আশ্রিতঃ এক আশ্রিত মেয়ের পুনরায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়ার করুন কাহিনী

শেষ কথাটাই ওর কানে লেগে আছে "আরশি আশ্রিত "এতোদিনের সম্পর্ক কি তবে মিথ্যা, আমি এখনো এই বাড়ির একজন হতে পারলাম না।

আশ্রিতঃ এক আশ্রিত মেয়ের পুনরায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়ার করুন কাহিনী
আশ্রিতঃ এক আশ্রিত মেয়ের পুনরায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়ার করুন কাহিনী


বিকাল হতেই আকাশ গাঢ় অন্ধকার করে বৃষ্টি নামলো, এই বৃষ্টির জন্যই অপেক্ষা করছিলো আরশি। বৃষ্টি নামার সাথে সাথেই চুপচাপ ছাঁদে চলে গেলো আরশি, কিছুক্ষণ বৃষ্টি ভেজার পর চোখ পড়লো রাস্তার দিকে একটা ছেলে অনেক গুলো কদমফুল হাতে হেঁটে যাচ্ছে।


আরশির লোভ হলো কদম ফুলে, দৌড়ে নিচে নেমে আসতে আসতে ছেলেটা অনেকটা দূরে চলে গেছে, আরশি ছেলেটার পিছনে ছুটতে লাগলো। ডাক দিলো, এই ফুলওয়ালা দাড়াও বলছি।


--এই যে কদমফুল ওয়ালা কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছো না?

--আমাকে ডাকছেন? --এখানে তুমিই তো একমাত্র ফুলওয়ালা তাই না?

--ইয়ে মানে! আমি ফুলওয়ালা!!!

--হুম আমাকে দিন তো ফুল গুলো ছেলেটা কিছু না বলেই ফুল গুলো আরশির হাতে দিলো।

--দাম কতো

--মানে?

--উফ , ফুলগুলোর দাম কতো?

--লাগবে না, আপনি এমনি নিয়ে নেন।


--কি বলছো? এই বৃষ্টিতে এতো কষ্ট করে ফুল বিক্রি করতে আসছো আর দাম নিবেন না? একটু দাড়াও আমি টাকা নিয়ে আসছি। বলেই দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির ভেতর ঢুকলো, বেড়িয়ে এসে দেখে ছেলেটা নেই। মন খারাপ করে আবার ঘরে ফিরে এসে ড্রেস চেইঞ্জ করে ফুল সাজিয়ে রাখলো। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দিলেন আফসানা বেগম!


--কি'রে আবিদ এমন কাক ভেজা হয়ে কোথা থেকে আসলি?

--ফুল বিক্রি করে আসলাম মা।

--কিহ!! ফুল বিক্রি করে মানে?

--মানে হলো, তোমার ছেলে আজ কদম ফুল বিক্রি করতে গেছিলো বাইরে।

-- কি বলিস এসব? তুই না বললি আমার জন্য দারুণ একটা জিনিস আনতে যাচ্ছিস?

-- তাই তো বাইরে গেলাম! ভাবলাম আমার একমাত্র মায়ের জন্য কদম ফুল নিয়ে আসবো কিন্তু বাসা পর্যন্ত আনতে পারলাম না এর আগেই বিক্রি হয়ে গেলো।

--এটা কি ধরনের কথা আবিদ!


--বিদেশ থেকে পিএইচডি কমপ্লিট করে আসা তোমার একমাত্র আদরের ছেলে আহনাফ আবিদ এখন একজন ফুলওয়ালা। বলেই মুচকি হেসে নিজের রুমে চলে গেলো আবিদ। এদিকে সব কিছু আফসানা বেগমের মাথার উপর দিয়ে গেলো। ভার্সিটি থেকে বের হয় আরশি আর ওর বান্ধবী সানিয়া। আকাশে বৃষ্টির ভাব দেখে সানিয়া আরশিকে নিয়ে একটা ছাতা কিনতে গেলো, তখনই পিছন থেকে একটা ডাক আসে।


--এই যে মেম

--আমাদের বলছেন?(সানিয়া জিজ্ঞেস করলো)

--আপনাকে না উনাকে।

--জ্বি, বলুন আরে আরে আপনি কালকের ফুলওয়ালা না?

