আমার বন্ধু বঙ্গ

বঙ্গবন্ধুর মতো মনের ভিতর সাহসিকতা ও বড় মনোভাব নিয়ে চলা একটা ছোট্ট ছেলের গল্প কথিত হয়েছে এখানে। যে দেখিয়েছে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ার স্বপ্ন।

আমার বন্ধু বঙ্গ
আমার বন্ধু বঙ্গ


সকালবেলা এক মগ কফি হাতে বারান্দায় এসে না দাঁড়ালে বোধহয় সারাটা দিনই শুকনো তেজপাতার মতো লাগে তনিমার। খুব সকালেই ঘুম ভাঙ্গে যে তার। তখনই যখন বিছানায় শুয়ে শহরের কেউ কেউ আধো-আধো ঘুমে মগ্ন থাকে, যখন জানালার পর্দার সাথে সূর্যের লুকোচুরি খেলা শুরু হয়ে যায়।


তনিমা আক্তার, পেশায় একজন শিক্ষিকা। পাঁচ বছর ধরে এই পেশায় আছে সে। অবশ্য শিক্ষকতার পাশাপাশি আরও একটা কাজ করে সে। সেটা হল ছবি তোলা।এটাকে বোধহয় সংখ্যালঘু মানুষ কাজ হিসেবে মনে করে। তবে ছোটবেলা থেকেই এটা তার পছন্দের তালিকায় রয়েছে। আর তার জন্যই হয়তো সময় পেলেই ঘরের বাইরে ইটের জেলখানাগুলিকে ভেদ করে সবুজ প্রান্তরে পাড়ি জমায়। তাই এটা অবসর সময়ের কাজও বলা যায়। কারণ সে সমাজকে দেখায় তার প্রধান কাজ হচ্ছে শিক্ষকতা। তবে ক্যামেরাটা সে সবসময় সাথেই রাখে।


যাইহোক আর দশটা দিনের মতো আজকেও ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা খেয়ে বেড়িয়ে পড়ল তনিমা, গন্তব্য স্কুল। মোটামোটি এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায় পৌঁছাতে।আগে আরও বেশি লাগতো। তবে দিনে দিনে রাস্তাঘাটের উন্নতির জন্য এখন অনেকটা সময় বেঁচে যায়। এইতো মহাখালীর বিশাল ফ্লাইওভারটা হওয়ায় আগের সেই তিন ঘণ্টার রাস্তা এখন দেড় ঘণ্টায় পরিণত হয়েছে।


তনিমা বাসে উঠে সামনের দিক থেকে তৃতীয় সারির একটা জানালার পাশের সিটে বসল। আরেক পাশে এক মহিলা কোলে বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। বাচ্চাটার দিকে তনিমা তাকাতেই দেখল বাচ্চাটা একটা নিষ্পাপ হাঁসি দিয়ে তার তাকিয়ে আছে। তনিমাও সামান্য হাসল। সে এরপর বাইরের দিকে তাকিয়েই তার উদ্ভট চিন্তা শুরু করে দেয়। সে বসে বসে ভাবছে,


-আচ্ছা কেমন হতো যদি বাচ্চাটার আমাদের মতো বড় বড় দাঁত থাকতো। আচ্ছা যদি বাচ্চাটার মাথায় জন্মের আগেই বড় বড় চুল থাকতো তাহলেই বা তাকে কেমন লাগতো।


