এক নজরে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম দুর্দান্ত ভ্রমণ

হাওরের সৌন্দর্য মন্ডিত প্রকৃতির অপরূপ লীলা দেখতে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম হতে পারে আদশ জায়গা। বিনোদন পিপাসু মানুষের জন্য হতে পারে একটি উত্তম জায়গা।

এক নজরে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম দুর্দান্ত ভ্রমণ
এক নজরে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম দুর্দান্ত ভ্রমণ


বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, "বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও"। অর্থাৎ, বর্ষাকালে নৌকায় আর শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে চলা। বর্ষায় হাওর ভ্রমণ খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।


চারপাশের সমুদ্র সমান জলরাশির মেলা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে এখানে বেড়াতে। একসময়, শুধু বর্ষায় চলাচল উপযোগী থাকলেও এখন বছরের যেকোন সময়ই আসা-যাওয়া করা যায়।


কেননা, ২০২০ সাল থেকে কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলায় সারা বছর চলাচল উপযোগী উচুঁ রাস্তা তৈরী হয়েছে ,যা হাওরের বিস্ময় হিসেবে ইতোমধ্যে দেশে পরিচিত লাভ করেছে। বিনোদনপিপাসু মানুষের জন্য হতে পারে এটি একটি উত্তমতম স্থান।


সড়কটির অবস্থান কোথায়?

কিশোরগঞ্জের হাওর সমৃদ্ধ তিন উপজেলা ইটনা ,মিঠামইন আর অষ্টগ্রামকে সংযুক্ত করার জন্য ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন, ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি চলাচলের জন্য খুলে দেন।


৪৭ কিলোমিটার উঁচু এবং ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি সারাবছর চলাচল উপযোগী। এই সড়কে ২২ টি সেতু, ১০৪ টি কালভার্ট রয়েছে। শীত, গ্রীষ্ম এমনকি বর্ষায় এর অপরূপ সৌন্দর্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। 


কিভাবে যাবেন?

সড়কপথে বিভিন্ন জায়গা থেকেই এখানে যাওয়া যায়। ঢাকার গুলিস্তান থেকে সরাসরি বাসে কিশোরগঞ্জের চামড়াবন্দর আসতে পারেন, এখান থেকে প্রতি ২ ঘন্টা পরপর ট্রলার ছাড়ে মিঠামইনের উদ্দেশ্যে ।


এছাড়া, ঢাকার গুলিস্তান থেকে সরাসরি বাসে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর লঞ্চঘাট চলে যেতে পারবেন, সেখান থেকে লঞ্চে মিঠামইন যেতে পারবেন। এছাড়াও,  কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখোলা হাওরে এসে ফেরী পার হতে হবে, তারপর সিএনজি বা অটোরিকশা দিয়ে মিঠামইন যেতে পারেন।


যারা ,ঢাকা ছাড়া অন্য কোন স্থান থেকে যেতে চান, তারা কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়বেন, ওখান থেকে সিএনজিতে সরাসরি চলে যেতে পারবেন ,চামড়াবন্দর বা বালিখোলা হাওরে। যারা নৌভ্রমণ পছন্দ করেন তারা কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর ঘাট থেকে সরাসরি লঞ্চযোগেও মিঠামইন যেতে পারেন।


সেক্ষেত্রে সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘন্টার মত , চামড়াবন্দর বা বালিখোলা হাওর দিয়ে যেতে সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘন্টা। মিঠামইন নেমে হেঁটেই যেতে পারবেন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়কে, অথবা অটোরিকশাতেও যেতে পারবেন ।


এছাড়া, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে লঞ্চযোগে অষ্টগ্রাম যেতে পারেন। সেখান থেকে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক ধরে বালিখোলা হাওর দিয়ে কিশোরগঞ্জে ফিরে আসতে পারবেন। আসার পথে অবশ্যই ইটনা ঘুরে আসবেন । কিশোরগঞ্জের এই সড়কদ্বীপে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে জুলাই থেকে অক্টোবর মাস।


ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম হাওরে গেলে কমপক্ষে একদিন থাকার নিয়ত করে যাবেন, এতে করে সমস্ত সৌন্দর্য অবলোকন করতে সুবিধে হয়।


যাত্রাপথের সৌন্দর্যঃ-

কিশোরগঞ্জ বাংলাদেশের একটি প্রাচীন জেলা। এই জেলার ওপর দিয়েই আপনাকে চামড়াবন্দর যেতে হবে। যাওয়ার পথেই পাবেন বিখ্যাত শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান এবং পাগলা মসজিদ।


তাছাড়া, প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ মেডিক্যাল কলেজ ,জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজও পড়বে যাত্রাপথে। নদীপথে যেতে যেতে উপভোগ করতে পারেন স্রষ্টার গড়া বিভিন্ন নিদর্শন, এতে করে আপনার মন ভরার পাশাপাশি স্রষ্টার মহানুভবতাও মন কাড়তে বাধ্য করবে আপনাকে। 


কোথায় খাবেন?

মিঠামইন, অষ্টগ্রাম বাজারে মোটামুটি মানের বেশ কয়েকটা খাবার হোটেল আছে ,যেখানে বাঙ্গালী খাবার যেমন- মাছ-মাংস, মুরগীর বিভিন্ন রেসিপি, ভর্তা-ভাজিসহ প্রায় সব জিনিসই পাবেন।


যারা ফাস্টফুড পছন্দ করেন তাদের জন্য মিঠামইন বাজারে একমাত্র কাঁচা লংকা হোটেলে যাওয়া লাগবে। অষ্টগ্রাম গেলে অবশ্যই তাঁদের জনপ্রিয় মহিষের দুধ দিয়ে তৈরী পনির খেতে ভুলবেন না। 


কোথায় থাকবেন?

মিঠামইন এবং অষ্টগ্রামের সরকারি ডাকবাংলো অথবা মিঠামইনের স্থানীয় কিছু হোটেল আছে। মিঠামইনের বিভিন্ন হোটেলে এক রাতের জন্য ভাড়া নিবে সর্বোচ্চ পাঁচশ থেকে ছয়শত টাকা।


এছাড়াও, কিশোরগঞ্জ শহরে বেশকিছু মানসম্পন্ন হোটেল পাবেন রাত্রী যাপনের জন্য।


দর্শনীয় স্থানঃ-

এই সড়কের আশেপাশে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, অষ্টগ্রামের কুতুবশাহ মসজিদ এবং দরগাহ শরীফ। প্রায় তিন শতাধিক বছর আগে তৈরী এই মসজিদ এই অঞ্চলের প্রথম ইসলামের সূতিকাগার।


এছাড়াও, রয়েছে অষ্টগ্রাম সরকারি কলেজ, বিভিন্ন স্কুল ও মসজিদ। রয়েছে ,প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ সেতুসহ নানা স্থাপনা। মিঠামইন উপজেলায় আসলে পাবেন প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ বাসভবন ,ওনার পিতা-মাতার স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন এবং পারিবারিক কবরস্থান।


তাছাড়া, মনোরম হাওরের সৌন্দর্য আপনার মন জুড়াতে যথেষ্ট । হাওর থেকে নৌকায় করে ঘুরে আসতে পারেন আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায়। চাইলে যেতে পারেন নিকলীর হাওরে যেখানে গেলে সোয়াম্প ফরেস্টের কিছুটা ঝলক দেখতে পারবেন।


স্থানীয় ঐতিহ্যঃ-

কিশোরগঞ্জের তিন হাওর উপজেলা সাধারণত মহিষ বা ঘোড়ার দৌড়ের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল। মিঠামইন উপজেলার স্থানীয় ক্লাব মাঠে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবারে সাপ্তাহিক বাজার বসে।


