আসল ভালোবাসা, যার তুলনা সে নিজেই

সমাজে এরকম অনেক ভালোবাসা আছে মিনি ও সৌমেন এর মত। বুঝতে পারলে জীবন স্বর্গ সুখ লাভ করবে, নয়তো সম্পর্ক ডিভোর্স পর্যন্ত পৌঁছাবে।

আসল ভালোবাসা, যার তুলনা সে নিজেই
আসল ভালোবাসা, যার তুলনা সে নিজেই


কোনদিনও প্রেমে পড়েনি মিনি, বাড়ির একমাত্র মেয়ে সকলের আদরের, সবাই তাকে এতটাই ভালোবাসে যে সবাই দেখতে চেয়েছিল সে রাজরানী হয়েছে। তবে মিনি কলেজে পড়াকালীন বান্ধবীদের কাছে প্রেমের কথা অনেক শুনেছে তবে তার কোনো আগ্রহ ছিল না এ বিষয়ে, তবুও বয়সের ধর্মে একটু হলেও এসবের মানে বুঝত সে।

কলেজ শেষ হয়েছে এবার সুপাত্রে তাকে পাত্রস্থ করার অপেক্ষায় তার পরিবার। মিনিও লক্ষী মেয়ে তাই তার সু পাত্রের অভাব হলো না। বড় ব্যবসায়ী যে ছেলে, তাই মিনির বাবা-মা পরিবারের সদস্যরা কোনরকম দ্বিধা বোধ না করে পাকা কথা দিয়ে দেয়। ছেলেও খুব  ভালো। সবকিছু সুন্দরভাবে বোঝে। তাই তার কোন অমত ছিল না।


একদিন ভাল দিন দেখে ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। নতুন সংসার সবকিছু তার শাশুড়ি মা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে বড় পরিবারে বিয়ে হয়েছে, তার কোন কিছুরই অভাব নেই কোন কাজ তাকে করতে হয় না, শুধু স্বামী ও শ্বশুর শাশুড়িকে খেয়াল রাখা ছাড়া। স্বভাবতই খুবই খুবই ঠাণ্ডা  মিনি। তার স্বামী সৌমেন সকাল দশটায় চলে যায় তার অফিসে।


তাকে গুছিয়ে দিয়ে অন্য কাজে মন দেয়  মিনি। প্রায় এক মাস হতে চলল, তাদের বিয়ে হয়েছে। সৌমেন অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় একটু আলাদা এমনটাই মনে হয় মিনির। কথা কম বলা, সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকা। সবকিছু কেমন যেন অন্য রকম লাগে তার। সে ভাবে হয়তো তার স্বামী একটু আনরোমান্টিক।


একদিন পাড়ার এক আত্মিয়ের বিয়েতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো সে, সুন্দর করে সেজে ছিল ভেবেছিল তা দেখে হয়তো খুশি হবে সৌমেন, প্রশংসা করবে তার সাজের। ভালো করে শাড়ির আঁচলটা ঘুরিয়ে তার কাছে গিয়ে বলে:


মিনি : কেমন লাগছে আমাকে?

সৌমেন : হাতের ঘড়িটা ঠিক করতে করতে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে শুধু বলল, হ্যাঁ বেশ লাগছে। তাড়াতাড়ি চলো এমনিতেই লেট হয়ে গেছে।


মিনি ভেবেছিলো হয়তো আরেকটু ভালোভাবে কথা বলবে তার সাথে, কিন্তু সেটাও হলো না ভীষণ কষ্ট পেল মনে মনে। ভাবল এত সাজা গোজা তো তার জন্যই তবে একটু কি মন খুলে প্রশংসাও করতে নেই!


সৌমেন এগিয়ে আসে, মিনি আবার ঘুরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলে নিজেকে দেখতে চায়, আর তখনই চোখ পড়ে ড্রেসিং টেবিলে রাখা আছে একগাছা বেলফুল এর মালা। খুশিতে তার দুচোখে জল ভরে ওঠে। তড়িঘড়ি মালা গুলো চুলে লাগিয়ে ছুটে আসে সৌমেনের কাছে। তারপর বেরিয়ে পড়ে বিয়ে বাড়ির উপলক্ষে।


তার কিছুদিন পর মিনি নিজের হাতে পায়েস বানিয়েছে, সকালে খাবারের টেবিলে টিফিনের পাশাপাশি পায়েস টাও একবাটি রেখেছিল সে। সৌমেন যখন টিফিন খাচ্ছিল তখন সে একটানা চেয়ে ছিল তার মুখের দিকে কখন পায়েস টা খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে। এক চামচ মুখে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে মিনি বলে ওঠে : কেমন হয়েছে বললে না তো? মার কাছ থেকে শুনলাম তুমি নলেন গুড়ের পায়েস খেতে পছন্দ করো তাই ভাবলাম আজকে একটু বানাই।


সৌমেন : হ্যাঁ ভালোই তো হয়েছে।


তারপর সে তড়িঘড়ি রওনা দেয় অফিসের উদ্দেশ্যে।


মিনি মন খারাপ করে বাকি পায়েস টা রেখে দেয় ফ্রিজে।


রাতে খাবারের পর সবাই তখন শুয়ে পড়েছে, শুয়ে পড়েছে মিনিও। কিছুক্ষণ পর তার লক্ষ্য যায় সৌমেন ঘরে নেই অনেকক্ষণ হয়ে গেছে এতক্ষণ কি করতে পারে সে।


