কম্পিউটারের আবিষ্কার ও ইতিহাসঃ এক ক্রান্তিকারী আবিষ্কার

কম্পিউটারকে সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বললে ভুল বলা হবে না। কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানি না এই যাদুর বাক্সের আবিষ্কারের ইতিহাস। এই লেখায় থাকছে কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস জানার চেষ্টা।

কম্পিউটারের আবিষ্কার ও ইতিহাসঃ এক ক্রান্তিকারী আবিষ্কার
কম্পিউটারের আবিষ্কার ও ইতিহাসঃ এক ক্রান্তিকারী আবিষ্কার


বর্তমান পৃথিবীতে সবাই অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের যুগে বসবাস করছে। আর এই যুগের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং ব্যবহৃত যন্ত্রটি হলো কম্পিউটার। বহুকাল ধরে বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে, অসংখ্যবার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক রূপ পেয়েছে এই যন্ত্রটি। প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আধুনিক কম্পিউটারে এসে পূর্ণতা পেয়েছে এবং পৃথিবীর পরিবর্তনে রেখেছে সবচেয়ে বড় ভূমিকা।


কম্পিউটার কি?

কম্পিউটার এমন একটি যন্ত্র যা নির্দিষ্ট কমান্ড অনুসরণ করে গাণিতিক বা গণনাসংক্রান্ত কাজ অতি দ্রুত ও নির্ভুলভাবে করতে পারে। Computer শব্দটি গ্রিক Compute থেকে এসেছে। Compute অর্থ হলো হিসেব বা গণনা করা। সে অনুযায়ী কম্পিউটার শব্দের অর্থ গণনাকারী যন্ত্র।


কিন্তু বর্তমানে কম্পিউটার শুধু গণনাই করে না, বরং অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এবং জটিল কাজ নির্ভুলভাবে করে। মোটকথা কম্পিউটার এমন এক যন্ত্র যা উপাত্ত গ্রহণ করে এবং তা বিশ্লেষণের পর উপস্থাপন করে।


কম্পিউটারের আবিষ্কার

কম্পিউটার রাতারাতি বা কয়েক বছরের চেষ্টায় আবিষ্কৃত হওয়া যন্ত্র নয়। এর পেছনে রয়েছে লম্বা ইতিহাস। তবে আমরা কম্পিউটার বলতে যে পূর্ণাঙ্গ যন্ত্রটি বুঝি তার প্রথম ধারণা দেন চার্লস ব্যাবেজ। প্রথম মেকানিক্যাল কম্পিউটার তিনিই তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে তার তৈরি ডিজাইন এবং যন্ত্রাংশের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক কম্পিউটার বানানো হয়।


আর সে কারণেই তাকে কম্পিউটারের জনক বলা হয়। আর তার সাথেই প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করেন লেডি অ্যাডা অগাস্টা। তবে পৃথিবীর প্রথম স্বয়ংক্রিয় গণনাযন্ত্র আবিষ্কার করেন হাওয়ার্ড এইকিন এবং আইবিএম, যেটির নাম ছিল Mark 1। আর পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ বা সফল কম্পিউটার ENIAC-1 তৈরি করেন ড. জন মাউসলি ১৯৪৬ সালে। তবে এরপর আরও অনেক পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকের উন্নত কম্পিউটার তৈরি হয়।


কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস

খ্রিস্টাব্দ গণনা শুরুর বহু আগে গণনাযন্ত্র উদ্ভাবনের বিভিন্ন প্রচেষ্টাকে কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস হিসেবে ধরা হয়। অ্যাবাকাস নামের যন্ত্রটিকে কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাসে প্রথম পদক্ষেপ ধরা হয়। এটি প্রায় ২৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে আবিষ্কৃত হয়। তবে এর বহু বছর পরে ৪৫০/৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে চীনে গণনা করার যন্ত্র হিসেবে অ্যাবাকাস তৈরি ও ব্যবহৃত হতো।


এর প্রায় হাজার বছর বাদে ১৬৪২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন, যেটির নাম দেওয়া হয়েছিল প্যাসকেলাইন। ১৬৭১ সালে জার্মান গণিতবিদ ভন লিবনিজ প্যাসকেলাইনের ভিত্তিতেই আরও উন্নত গণনাযন্ত্র তৈরি করেন, যেটির নাম দেন রেকোনার। এই যন্ত্রটিকে আরেকটু উন্নত করেন টমাস দ্য কোমার।


১৮২১ সালে ইংরেজ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজের হাত ধরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে তার অ্যানালাইটিক্যাল ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এর পূর্বে আবিষ্কৃত সব যন্ত্রে শুধু অংকভিত্তিক কাজ করা যেত। কিন্তু তার উদ্ভাবিত যন্ত্রে তথ্য নিয়েও কাজ করা যেত। তবে যন্ত্রটি চালাতে হতো পাঞ্চকার্ড ব্যবহার করে এবং একটি পাঞ্চকার্ড মাত্র একবারই ব্যবহার করা যেত। এ ছাড়া আধুনিক কম্পিউটারের প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই তার অ্যানালাইটিক্যাল ইঞ্জিনে বিদ্যমান ছিল।


