কনডাক্ট ডিজঅর্ডার: দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন এবং আপনার শিশুকে বাঁচান
অনেক বাবা-মা জানেনই না যে তাঁদের সন্তান কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। এই অসচেতনতার কারণে পরিবারের সদস্যরা সেই সন্তানটি কে বেয়াড়া বা খারাপ সন্তান হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং চিকিৎসার আওতায় আনেন না। চলুন আজ কনডাক্ট ডিজঅর্ডার সম্পর্কে জেনে আসি

কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত কিশোর-কিশোরীকে সুচিকিৎসা না দিলে পরে পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে পরিণত হতে পারে এবং তারা মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে পড়তে পারে। অথচ পরিবারের সদস্যরা প্রথম থেকেই সচেতন হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে এই শিশুরা সমাজের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। তাই কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডারের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানা সবার জন্যই জরুরি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কনডাক্ট ডিজঅর্ডার কাকে বলে?
কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বা আচরণ ব্যাধি হলো শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এক ধরনের পুনরাবৃত্তিমূলক এবং অবিচলিত আচরণ। যেখানে অন্যের অধিকার বা মৌলিক সামাজিক নিয়ম লঙ্ঘিত হয়।
আবার অন্যভাবেও বলা যায় যে, কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার একটি মারাত্মক আচরণ এবং মানসিক ব্যাধি যা শিশু এবং কিশোরদের মধ্যে হতে পারে। এই ব্যাধিযুক্ত একটি শিশু এক ধরনের বাধাজনক এবং সহিংস আচরণ প্রদর্শন করতে পারে এবং তার নিয়ম কানুন অনুসরণ করতে সমস্যা হতে পারে।
অর্থাৎ, শিশু অথবা বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরীর মধ্যে যখন মারাত্মক রকমের আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়, তখনই তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বলে৷ তবে এর মানে এই নয় যে, সন্তান দুরন্ত হলেই অথবা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মারপিট করলেই তার কনডাক্ট ডিজঅর্ডার আছে বলে ধরে নিতে হবে৷ একটি বাচ্চার দুরন্ত স্বভাব বা অবাধ্যতাকে তখনই কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বলে মনে করা হয়, যখন তা দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
কেন এই রোগটা হয়?
এ রোগের আসল কারণ এখনো অজানা। তবে গবেষকদের মতে, কিছু কিছু বিষয়ের কারণে শিশু-কিশোররা কনডাক্ট ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারে। যেমন;
১. শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন:
শিশু-কিশোরের ওপর বাবা-মায়ের বা অন্য অভিভাবকের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কনডাক্ট ডিজঅর্ডার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও মেয়ে শিশু বা কিশোরীদের ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী বা অন্য কারো দ্বারা যৌন নির্যাতন এ রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
২. মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা:
বাড়িতে অথবা স্কুলে ক্রমাগত শাস্তি যেমন; বকাবকি, মারধোর ইত্যাদির জন্য শিশু কিশোরদের মধ্যে একগুঁয়ে ভাব তৈরি হয়। তারা ধরে নেয় এটিই স্বাভাবিক এবং তাদের মধ্যে পাল্টা ব্যবহার ফিরিয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা জাগে। একে ট্রান্সজেনারেশনাল ট্রান্সমিশন অফ ভায়োলেন্স বলে। এভাবে তারা নৃশংস হয়ে পড়ে।
৩. মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ:
অনেক অভিভাবকই অত্যধিক আদরের কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস সন্তান চাওয়া মাত্রই তাদের হাতে তুলে দেন। ফলে কোনো জিনিসের মূল্য দিতে শেখে না এরা। তাই যখন এদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইচ্ছে পূরণ করতেও অভিভাবক অসমর্থ হন, তখন কনডাক্ট ডিজঅর্ডার দেখা দেয়।
