আমার অনলাইন ছাত্রজীবন

টিচাররা খুব আগ্রহ নিয়ে শেখায় বটে, আমরাও খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি, আই রিপিট চেষ্টা করি!

আমার অনলাইন ছাত্রজীবন
আমার অনলাইন ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা

আমার বন্ধু তারা(ছদ্মনাম)। খুব ভাল ছাত্রী, পড়াশোনার প্রতি খুব আগ্রহ। বাবা-মা থেকে শুরু করে ভার্সিটির শিক্ষক সবার ওর প্রশংসা করে। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের খরচ চালানোর জন্য একটা চাকরীও করে।


গত পরশু মধ্যরাতে তারার হঠাৎ ফোন! আমি বললাম কিরে? তার গলা উদ্বিগ্ন, দোস্ত এই সেমিস্টারের রেজিস্ট্রেশন করেছিস?


আমি বললাম, "হ্যাঁ, করেছি".


"আমি তো পারছি না করতে!"


"সেকি কেন?"


"সেটা তো বুঝতে পারছি না।"


"একটা কাজ কর আমাদের প্রোগ্রাম কোওর্ডিনেটর স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ কর।"


আচ্ছা বলে তারা ফোনটা রেখে দিল। মিড টার্ম পরীক্ষার ২ সপ্তাহ আগে একটা লিস্ট দেওয়া হয় রেজিস্টার্ড স্টুডেন্টদের। সেখানে চোখ বোলাতেই খেয়াল করলাম তারার নাম সেখানে নেই।


আমি একটু অবাক, সে কি পরীক্ষা দিচ্ছেনা, ড্রপ দিচ্ছে? কি হলো হঠাৎ? তারাকে ফোন করাতে সে বলল আগের সেমিস্টারের কিছু টাকা বাকি থাকাতে তার নাকি রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে না।


আমার মনে পড়ল লাস্ট সেমিস্টারে আমারো কিছু টাকা বাকি ছিল। তারাকে সেটা বলাতে সে বলল, "আমার টাকা অনেক বেশি জমে গিয়েছে তাই অ্যাকাউন্ট'স ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছে না


অ্যাকাউন্ট'স ক্লিয়ারেন্স দেবে না এটা কেমন কথা! একটা স্টুডেন্ট কিছু টাকার জন্য পরীক্ষা দিতে পারবে না? তারা অসহায়ের মত বলল, না দিলে কি করবো দোস্ত? অ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম কিন্তু আমাকে মাত্র এক সপ্তাহের সময় দিয়েছে।


এক সপ্তাহে আমি এত টাকা কিভাবে দিব! এদিকে করোনার কারণে অফিসে বেতনও কমে গেছে! তারার কথার ঠিক কি উত্তর দিব আমি বুঝতে পারছিলাম না।


আমারো কিছু টাকা বাকি আছে সেগুলো আমি আস্তে আস্তে ফেরত দিবো ভাবছিলাম, কিন্তু আমারও যদি তারার মত অবস্থা হয়ে যায় তাহলে হয়তো আমাকেও...


হ্যাঁ, বলছিলাম আমার ছাত্রজীবনের কথা, মানে আমার অনলাইন ছাত্রজীবনের কথা। ক্যাম্পাসের ক্লাসরুমের বদলে এখন আমাদের ক্লাস করতে হয় আমাদের নিজ নিজ বাসায়, ল্যাপটপ অথবা মোবাইলে।


টিচাররা খুব আগ্রহ নিয়ে শেখায় বটে, আমরাও খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি, আই রিপিট চেষ্টা করি!


কিন্তু কতদিন? গত ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভার্সিটি বন্ধ। আর কি ভাল লাগে বড় ক্লাসরুম বাদ দিয়ে ল্যাপটপে বসে ক্লাস করাটা? কিন্তু কি করার! আমাদের ক্লাস তো করতে হবে, পড়াশোনা না করলে তো হচ্ছে না! ধরে নিতে হবে এটাই সময়ের দাবী।


কিন্তু সেখানে যদি পড়াশোনাটাও করতে না পারা যায় তাহলে সেই দাবী মেটাবো কিভাবে? করোনার কারণে অনেক অফিসেই বেতন কমানো হয়েছে, কিছু জায়গায় তো হচ্ছে ছাটাই! ধরে নিলাম আয় হচ্ছে কম, তাই বেতন কম।


একটা অফিস চালাতে হলে টাকা তো লাগবেই, আয় না হলে অফিস চলবে কি করে! কিন্তু একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেখানে লাগছে না পরীক্ষার খাতার খরচ, বিদ্যুতের বিল, লাইব্রেরী চার্জ; সেখানে কেন পরীক্ষার আগে এত এত টাকা নেওয়া হচ্ছে?