--জ্বি ওদের কথার মাঝে সানিয়া বলে উঠলো, এই আরু উনি কি করে ফুলওয়ালা হয়??? তোর কি মাথা ঠিক আছে?

--তোর সাথে এটা নিয়ে পরে কথা বলছি। আবিদকে উদ্দেশ্য করে আরশি বললো,

--কাল ফুলের টাকা না নিয়ে চলে গেলেন যে?

--ওটা আপনাকে উপহার হিসেবে দিয়েছি মনে করুন না।

--এভাবে মানুষকে ফুল উপহার দিয়ে বেড়ালে আপনার চলবে কি করে?

--আপনাকে আমি সামান্য বোকা ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি তো দেখছি বর্তমান যুগের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত বোকা।

--কি বলতে চান?


--বলতে চাই আমাকে কোন দিক থেকে আপনার ফুলওয়ালা মনে হয়? আচ্ছা গতকাল না হয় বৃষ্টির মধ্যে দেখেছেন তাই আন্দাজ করতে পারেননি কিন্তু আজকেও একই কথা বলছেন। আরশি মনে মনে ভাবলো ঠিকই তো উনাকে দেখলে কে বলবে উনি ফুলওয়ালা।আমার মাথায় এটুকুও এলো না।


--আসলে এতো গুলো কদমফুল নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে যাচ্ছিলেন তাই ভাবলাম আরকি। দুঃখিত, আমি আপনার ফুল রেখে দিলাম কাল (লজ্জা পেয়ে বললো)


--না না ঠিক আছে, আমার মায়ের কদম ফুল খুব পছন্দ তাই উনার জন্যই কাল


--ছি ছি আপনার মায়ের ফুল আমি এভাবে রেখে দিলাম।

--কাল যে বাড়ি থেকে বের হলেন ওটা বুঝি আপনার বাড়ি?

--জ্বি

-- এখনো পরিচয় হলো না, আমি আহনাফ আবিদ, আপনি?

--বলবো না


--ওকে বলিয়েন না,আজ তাহলে আসি। --আচ্ছা আবিদের চলে যাওয়ার পর সানিয়া হাসতে হাসতে বসে পড়লো।


--বিশ্বাস কর আরু তোকে দিয়েই এসব সম্ভব আর কেউ তোর মতো এতো আকাম করার জন্য দক্ষ না। রাগ করে চলে গেছে আরশি। পরের দিন ক্লাস না থাকায় সারাদিন বাড়িতেই ছিলো আরশি, ঘরে পায়চারি করতে করতে ভাবছে আবিদ কত্তো সুন্দর যে কোন মেয়ে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাবে, ইশ ওর সাথে যদি আমার ভেবেই নিজের মুখ ঢেকে নিলো লজ্জায়। লুৎফর রহমানের ডাক শুনে তার ঘরে গেলো আরশি।


--কিছু বলবে বাবা?

--হুম, বস

--বলো


--তানিশার জন্য একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে আমি ওখানেই তানিশার বিয়ে দিতে চাই, এটা তুই তানিশাকে আজই বলবি। আগামী কাল পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে।


--জ্বি বাবা বলবো। বাবার ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় গিয়ে আরশি ভাবলো, আমি বড় কিন্তু আমার বিয়ের কথা না ভেবে বাবা তানিশাকে আগে বিয়ে দিতে চান কেন? তবে কি আমাকে এখনো... ভাবনার মাঝেই তানিশা এসে বললো কি রে আপু এখানে কি করিস?


