আহ! পুরান ঢাকা মানেই সুস্বাদু আর লোভনীয় সব খাবার

পুরান ঢাকার খাবারের নাম শুনলে জিভে জল আসবেই। কত পদের যে সুস্বাদু খাবার, কত যে বাহারি নাম! সেই স্বাদ নিতে নানা জায়গা থেকে ভোজনপ্রেমীরা ভিড় জমান পুরান ঢাকার খাবারের হোটেলগুলোতে।

আহ! পুরান ঢাকা মানেই সুস্বাদু আর লোভনীয় সব খাবার
আহ! পুরান ঢাকা মানেই সুস্বাদু আর লোভনীয় সব খাবার

আর এই সুনাম কিন্তু অল্পদিনের নয়। দীর্ঘ ৪০০ বছরের অধিক সময় ধরে ঐতিহ্য পুরান ঢাকার। পুরান ঢাকা মানেই সেরা আর বিখ্যাত খাবারের সমারোহ। তাই আজকে আমি আপনাদের কাছে পুরান ঢাকার তেমনই ৫টি খাবার ও তার ইতিহাস নিয়ে হাজির হয়েছি।


১. হাজির বিরিয়ানি

 

Image Source: bdnews24.com


মোঘল দরবারের শাহী খাবারের মধ্যে স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয় ছিল বিরিয়ানি। এই বিরিয়ানি পূর্বদেশীয় মানুষের কাছেও পেয়েছে সমান জনপ্রিয়তা।


ঐতিহ্যবাহী এই খাবারকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে পুরান ঢাকার হাজির বিরিয়ানি। কাজী আলাউদ্দিন রোডে নেমে একটু সামনেই দেখা পাওয়া যাবে সাইনবোর্ড ছাড়া হাজির বিরিয়ানির প্রধান শাখা'র।


১৯৩৯ সালে হাজী মোহাম্মদ হোসেন এই বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু করেন। স্বাদ ও গন্ধ বাজারের অন্য বিরিয়ানির তুলনায় আলাদা হওয়াও অল্পদিনেই এই বিরিয়ানি জনপ্রিয় হয়।


ফলস্বরূপ চাহিদাও বাড়তে থাকে। তখনকার সেই বিরিয়ানিই পরিচিতি পায় হাজির বিরিয়ানি নামে। হাজী মোহাম্মদ হোসেনের পরে এই ব্যবসা শুরু করেন তার ছেলে হাজী গোলাম হোসেন। বর্তমানে নাতি হাজী মোহাম্মদ সাহেদ হোসেন এই ব্যবসা দেখাশোনা করে যাচ্ছেন।


হাজীর বিরিয়ানির দোকানে বিক্রি হয় শুধু কাচ্চি বিরিয়ানি। হাজীর বিরিয়ানি মূল বৈশিষ্ট্য হল- গরুর মাংসের পরিবর্তে শুধু খাসির মাংস এবং ঘি/বাটার এর পরিবর্তে সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়।


শোনা যায়, শুরু থেকেই সম্পূর্ণ দেশীয় সব মশলা ব্যবহার করা হয় বলে আজও প্রায় একই রকম এবং অপরিবর্তিত আছে এই বিরিয়ানির স্বাদ ও গন্ধ।


বর্তমানে হাজীর বিরিয়ানির হাফ প্লেটের দাম ৮০ টাকা। ফুল প্লেট ১৬০ টাকা। পুরান ঢাকা ছাড়াও হাজীর বিরিয়ানির দু'টি শাখা রয়েছে মতিঝিল বিমান অফিস ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়।

রাজশাহীর ৫টি জনপ্রিয় খাবারের সন্ধান

সিলেটের লোভনীয় ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় ৫টি খাবার

জিভে জল আসার মতো খুলনার বিখ্যাত ৫টি খাবার

চট্টগ্রামের সেরা ৫টি রেস্টুরেন্টের লোভনীয় সব খাবার

দিল্লির লোভনীয় সেরা ৫টি বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় খাবার

কেরালার বিখ্যাত সুস্বাদু খাবারগুলি দেখলেই মুখে জল আসবে


২. বিউটি লাচ্ছি

 