কিছু ছাত্র মিলে অ্যাপ্লিকেশন করলাম বেতন বাদ না দেওয়া হোক অন্তত বেতন কমানো হোক। কিন্তু কর্তৃপক্ষের তাতেও যেন সমস্যা, এত এত বেতন বন্ধ ভার্সিটির কোন কাজে লাগছে সেটার উত্তর চাওয়ার মত বেয়াদবিটা সেদিন করতে ইচ্ছা করলেও করিনি।


কারণ ভয় হচ্ছিল যদি ছাত্রত্ব বাতিল করে দেয়! নিজের প্রতিবাদী মনকে নিজের পায়ে শিকল পড়ালাম। সেদিন তারার জন্যও হঠাৎই মনটা কেঁদে উঠল। এত ভাল ছাত্রী, লাস্ট ২ সেমিস্টারে ৩.৮ পাওয়া এই উচ্চাকাংখী মেয়েটি কিনা টাকার জন্য পরীক্ষা দিতে পারবে না!


ধূর রাত দুপুরে এসব ভাবার ইচ্ছাই করে না। তাই ভাবা বন্ধ করি। মনোযোগ দিয়ে অনলাইন ক্লাস করি, টিচাররা আগ্রহ নিয়ে শেখায়। আমরাও শিখি, মানে শেখার চেষ্টা করি আর কি। সামনে পরীক্ষা, একগাদা ক্লাস টেস্ট, প্রেসেন্টেশন, এসাইনমেন্ট হাতে নিয়ে বসে আছি।


লাস্ট পরীক্ষায় যে দুই কোর্সে আমার কম মার্কস এসেছিল সেটার দিকে এবার বেশি মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু,মনটা হঠাৎ করেই ছিটকে যায় বেতনের দিকে। বেতন তো আমারও কিছু বাকি আছে। অফিসে আমারও বেতন কমানো হয়েছে।


বাসা থেকে বলা দেওয়া আছে আগেই ভার্সিটির বেতন আমাকেই চালাতে হবে। অভাবের সংসারে সন্তানকে প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করানোটাই অনেক বড় ব্যাপার। সো আমাকে সেটাও ভাবতে হবে, প্রচুর ভাবতে হবে.


নতুন চাকরী খুজতে হবে, দরকার পড়লে ৩-৪টা চাকরী করবো! সমস্যা কি? মা বলে কষ্ট করতে হবে প্রচুর কষ্ট। জীবনে সাফল্যের মুখ দেখতে হলে কষ্ট ছাড়া গতি নেই। কিন্তু যে কষ্টকে শুধু কষ্টই মনে হয়; সেই কষ্ট করার মানেটা ঠিক কি সেটার উত্তর কেউ দিতে পারে না বা চায় না।


আমাদের শিক্ষকরা যখন শোনেন পড়াশোনার পাশাপাশি আমরা চাকরী করি তখন তারা খুব রাগ করেন। আন্ডার গ্র্যাজুয়েটদের চাকরী করার দরকারটা কি? পড়াশোনার টাইমে কিসের চাকরী? পড়াশোনাটা কি এতই সোজা?


পরিক্ষার আগে বসলাম আর হয়ে গেল? আমাদের প্রচুর রিসার্চ করতে হবে, পড়তে হবে, জানতে হবে আর কি কি যেন এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। আচ্ছা তারা কি জানে না আমরা কেন চাকরী করছি? কেন আমরা পড়াশোনার পাশাপাশি ৯টা ৫টা জব করতে হচ্ছে? কেন আমাদের রেজিস্ট্রেশনের আগে টাকা আনপেইড দেখাচ্ছে তারা জানে না!


যখন বেতন কমানোর জন্য অ্যাপ্লিকেশন করলাম তখন কই কেউ তো আমাদের মৌখিক সাপোর্ট পর্যন্ত করলেন না। তাহলে চাকরী করার জন্য বিরক্ত হোন কোন আক্কেলে! ও সরি বেয়াদবি করা যাবে না! স্টুডেন্টরা বেয়াদবি করে না।


তাহলে কি করা উচিত? আমাদের মনোযোগ দিয়ে অনলাইন ক্লাস করা উচিত। ভাল লাগুক বা না লাগুক, প্র্যাক্টিকাল কোর্সগুলো প্র্যাক্টিকালি করার দরকার নাই, শুধু নোট দেখে মুখস্ত করে গেলেই হবে।


অনলাইন পরিক্ষায় তো পাশ দিয়েই দিচ্ছে। সেদিন ম্যাডাম মুখে চওড়া হাসি দিয়ে বলছেন অনলাইন ক্লাস করানোতে সারা বাংলাদেশে আমরাই প্রথম।


কি গর্বের বিষয়! ম্যাডামের বলতে বলতে যেন গর্বে মাথাটা উচু হয়ে যাচ্ছে! আমরাও সবাই চেষ্টা করছি মাথাটা উচু করার, আই রিপিট চেষ্টা করছি।


আরও পড়ুনঃ দ্য স্কারলেট লেটারঃ সমাজ ও ধর্মের বেড়াজালে আটকানো এক পঙ্কিল জীবনের গল্প