--কিছু না বস, তোর সাথে জরুরী কথা আছে।

--ওকে, বল

-- বাবা তোর বিয়ে ঠিক করেছে। কাল পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে।

--কি যা তা বলছিস, তোকে রেখে আমাকে কেন বিয়ে দিবে?

--হয়তো কোন কারণ আছে।

--যাই কারণ থাক লোকে কি বলবে? দাঁড়া আমি বাবার সাথে কথা বলে আসি।

--বাবাকে তো চিনিস কথা বলে কোন লাভ নাই তার চেয়ে বিয়েটা করে নেয়।

-- আসছি আমি। তানিশাও জানে ওদের বাবা কেমন তাই মায়ের সাথে কথা বললো,

--মা এসব কি শুনলাম?

--আশা করি খারাপ কিছু শুনিসনি?


--খারাপের থেকেও খারাপ কথা এটা, আপুকে রেখে আমাকে আগে বিয়ে দেয়ার কথা তোমরা চিন্তা করো কি করে?


--এতো বেশি বুঝতে হবে না তোকে, তোর বাবা আর আমি যা করছি ভালোর জন্যই করছি। আর একটা কথাও না বলে এখান থেকে যা। মন খারাপ করে চলে গেলো তানিশা, ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, আমার বিয়ে আগে হলে আপুকে লোকে অনেক আজেবাজে কথা বলবে।


এটা কি ঠিক করছে বাবা মা? পরের দিন বিকেল বেলা পাত্র পক্ষ দেখতে এলো তানিশাকে, আরশিকে ওর মা সবার সামনে যেতে বারণ করেছে বিধায় ও রুম থেকে বের হয়নি। তানিশাকে পছন্দ হয়েছে পাত্র পক্ষের তাই আংটি পরিয়ে সামনের শুক্রবার একেবারে বিয়ের দিন পাকা করে গেল। এতে অবশ্য লুৎফর রহমান খুবই খুশি হলেন, মনে মনে যেন এটাই কামনা করছিলেন তিনি।


আরশি এই বিয়ে নিয়ে একটাও কথা বলেনি কিন্তু তানিশার অনেক আপত্তি এই বিয়ে নিয়ে, কেন এতো হুটহাট বিয়ে? কেন ছেলে এলো না দেখতে? কেনই বা ছেলের ছবি দেখিয়ে ছবিটাও তাকে দেয়া হলো না। আরশি ঠান্ডা মাথায় তানিশাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর গায়ে হলুদের দিন চলে এলো সব কিছু ঘরোয়া ভাবেই হচ্ছে। এখনো আরশিকে দূরে রাখা হলো, যেন কোন মতেই এটা প্রকাশ না পায় পাত্র পক্ষের সামনে,যে বড় বোনকে রেখে ছোট বোনের বিয়ে দিচ্ছে তারা।


বিয়ের দিন উপস্থিত, বর যাত্রা চলে এসেছে আরশি চিলেকোঠার ঘরে বসে এক নাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। পৃথিবীতে যেন তার আপন বলতে কেউ নেই। বাড়িতে বিয়ে অথচ ও কি'না চিলেকোঠায় নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। বিয়ে পড়ানো শেষ তার কিছুক্ষণ পরেই নিচ থেকে অনেক চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনা গেলো কিন্তু আরশি কিছুই বুঝতে পারলো না কি হচ্ছে! মিনিট পাঁচেক পরেই তানিশা দৌড়ে এলো চিলেকোঠার ঘরে আরশির কেমন যেন ভয় হতে লাগলো। তানিশা জোর করে আরশিকে নিচে নিয়ে গেলো সবার সামনে। বরকে দেখে আরশি বলে উঠলো আবিদ আপনি?