এর কয়েক বছর পরে ১৮৯০ সালে মার্কিন ইঞ্জিনিয়ার হারম্যান হলোরিথ ব্যাবেজের যন্ত্রের সাথে একটি টেবুলেটর সংযুক্ত করে পাঞ্চকার্ড ব্যবহারের জটিলতা কমিয়ে দেন। তৈরি করেন একটি টেবুলেটিং মেশিন কোম্পানি, যেটি পরবর্তীতে আইবিএম নামে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কম্পিউটার কোম্পানি হিসেবে পরিচিতি পায়।


এর প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ১৯৪৬ সালে জন মাউসলি ও প্রেসপার একার্ট তৈরি করেন প্রথম ইলেকট্রনিক্স ডিজিটাল কম্পিউটার, যেটির নাম রাখা হয় এনিয়াক(ENIAC)। এটি পূর্বের কম্পিউটারগুলোর চেয়ে দ্রুত গতির হলেও আকারে ছিল প্রকাণ্ড এবং কাজ করতে করতে প্রচণ্ড গরম হয়ে যেত। তাই এটিতে কি করে আরও পরিবর্তন আনা যায়,  তা নিয়ে চলেছিল ব্যাপক গবেষণা। অবশেষে ১৯৪৬ সালের শেষদিকে হাওয়ার্ড এইকিন এনিয়াকের চেয়ে আকারে ছোট ও আরেকটু বেশি গতিসম্পন্ন কম্পিউটার তৈরি করলেন এবং নাম দিলেন মার্ক ওয়ান(Mark-1)। তবে এর খরচ এত বেশি ছিল যে একটির খরচ দিয়ে আধুনিক যুগে একটি কোম্পানি বানিয়ে ফেলা সম্ভব। 


১৯৪৮ সালে ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের পরে সূচিত হলো একটি নতুন অধ্যায়ের। ১৯৫৮ সালে জ্যাক কিলবি'র সিলিকন চিপ আবিষ্কার তাতে নতুন মাত্রা যোগ করলো। বস্তুত আইসি চিপের আবিষ্কার পৃথিবীর জন্য অনেক বড় একটি চমক ছিল। ১৯৭১ সালে আইসি চিপের সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইনটেল কর্পোরেশন তৈরি করে মাইক্রোপ্রসেসর, যার ওপর আধুনিক কম্পিউটার নির্ভরশীল।


১৯৮১ সালে বাজারে আসে আইবিএম কোম্পানির পার্সোনাল কম্পিউটার(পিসি)। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয় নি। রোমাঞ্চপ্রেমী মানুষ প্রযুক্তিক্ষেত্রে একের পর এক চমক সৃষ্টি করছে। যে কম্পিউটার স্থানান্তরযোগ্য ছিল না, এখন তা ল্যাপটপ, পামটপ, নোটবুক নামে মানুষের হাতে হাতে ঘুরছে। এমনকি মোবাইল ফোনেও সংযুক্ত করা হচ্ছে কম্পিউটারের সব বৈশিষ্ট্য।


সময়ের গতিপথ বদলকারী আবিষ্কার

সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি যে আবিষ্কারগুলো পৃথিবীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো কম্পিউটার। এই আবিষ্কার বিজ্ঞানে একটি অভূতপূর্ব সংযোজন, যার জন্য কৌতুহলী এবং মেধাবী মানুষ বছরের পর বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। আর তার ফলাফল আধুনিক পৃথিবীর মানুষ ভোগ করছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটারের ব্যবহার অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে। শিক্ষা, ব্যবসা, ব্যাংকিং, মার্কেটিং সবক্ষেত্রেই এখন কম্পিউটার ছাড়া কোনো কাজ হয় না।


চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা দেওয়া পর্যন্ত কম্পিউটারের ব্যবহার এখন হরহামেশাই হচ্ছে। কম্পিউটারের সাথে ইন্টারনেটের সংযোগ আমাদের জীবনযাপনের ধারাই বদলে দিয়েছে। এখন আর শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে সব কাজ করতে হয় না। অথচ কম্পিউটার আবিষ্কারের পূর্বে কিন্তু এমনটা ছিল না।


কম্পিউটারকে কাজে লাগিয়েই মানুষ মহাকাশে যাচ্ছে অহরহ। প্রতিদিন নতুন নতুন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী একটি ছোট্ট গ্রামের মতো মনে হওয়ার পেছনেও এই কম্পিউটারই ভূমিকা রেখেছে। অর্থাৎ কম্পিউটার আবিষ্কারের ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনধারার গতিপথই বদলে গেছে।


পৃথিবীর জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উপহার হলো কম্পিউটার। এটি ব্যবহারের ফলেই মানুষ ছাড়া মানুষের অন্যসব পরিচয় গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। কেননা কম্পিউটার কমান্ড দেখে কাজ করে, সেই কমান্ড কোন পরিচয়ের মানুষ দিলো সেটা বিবেচ্য নয়। অর্থাৎ এই প্রথম মানুষ তার পরিচয় শুধু মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। তাই কম্পিউটার একটি ক্রান্তিকারী আবিষ্কারই বটে।