সে কল্পনা করছে দাঁতসহ এলোকেশী এক বাচ্চা মায়ের পেট থেকে বেড়িয়ে আসছে। তনিমার এসব ভাবতেই হাঁসি পাচ্ছে। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। তার মাথায় প্রায়ই এসব আজব চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্লাইওভারের সামনে কিছু ছেলেকে দেখতে পায়। সংখ্যায় ছয় কি সাত জন হবে। বয়স হয়তো কৈশোরে পা দিয়েছে।ফ্লাইওভারের এখানে লোকজন থাকাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার না। ব্যাপারটা হলো দুই-তিন দিন ধরে এদের এখানে দেখা যাচ্ছে। প্রায় সারাদিন যখনই আসা-যাওয়া করছে সব সময় দেখতে পাচ্ছে। তনিমা  প্রথমে ভেবেছিলো এরা হয়তো বা রাস্তায় ভিক্ষা করে। কিন্তু তাদের দাঁড়ানো দেখে তো তেমন মনে হয় না। তবে তাদের শরীরের গঠন ও পরনের ময়লা জামা কাপড় দেখেতো তেমনটাই মনে হয়। আবার এদের মধ্যে একটা ছেলে একটু সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, যাকে দেখলে তাদের লিডার বলে মনে হয়। বঙ্গবন্ধু একটা পোস্টার ও হয়তো টাঙানো আছে তাদের ঠিক তাদের মাথার উপরে। ময়লা হয়ে আছে ভালোভাবেই। পাশ দিয়েই ফ্লাইওভারটি গিয়েছে।


তনিমা  ভাবল  গিয়ে জিজ্ঞাসা করি তারা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? প্রয়োজনে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে নামে সাহায্য করে আসল। যেই ভাবা সেই কাজ। সাথে সাথে বাস থেকে নেমে পড়ল। হেঁটে রাস্তার ওপারে গেল। গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াল। তাদের কেউ কেউ এর মধ্যে তার দিকে তাকিয়ে আছে।তনিমা গিয়ে সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করল,


-“তোমার এখানে দাঁড়িয়ে কি কর সারাক্ষণ? গত দুইদিন ধরে তোমাদেরকে এখানেই দেখে আসছি।”


তাদের কাছ থেকে যে উত্তরটা এসেছিল সেটা কখনোই আশা করেনি তনিমা। কারণ তাদের একজন বলল তাদের এক বন্ধু রনি পুলিশের গাড়ির আঘাতে আহত হয়েছে। কোন এক রাতে রনি রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখন পুলিশের গাড়ির পিছন থেকে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে আহত করে রক্তাক্ত করে ফেলে। পরে জানা যায় পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার নাকি মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিল। এক্সিডেন্ট এর ফলে রনি তার পা হারিয়ে ফেলে। আর এত বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যাওয়ার পরও কারোর কোনরকমে ভ্রুক্ষেপ নেই, কারোর কোনো চিন্তা নেই। অন্যদিকে পুলিশরা তাদের এই ঘৃণ্য কাজ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সেই ছেলেটাকে সাহায্য করার বদলে তার পরিবারকে শোষণ করে চলেছে। তাদের পরিবারকে একের পর এক হুমকি দিয়ে চলেছে যাতে তারা কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে না পারে পুলিশের বিরুদ্ধে।


সত্যিই এই সমাজটা একের পর এক ধনী গরিবের শ্রেণীবিভাগ করতে করতে নরকের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়েছে। আর যে নরকের ফেলা হয়েছে শুধুমাত্র গরীবদেরকে কারণ তারা গরীব হয়ে জন্ম নিয়েছে।


তাদের অবস্থার কথা শুনে অত্যন্ত মর্মাহত হল তনিমা। এরপর তাদেরকে জিজ্ঞাসা করল যে- তারা এখন কি করতে চাচ্ছে?


তারা জানালো যে তারা তার বন্ধুর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করতে চাচ্ছে আর সাথে পুলিশের করার ঘৃণ্য কাজের শাস্তি চায়। তাই অন্যায়ের শাস্তির জন্য আন্দোলন করছে তারা। কারণ কথিত আছে যে আইনের চোখে সবাই সমান।


তনিমা তাদের চিন্তা ভাবনা দেখে খুবই খুশি হলো। এরপর আরো কিছুক্ষন তাদের সাথে কথা বলতে বলতে সে জানতে পারল তাদের মধ্যে সেই মাঝের ছেলেটা যাকে দেখতে দলনেতার মত সেই নাকি আসলে সবাইকেই আন্দোলনের জন্য ডেকেছে। সে সবাইকে বুঝিয়েছে যে, নাগরিক হিসেবে দেশে সবার সমান অধিকার আছে। তাই রনির ও অধিকার আছে ন্যায়বিচার পাওয়ার। তনিমা ভাবে, সত্যিই তাদের কাজ প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। বস্তির ছেলে হয়েও পুলিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা সাহসিকতা তারা মনে ধরেছে। মানতেই হবে মনে বেশ সাহস আছে তাদের বিশেষ করে ওই দলনেতার।


