্থ খুঁজে না পেলে মানুষ সে কাজ করতে দ্বিধা বোধ করে। 


অস্তিত্ববাদের এ অংশের অসাড়তা দূর করতে সার্ত্রে হাজির করেন Authenticity বা প্রামাণিকতার গুরুত্ব।


একদিকে অস্তিত্ববাদ বলছে জীবনের কোনো অর্থ নেই, পৃথিবীর কোনো অর্থ নেই। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রতিনিয়ত অর্থ প্রয়োজন। সার্ত্রে বেঁচে থাকার এই অপরিহার্য উপাদান অর্থের খোঁজ পেয়েছেন প্রামাণিকতা থেকে।


তার মতে, একজন মানুষের জীবনের অর্থ তা-ই যা সে নিজে তৈরি করে নেয়। একজন মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য তা-ই, যা সে নিজে সৃষ্টি করে নেয়। তিনি এখানে একটি চমৎকার উদাহরণ ব্যবহার করেছেন।


মনে করুন, 'A' নামক এক যুবক যুদ্ধে যেতে চায়। আবার বাড়িতে নিজের একাকী বৃদ্ধ মা কে ফেলে যেতেও তার মন বাঁধা দেয়। সে যদি যুদ্ধেই যায়, তাহলে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। যদিও তার ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ খুব একটা প্রভাব ফেলবে না যুদ্ধের ফলাফলের উপর।


কিন্তু সে যদি যুদ্ধে না গিয়ে মায়ের সেবা করে, তাহলে একজন মানুষ সর্বাত্মকভাবে উপকৃত হবেন। কিন্তু এতে সামষ্টিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরকম সমস্যার সমাধান পৃথিবীর কেউ দিতে পারবে না 'A' ব্যক্তি নিজে ছাড়া। 


যুদ্ধে যাওয়া অথবা মায়ের সেবা করা, 'A' ব্যক্তি যে সিদ্ধান্তই নেবে সেটি হবে তার জন্য অর্থবহ। অন্য কথায়, 'A' ব্যক্তি নিজের জীবনের অর্থ বা উদ্দেশ্য নিজের সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই নির্ধারণ করবে।


এক্ষেত্রে 'A' ব্যক্তি দুটি সিদ্ধান্ত পরস্পরের সাথে তুলনা করে, প্রামাণিকতা বিবেচনা করে একটি গ্রহণ করতে পারবে। তাই অস্তিত্ববাদে পৃথিবী ততক্ষণ অর্থহীন এবং উদ্দেশ্যহীন যতক্ষণ না মানুষ সেখানে কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য সৃষ্টি করে নিচ্ছে। একই বক্তব্য পৃথিবীতে শৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য উদ্ভব হওয়া নীতি নৈতিকতার ক্ষেত্রেও সত্য। পৃথিবীকে শৃঙ্খলাপূর্ণ রাখতে মানুষই ন্যায়-নীতি, সততা আর ন্যায্যতার মতো ব্যাপারগুলো সৃষ্টি করেছে।


একজন মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে, তখন সে স্বাধীনতাকেই নিজের জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে নিজে ঠিক করে নেয়। তার জীবনের গতিপথ পূর্বনির্ধারিত নয়। অস্তিত্ববাদ বিষয়ক ফরাসি দার্শনিক আলবেয়ার কামুর একটি উক্তি:
“জীবনের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আমরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে যা কিছু করি তা-ই।”


প্রিয় পাঠক বন্ধুরা আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কিছু নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সবসময় শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।