Image Source: kalerkantho.com


৫২ বাজার ৫৩ গলির প্রাচীন শহর ঢাকা। ৪০০ বছরের পুরোনা এ শহরের অলিগলিতে বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠেছে নামিদামি নানা হোটেল-রেস্তোরাঁ।


এসব খাবারের দোকানের কোনো কোনোটির বয়স প্রায় শত বছর। এমনই একটি পুরোনা ঢাকার পুরোনো প্রতিষ্ঠান ‘বিউটি লাচ্ছি’। যারা আজও সুনামের সঙ্গে ধরে রেখেছে তাদের ব্যবসায়িক ঐতিহ্য।


বন্ধুরা আপনি চাইলে সহজেই ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহ্যবাহী ‘বিউটি লাচ্ছি’তে। স্বাদ নিতে পারবেন ঐতিহ্যবাহী লাচ্ছির।


আর খরচের কথা ভাবছেন তা আপনার নাগালের মাঝে। স্পেশাল লাচ্ছি ৪০ টাকা, এবং নরমাল লাচ্ছি ৩০ টাকা।


সময়টা ১৯২২ সাল। শুরু করেছিলেন লেবুর শরবত দিয়ে। পরে যুক্ত করেন লাচ্ছি। এরপর ফালুদা। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আবদুল আজিজকে। দোকানের নাম রাখেন বিউটি লাচ্ছি ও ফালুদা।


এক নামে এখন সবাই চেনে এই দোকান। আবদুল আজিজের হাত ধরে ব্যবসায় হাল ধরেন ছেলে গফফার মিয়া। ১৫ বছর আগে মারা যান গফফার মিয়া। তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে দোকানের হাল ধরেছেন ছেলে জাবেদ হোসেন।


বিউটি লাচ্ছির এই দোকান পুরান ঢাকার জনসন রোডে। তার পাশেই ঢাকার আদালতপাড়া। রোজ সকাল ৯টায় দোকান খোলে। বন্ধ হয় রাত ১২টায়। সব সময় ভিড় লেগেই থাকে।


৩. শমশের আলীর ভুনা খিচুড়ি

 

Image Source: pinterest.com


ঝুম বর্ষা কিংবা হিমশীতল আবহাওয়ায় খিচুড়ির জুড়ি নেই। সঙ্গে যদি হয় খাসির ঝাল মাংস, আর সেই খিচুড়ি যদি হয় পুরান ঢাকার শমশের আলীর ভুনা খিচুড়ি, তবে তো সোনায় সোহাগা। সত্যি বলতে বলতেই জেভে জল এসে যাচ্ছে।


শীত এবং বর্ষায় এই খিচুড়ি বেশি জমলেও অন্য ঋতুতেও কিন্তু কম যায় না! আর পুরান ঢাকার প্রতিটি খাবারেই রয়েছে ঐতিহ্যের ছোঁয়া।


ফাস্টফুড, জাঙ্কফুডের ভিড়ে অনেক খাবার বিলুপ্ত হলেও এখনো রয়েছে, পোলাও, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, কাবার, পুরির স্বতন্ত্র স্বাদের কিছু খাবার।


হাজির বিরিয়ানি, নান্নার বিরিয়ানির মতো, শমশের আলীর ভুনা খিচুড়িও অন্যর মাত্রার একটি খাবার। পুরান ঢাকার বংশালে অবস্থিত শমশের আলীর ভুনা খিচুড়ি।


ভোজন রসিকদের কাছে খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। পুরান ঢাকার জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খিচুড়ির স্বাদ যদি কেউ নিতে চান তাহলে অবশ্যই একবার শমশের আলীর ভুনা খিচুড়ি রেস্তোরাঁ থেকে ঘুরে আসা উচিত।


এই খিচুড়ির বিশেষত্ব হলো এটি মুঘল আমলের রান্নার পদ্ধতিতে করা হয়। আর চিনি গুড়া পোলাও চাল দিয়ে রান্না করা হয় এই খিচুড়ি।


সঙ্গে যদি ঝালঝাল খাসির মাংসের লেগ পিস তাহলে তো আর কথাই নেই। আর এই সুস্বাদু খাবারটি আপনি ৩২০ টাকায় পাবেন।


৪. মাখন বিরিয়ানি

 

Image Source: YouTube


পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর মধ্যে মাখন বিরিয়ানি অন্যতম। এটি খেতেও যেমন সুস্বাদু তেমনি দামেও সস্তা।