এই বাজার নিয়ে স্থানীয় এবং আগত দর্শনার্থীদের ব্যাপক উৎসাহ এবং উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। হাট শুরুর আহে থেকেই বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের পসরা নিয়ে হাজির হয় এখানে। স্থানীয় লোকজনও তাদের সপ্তাহের নানা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সদাই করে এখান থেকেই।


বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিস যেমন- মাটির তৈজসপত্র, কাসা-পিতলের বিভিন্ন হাঁড়ি-পাতিল, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নানা ধরনের খাদ্যপণ্য, নানা ধরনের সবজি এবং ফলমূল সহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র এখানে পাওয়া যায়। এদিন পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজনও  হয়ে থাকে।


তাদের আরেকটি ঐতিহাসিক উৎসব হচ্ছে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। মিঠামইন থানা পুলিশের পুকুরে প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর এই মাছ ধরার উৎসব হয় এবং বিজয়ীকে বেশ ভালো পুরস্কার দেওয়া হয়। এছাড়াও একসময় এইসব অঞ্চলে মহিষের গাড়ি দেখা গেলেও বর্তমানে তা কমে আসছে।


শুকনো মৌসুমে স্থানীয়দের মাঝে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলার ধুম পড়ে। গ্রাম বাংলায় কখনোই দর্শকের অভাব হয় না এসব ফুটবল ম্যাচে, যেটা জাতীয় বা লীগ পর্যায়ে প্রায় দেখায় যায় না।


স্থানীয়দের জীবন-মানঃ-

হাওরাঞ্চলের মানুষজন সাধারণত সহজ-সরল এবং নির্লোভ হয়ে থাকে। তাদের, খুব অল্পতে তুষ্ট এবং চাহিদাও থাকে সীমিত। শুকনো মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত পণ্য এবং শাকসবজি উৎপাদনে তারা ব্যস্ত থাকে।


বর্ষায় যখন পুরো হাওর জলমগ্ন হয়ে পড়ে তখন ,নৌকা চালানে এবং মাছ ধরার মাধ্যমে তারা জীবিকা সংস্থানের চেষ্টা করে থাকে। এসব অঞ্চলে খুব কম চাকুরীজীবি থাকে ,এবং অন্যান্য পেশায়ও নিয়োজিত কর্মী কম। তবে ,পর্যটকদের সাথে তাঁদের আন্তরিকতা এবং বিনয়ী ভাব যে কাউকে মুগ্ধ করবে।


স্থানীয়দের কাছে পর্যটক দেবতাসমান শ্রদ্ধার পাত্র এবং তাদের আচার-ব্যবহারও খুবই কোমল। এসব অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা সবসময়ই অটুট থাকে এবং সবধরনের অন্যায় কাজ থেকে মুক্ত বলা চলে।


সতর্কতা-

হাওরের বিস্তৃত জলাশয় যেমনি সুন্দর তেমনি ভয়ংকর। গভীর জলরাশি আর জেগে উঠা আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ের কারনে হাওর অঞ্চল বরাবরই ভয়ের কারন। সাঁতার জানা না থাকলে হাওরের পানিতে না নামাই শ্রেয়।


একান্ত প্রয়োজনে নামতে চাইলে সাথে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট নিয়ে নামবেন। কখনোই, নৌকায় বেশি মানুষ উঠবেন না। নৌকায় অহেতুক লাফালাফি করবেন না এবং নৌকার যেকোন একপাশ সরে আসবেন না ,এতে করে নৌকাডুবির আশঙ্কা থাকে। 


নৌকা ভাড়া করার সময় দামদর করে নিবেন ,এবং ছাউনি সমৃদ্ধ নৌকা নেওয়ার চেষ্টা করবেন ,এতে করে মাথায় রোদ লাগবে না। মোটরসাইকেল নিয়ে গেলে সাবধানে চালাবেন এবং মাথায় হেলমট ও প্রয়োজনীয় গার্ড সঙ্গে রাখবেন। মনে রাখবেন, একটি দূর্ঘটনা, সারা জীবনের কান্না।

সবার যাত্রা শুভ হোক।