যাইহোক তনিমা যতটা পারলো টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করে আজকের মতো স্কুলে চলে গেল। আজকে স্কুলে অনেকটাই দেরি হয়ে গেল। তনিমা ভাবল যাইহোক পুরনো কথা চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি বাচ্চাদেরকে গিয়ে পড়াতে হবে। পড়ানোর সময় হঠাৎই আবারই মনের অজান্তে সেই ছেলেগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। অবশ্য মনে পড়তো না যদি না ঠিক আজকেই সে অষ্টম শ্রেণীতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটা না পড়াতো। তাদেরকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানাতে গিয়ে হঠাৎ তার মনের অগোচরে সেই দলের দলনেতার ছবিটা মাথায় এলো। সত্যিই কি সে আজকের বঙ্গবন্ধু? কারণ সেও তো আজকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের মত একই কাজ করেছে। সবাইকে একত্র করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য। সমান অধিকার পাওয়ার জন্য। যেখানে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালে একই কাজটাই করে। এখানে দুজনেই আহ্বান করেছে, শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রটা  ভিন্ন।


বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সময় তনিমা আবার সেখানে নেমে গেল। গিয়ে দেখল আরও একটা চমৎকার। দেখল দলনেতা সেই ছেলেটা তার গায়ের ছেঁড়া শার্টটা খুলে দিয়ে একটা ছোট্ট বাচ্চাকে ঢেকে দিচ্ছে। তনিমা হাসল আর মনে মনে ভাবল হয়ত মাথার উপর ছাতা থাকলে ঠিক বঙ্গবন্ধুর মতো করে ছাতাটা তার কোনো এক বন্ধুকে দিয়ে দিত। তনিমা কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল,


-“এই ছেলে তোমার নাম কি?”


ছেলেটা উত্তর দিতে যাবে ঠিক এমন সময় পাশের থেকে আরেকটা ছেলে এসে তার মুখে কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল,


-“ ম্যাডাম ও আমার দোস্ত আমাগো বস্তির  মধ্যেই থাকে। ওর নাম বঙ্গ। ও আমার বন্ধু”।


তনিমা অনেকটা বিস্মিত হয়ে গেল। সে আবার জিজ্ঞাসা করলো,


-“কি, কি বললে তুমি !”

 
বাকি ছেলেগুলো বলে উঠলো,


-“ হ্যাঁ ম্যাডাম, আমাগো বঙ্গ আমাগো অনেক কামে সাহায্য করে। আমাগো বস্তিতে থাইকাও অনেক ভালো পড়ালেখা করে। ফাইভে তো সরকার থেকে টাকাও পাইছিল। ও হইছে আমাগো বন্ধু বঙ্গ।”


তনিমা সামান্য মুচকি হাসল। ছেলেটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তৎক্ষণাৎ সে ব্যাগ থেকে তার ক্যামেরাটা বের করে তাদের কিছু ছবি তুলে নিল। তনিমা বাসে উঠে কিছু একটা বলে ভাবতে লাগলো আকাশের দিকে তাকিয়ে। একটুপর সে ব্যাগ থেকে আরেকবার ক্যামেরাটা বের করল। একে একে সবগুলো ছবি দেখতে লাগলো। ছবিগুলোতে একটু লক্ষ্য করতেই দেখা যাচ্ছে গোধূলি আকাশের সন্ধের সেই লাল সূর্যটা ছেলেটার মাথার পাশে স্থান পেয়েছে। আর তার আলোতে বঙ্গের মাথার উপর নোংরা বঙ্গবন্ধুর অস্পষ্ট ছবিটা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুটো মুখ যেন এক হয়ে মিশে গিয়েছে। আর তৈরি হয়েছে দিগন্ত উন্মোচন করা আরেক নতুন দেশপ্রেমিকের মুখ। হয়তো আবারও কোনো নতুন স্বপ্নে সাজবে আমাদের সোনার বাংলাদেশ।