এই বিরিয়ানির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা কোনো ক্রেতাকে ফেরায় না। ক্রেতারা যে যে রকম টাকা নিয়ে আসে, তাকে সে পরিমাণে বিরিয়ানি দেওয়া হয়। এমনকি পথশিশু ও হতদরিদ্রদের জন্য সর্বনিম্ন ২০ টাকারও বিরিয়ানি বিক্রি করে।


৭০ বছরের পুরোনো মাখনের বিরিয়ানির প্রতিষ্ঠাতা হাজি মাখন, যিনি শুরুর দিকে এক আনা করে প্রতি প্লেট বিরিয়ানি বিক্রি করতেন।


কালের বিবর্তনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আজ দাম বেড়ে হয়েছে ৮০ টাকা। এর ফুল প্লেটের দাম ১২০ টাকা।


ঈদ ছাড়া মাখন বিরিয়ানি হাউস বন্ধ থাকে শুধু শুক্রবার বিকেল বেলা। এ ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে মাখন বিরিয়ানি হাউস।


যেভাবে যাবেন : রাজধানীর গুলিস্তান থেকে সাভার পরিবহন, ঠিকানা পরিবহন, তা ছাড়া যেকোনো সিটি বাসে করে রায় সাহেব বাজার যাবেন। সেখান থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলে যেতে পারবেন নাসির উদ্দিন সরদদার সড়কের মাখন বিরিয়ানি হাউস।


৫. বাকরখানি

 

Image Source: travelbd.xyz


বিকল্প নাম: শুখা

প্রকার: রুটি

উৎপত্তি স্থল: পুরান ঢাকা এবং সিলেট, বাংলাদেশ

মূল উপকরণ: ময়দা , ঘি , দুধ, চিনি


বাকরখানি মুগল আমলের ঐতিহ্যবাহী একটি রুটি। অতি সম্প্রতি পর্যন্ত ঢাকা শহরে এটি একটি বিচিত্র খাদ্য পণ্য ছিল।


মুগল আমলের খাদ্য পণ্যের মধ্য এটি বর্তমান সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে এবং এখন বাংলাদেশের অন্যান্য শহরেও দেখা যায়।


মানুষজন তাদের সকালের নাস্তা হিসেবে কোর্মা, শিখ কাবাব এবং মিষ্টির সাথে বাকরখানি খায়। এ রুটি বা বিস্কুটের  উৎপত্তি আফগানিস্তান বা এর বাহিরে। আফগানিস্তানে এটি এখনও পরিলক্ষিত হয়।


ঐতিহ্যগতভাবে নবাবী আমলের শেষের দিকে প্রভাবশালী জমিদার আগা বাকর খানের নামনুসারে বাখরখানি নামটির উৎপত্তি। এটি একটি গোলাকৃতির রুটি যা তৈরি করা হয় প্রধানত গম, দুধ, লবণ, ডালডা, ঘি, পনির এবং খামির দিয়ে।


বাকরখানির ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে মুগ্ধ হয়ে কবি প্রতুল মুখোপাধ্যায় তার কবিতায় লিখেছেন -


আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি

বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।

ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা

হাতের কলম জনম দুঃখী তাকে বেচো না।


তো বন্ধুরা বুঝতেই পারছেন পুরান ঢাকার এই খাবারটি কতটা বিখ্যাত!


কোথায় পাবেন?

বাকরখানি পাওয়া যায় পুরান ঢাকাতেই। পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল পার হয়ে নাজিমুদ্দিন রোডের দু-পাশে পার পর অনেকগুলো দোকান আছে। তাছাড়া লক্ষ্মীবাজার, লালবাগ, তাঁতিবাজার রয়েছে বাকরখানির দোকানগুলো।


এই ছিলো পুরান ঢাকার সুস্বাদু এবং জিভে জল আসার মতো কিছু খাবার। সুযোগ পেলে মিস করবেন না কিন্তু। আপনাদের মঙ্গলকামনায় আজ এখানেই শেষ করছি। ধন্যবাদ।


আরও পড়ুনঃ ভোজন রসিকদের জন্য রাজশাহীর ৫টি জনপ্রিয় খাবারের সন্ধান