আস্থাঃ একটি আড়লনকারি সামাজিক কাহিনী
একটি আড়লনকারি সামাজিক কাহিনী । এই গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘ পর্ণা ’ যে নিজের অপ্রপ্তিকে পথ চলার পাথেয় করে নিজের স্নিগ্ধ ছায়ায় হয়ে উঠেছে অন্যের দুঃখের । গল্পটি শেষ অবধি পড়ার অনুরোধ রইল ।

আজ পর্না খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। স্নান সেরে নতুন শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার জন্য। কারন আজ পর্নার জীবনের একটি বিশেষ দিন। মন্দির থেকে এসে তার আবার অনেক কাজ আছে। আজ সারাদিন দম ফেলার সময় পাবে না সে।
মন্দির থেকে ফিরে পর্না দেখল অনেকেই আসতে শুরু করে দিয়েছে যাদের বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দেওয়া ছিল। কেউ কেউ আবার তাদের নির্ধারিত কাজ করতে শুরু ও করে দিয়েছে। এরা প্রত্যেকেই পর্নার খুব কাছের ও বিশ্বাসের লোক। থেকে আসতে দেরী হচ্ছে দেখে যার কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে।
আজ অনেক রকমের আয়োজন আছে। খাওয়ার ব্যবস্থা আছে তাছাড়াও একটা ছোট করে অনুষ্ঠান আছে। অনেক চেনা , অচেনা সবাই আসবে কারণ আজ পঞ্চম বার্ষিকি ……. না না ভুল ভাবছেন বিবাহ বার্ষিকী নয়। আজ ‘ আস্থার ’ পঞ্চম বার্ষিকির অনুষ্ঠান বা আজ ‘ আস্থা ’পঞ্চম প্রতিষ্ঠা দিবস ও বলতে পারেন। আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে এই দিনটিতে তৈরি হয়েছিল পর্ণার স্বপ্নের এনজিও ........ ‘ আস্থা ’।
আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো পর্ণার চোখে ও একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা ছিল অসহায় শিশুদের জন্য কিছু করার। এই স্বপ্নটা তাকে দেখিয়েছিল তার বাবা।
পর্ণার বাবা একজন ছাপোষা মানুষ হলেও তিনি অনেক সময় নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আর সাহায্য প্রার্থী যদি কোন ছোট বাচ্চা হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। ছোট থেকে পর্নার বাবা ছিল তার কাছে ‘ Idol ’। তাই সেও চেষ্টা করেছে তার বাবার পথে চলার।
পর্ণা লেখাপড়া শেষ করার পর একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হয়। যথা সময়ে তাঁর বিয়ে হয় একটি ডাক্তার সঙ্গে যার নাম ছিল দীপ্ত। বিয়ের পর বছর দুয়েক বেশ সুখে শান্তিতেই ছিল তারা। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের সংসারে অশান্তির বীজ বপন হচ্ছিল যার প্রধান কারণ ছিল সন্তান না হওয়া। যেকোনো কারণেই হোক পর্না মা হতে পারছিল না। তাই সেই কারণে তার শ্বশুর বাড়ির লোক তার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিল। এই ব্যাপারে ডাক্তার হওয়া সত্বেও সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল দীপ্ত অর্থাৎ পর্ণার স্বামী।
তাদের মধ্যে ভালোবাসা বোঝাপড়া ভালো থাকলো এই বিষয়টি নিয়ে অশান্তি চরমে উঠেছিল দিন দিন। এই অশান্তি আরো চরম হল যখন পর্ণা পালক কে এডপ্ট করতে চাইল। দীপ্ত এত শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও বলল , “পালক আমার রক্ত নয় , আমি ওকে আমার সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে পারবনা ”।
পর্ণা পালক কে প্রথম দেখেছিল তাদের স্কুলের পাশে মন্দিরে। সদ্যজাত একটি শিশুকে কেউ মন্দিরে সিঁড়িতে ফেলে রেখে দিয়ে চলে গেছিল। কেউ তার দায়িত্ব নিতে চাইছিলোনা দেখে পর্ণাই এগিয়ে আসে তাকে অনাথ আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করার জন্য। কিন্তু সদ্যজাত শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মায়ার বাঁধনে বেঁধে গেছিল পর্ণা। তার নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শ পর্ণাকে নিয়ে যায় তার মাতৃত্বের অপ্রাপ্তির থেকে মাতৃত্বের প্রাপ্তির দিকে।
পর্ণাই এই শিশুটির নাম দেয় পালক। আর শিশুটিকে নিয়ে আসে তাদের বাড়িতে। এই সময় দীপ্ত এক সপ্তাহের জন্য বিশেষ কাজে বাইরে গেছিল। শ্বশুর বাড়িতে সবাই অরাজি হলেও পর্ণা পলককে কাছ ছাড়া করলনা। তার আশা ছিল যে দীপ্ত পালককে দেখে খুব খুশি হবে আর ধীরে ধীরে সে আর পর্ণা সকলকে রাজি করিয়ে নেবে শিশুটিকে এডপ্ট করার জন্য।
দীপ্ত পুরো ব্যাপারটা ফোনে জেনেছিল কিন্তু বাড়ি এসেই সে পর পলককে পর্ণার কোল থেকে তুলে নিয়ে বাইরে দিয়ে আসতে যাচ্ছিল। পর্ণা সঙ্গে সঙ্গে দীপ্তকে বাধা দেওয়ায় সে পর্ণার গায়ে হাত তুলে দিয়েছিল। পর্ণা এই অপমান সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষনাৎ পালক কে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সে ভেবেছিল দীপ্তর রাগ কমলে তাকে বোঝাবে কিন্তু সেই সুযোগই দীপ্ত আর তাকে দেয়নি। তার আগে পর্ণা কে সে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছিল।
দীপ্ত সঙ্গে ডিভোর্সের পর পর্ণা নতুন করে পথ চলা শুরু করে তার মেয়ে পালক কে নিয়ে। পালকের এক বছরের জন্মদিনে ওর মত ছোট ছোট শিশুকে নিয়ে শুরু করে ‘ আস্থা ’যার পথচলার আজকে পঞ্চম দিবস। যদিও পালক কে পর্ণা লেগালি এডপ্ট করেছে। আর মানুষ করছে তারই আদর্শে। যাতে সে পর্ণার অবর্তমানে ‘আস্থা ’র হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।।