৪. উগ্র আচরণ প্রত্যক্ষণ:
শিশু-কিশোররা অনুকরণপ্রিয়। তারা যা দেখে তাই শিখে। এটাকে বলে পর্যবেক্ষণমূলক শিক্ষা। তাই টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে কার্টুনের আক্রমণাত্মক দৃশ্য বারবার দেখলে এটি তার মনোজগতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব ফেলে। যা থেকে কনডাক্ট ডিজঅর্ডার হতে পারে।
৫. রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
নানা ধরনের মানসিক বৈকল্যের কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি), নানা রকম লার্নিং ডিজঅর্ডার (ডিসলেক্সিয়া), ডিপ্রেশন।
৬. জিনগত কারণ:
বংশগত মানসিক রোগের প্রভাব কিছু ক্ষেত্রে ঘটে।
৭. পরিবেশগত কারণ:
অস্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশ এবং দাম্পত্য কলহ এ রোগ হওয়ার জন্য দায়ী।
লক্ষণ:
গবেষকরা এই রোগের চারটি লক্ষণ এর কথা বলেন। যেমন;
১. আক্রমণাত্মক আচরণ:
আশপাশের মানুষকে শারীরিকভাবে আঘাত করে থাকে। অকারণেই ঝগড়া বা মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। যৌন নির্যাতন, যেমন ইভ টিজিং, শ্লীলতাহানি এবং ধর্ষণের চেষ্টা করে। পশুপাখির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করে থাকে।
২. ধ্বংসাত্মক আচরণ:
অন্যের সম্পত্তির ক্ষতি করা, জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা, কথার মাধ্যমে অন্যদের উত্যক্ত করা ইত্যাদি।
৩. নিয়ম ভাঙা:
কোনোরকম নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার থেকে কয়েকশো হাত দূরে থাকে এরা। নিয়ম ভাঙাটাই অভ্যাসের মধ্যে পড়ে যায়। অবাধ্যতা এবং অনমনীয় মনোভাব। মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এরা। খুব কমবয়সেই যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।
৪. মিথ্যাচারিতা:
কথায় কথায় অবলীলায় মিথ্যে বলা। দোকানপাট থেকে জিনিস চুরি করে থাকে। প্রতারণা করে কারো কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নেয় এরা।
এই রোগের চিকিৎসা কী?
১. কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি:
বিশ্বব্যাপী এ রোগের চিকিৎসায় রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। এর মূল লক্ষ্য হলো-
i. মনোযোগের ঘাটতি দূর করা।
ii. অতিরিক্ত চঞ্চলতা হ্রাস করা।
iii. লেখাপড়া তথা একাডেমিক পারফর্মেন্স বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
iv. বলা ও লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি।
v. রাগ ও আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ন্ত্রণ।
৬. নিজের কাজ নিজে করার সক্ষমতা বৃদ্ধি।
২. ফ্যামিলি থেরাপি:
বাচ্চা কথা শুনলে তাকে পুরস্কৃত করুন, কথা না শুনলে তাকে বঞ্চিত করুন, সুবিধা কমিয়ে দিন, শারীরিক নির্যাতন না করে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ইতিবাচক মানসিক চাপ অব্যাহত রাখুন।
৩. আবাসিক সুবিধা:
আক্রান্ত বাচ্চাকে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেয়া যেতে পারে, যেখানে পড়াশোনায় কড়াকড়ি বা চাপ বেশি থাকবে। সেই সাথে কিশোর-কিশোরীদের একটা সুশৃঙ্খল জীবনের মধ্যে অানবার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
৪. ঔষধ:
উগ্র অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ নিয়ন্ত্রণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঔষধ লাগে। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া আবশ্যক।
এই সমস্যার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হলো সহমর্মিতা। বিশেষ করে অভিভাবকদের এটি বুঝতে হবে যে, সব বাচ্চা একরকম হয় না। তাই আপনারা আপনাদের বাচ্চাদের খেয়াল রাখবেন।
আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সবসময় শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।