সে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে ফ্রিজ এর কাছে ফ্রিজের আলোতে, রেখে দেওয়া পায়েস টা বাটি মুছে খাচ্ছে সৌমেন। ভালোলাগার পাশাপাশি হাসি চাপতে পারেনি সে।


মিনি : নিজের ঘরে এভাবে চুরি করে খাওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল কি, আমাকে বললেই পারতে আমি ঘরে নিয়ে যেতাম।


সৌমেন : তুমি আবার উঠলে কেন আমি ভাবলাম সারাদিন তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে, তাই তোমাকে আর কিছু বলিনি, তখন তাড়াহুড়োতে খেতে পারিনি খুব সুন্দর লেগেছিল তাই ভাবলাম নিশ্চয়ই তুমি আমার জন্য রেখে দিয়েছো।


মিনি ভাবল ভালোবাসা আসলে কি সবার সামনে লোক দেখিয়ে বলাটা, নাকি এরকম দায়িত্ববান চাপা ভালোবাসা যেখানে শুধুমাত্র যত্ন আর দায়িত্ব থাকে।


'মাসের বিশেষ দিনগুলির জন্য তাকে কোনদিনও আলাদা করে বলতে হয়নি, প্রতিটি প্রয়োজন সে আমার না বলাতে পূর্ন করেছে।' এর আগে কিছু না বুঝে অনেক কিছুই মিনি তার ঠাকুমা কে বলেছিল। এবার যত দিন যাচ্ছে ততোই সে মানুষটাকে চিনতে শিখেছে, এখনকার কথাও ঠাকুমাকে বলেছিল সে, ঠাকুরমা তাকে একটা ছোট্ট গল্প শোনায়,


একটা দম্পতি ঘুরতে গিয়েছিল এক চিড়িয়াখানায় সেখানে সব রকমের জীবজন্তু দেখতে দেখতে তারা বেরিয়ে আসছিল অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য, কিন্তু মেয়েটি লক্ষ্য করেছিল প্রত্যেক জীবজন্তুদের মধ্যে ভালোবাসা। কোথাও বা জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে পাখি কোথাও বা বানর আবার কোথাও বা একই খাঁচার ভিতর সিংহ।


সবাইকে অনেক কাছাকাছি থাকতে দেখেও দুই সিংহ সিংহীকে একটু আলাদা মনে হয়েছিল। তখন মেয়েটি তার স্বামীকে বলেছিল, দেখো পাখিরাও কেমন একই জায়গায় বসে আছে ওই দুটো বানরকে দেখো ওদের মধ্যে ভালবাসা যেন অটুট, আর এই দিকে দেখো সিংহ সিংহির মধ্যে যেন ঝামেলা লেগেই রয়েছে। কতটা দূরত্বে আছে ওরা।


তখন ছেলেটি তাকে বলেছিল, তুমি দেখতে চাও এই এতগুলো ভালোবাসার মধ্যে কোনটা আসল ভালোবাসা, চলো তাহলে একটা পরীক্ষা করি।


প্রথমে একটা পাখি কে লক্ষ্য করে ছোট্ট একটা ঢিল ছোড়ে সে, সাথে সাথে সেই পাখিটা উড়ে যাওয়ার আগেই তার পাশে অন্য পাখি উড়ে গেছে। একটা বানান কে ঢিল মারার সাথে সাথে, সাথে থাকা বানর টি তাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়েছে, পাছে তার গায়ে ঢিলটি গিয়ে না লাগে।


এবারে অনেকটা দূরত্ব থাকা সত্বেও যখন মেয়ে সিংহটাকে ঢিল ছোড়ার পরিকল্পনা করছে তার সাথে সাথেই ছেলে সিংহটি খাঁচার একেবারে কাছে এসে জোরে গর্জন করে উঠল তার সাথে খাঁচায় আঘাত করলো সজোরে। তারা দুজন সরে এল অনেকটা দূরে।


তখন মেয়েটা বুঝেছিলো যে সত্যিই আসল ভালোবাসা কোনদিনও লোক দেখিয়ে হয় না।


এমনও অনেকে আছে সবার সামনে এতটাই ভাব নিয়ে চলে যেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা। অথচ তার কোন রকম সুবিধা অসুবিধা তে পাশে থাকে না দুজন দুজনের। সবার চোখের আড়ালে তাদের মধ্যে নেই কোন মিল, আর সবার সামনে দেখাতে চায় তাদের অভিনয় করা ভালোবাসা। আসলে তা দৃষ্টিকটু লাগে তার সাথে একটু হলেও ভালোবাসার অপমান করা হয়। যদি কাউকে ভালোবাসো তাহলে তার সমস্ত কষ্ট দুঃখ প্রয়োজন খেয়াল রাখাটা জরুরি।


সমাজে এরকম অনেক ভালোবাসা আছে মিনি ও সৌমেন এর মত। বুঝতে পারলে জীবন স্বর্গ সুখ লাভ করবে, নয়তো সম্পর্ক ডিভোর্স পর্যন্ত পৌঁছাবে। আসল ভালোবাসা বুঝতে একটু হলেও সময় লাগে আর সেই ভালোবাসাটাকে বাঁচিয়ে রাখার ও যোগ্যতার প্রয়োজন।