--হুম আমি, কিন্তু বউয়ের জায়গায় তুমি নও কেন? আমি তো তোমাকে বিয়ে করবো বলে এসেছি। আরশি কোন কথা না বলে তার বাবার দিকে তাকালো লুৎফর রহমান মাথা নিচু করে রাখলেন। তখন আবিদ বলে উঠলো,


--কথা বলো আরশি, তুমি না বলেছিলে এটা তোমার বাড়ি? আমার মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসার পর তোমার বাবা বললো উনার একটাই মেয়ে তাই আমরা ভাবলাম তুমিই সেই কিন্তু এখানে এই মেয়েটা কেন? (একনাগাড়ে কথাগুলো বলে শ্বাস নিলো আবিদ) আরশি তখনও চুপ করেই আছে, কি বলবে জানা নেই তার, লুৎফর রহমান বললেন, বাবাজি বিয়েটা যখন হয়ে গেছে তখন এতো কথা বলে কি লাভ?


--What do you mean by বিয়ে হয়ে গেছে? আমি এই বিয়ে মানলে তো বিয়ে হবে? আপনি প্রতারণা করে আমাদের ঠকিয়েছেন, কেন বললেন আপনার এক মেয়ে? সত্যিটা গোপন করলেন কেন?


-- কোন সত্যি গোপন করিনি, আমাদের একটাই মেয়ে। তানিশা আমার একমাত্র মেয়ে। আরশি আমাদের আশ্রিত।তোমার মতো একজন ছেলে একটা আশ্রিত এতিম মেয়েকে কি করে বিয়ে করতে পারে?


--আপনি কি ঠিক করে দিবেন, আমি কাকে বিয়ে করবো কাকে করবো না? আরশির কানে এখানকার আর কোন কথাই ডুকলো না, শেষ কথাটাই ওর কানে লেগে আছে "আরশি আশ্রিত "এতোদিনের সম্পর্ক কি তবে মিথ্যা, আমি এখনো এই বাড়ির একজন হতে পারলাম না। নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালো আরশি


--বাবা আবিদের সাথে আমার বিয়ে দাওনি এটা নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই কিন্তু এটা তুমি কি করে বললে যে আমি তোমার মেয়ে না?


--ঠিকই বলেছি, সবাই তার নিজের সন্তানের ভালো চায় আমিও তার ব্যতিক্রম না। আরশি লুৎফর রহমান আর কিছু বলেনি, আবিদের দিকে তাকিয়ে বললো


--সরি আবিদ! আমি আসলে বুঝতে পারিনি আমি এবাড়ির কেউ না, ছোট থেকেই দেখে আসছি ওরা আমাকে নিজের বাবা মায়ের মতো ভালোবাসে কখনো তাই নিজেকে এতিম বলে মনে হয়নি। আমি অনেক ছোট থাকতেই আমার বাবা-মা দুজনেই মারা যান।


উনারা মানে আমার চাচা-চাচি আমাকে মানুষ করেন। আমি আপনাকে যদি আগে বলে দিতাম তাহলে আপনাদের এতো বড় বিপদে পড়তে হতো না। আর তাছাড়া আমি তো জানিও না যে আপনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর জন্য আমার বাসার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। আরশি চলে গেছে এখান থেকে, বাড়ি ভর্তি মানুষ রেখে আরশি চলে গেছে ওর বাবা মায়ের কবরের কাছে। ওখান থেকেই অজানা পথে চলে গেলো আরশি! আবিদও রাগারাগি করে বিয়ে বাড়ি ছেড়ে নতুন বিয়ে করা বউ কে রেখে চলে গেছে নিজের বাড়ি।


আবিদের মা ও তানিশার মা বাবার মাঝে কথা হলো আবিদের মেজাজ পরে ঠিক হলে বুঝিয়ে শুনিয়ে তানিশাকে ঘরে তুলে নিবে কিন্তু তানিশা রাগে, দুঃখে, অপমানে ঐ সময়েই আত্মহত্যা করলো। লুৎফর রহমান তার নিজের একমাত্র মেয়ে তানিশাকে হারলো সেই সাথে হারালো আরেক টা এতিম আশ্রিত মেয়েকে।