কালোশশীর সন্ধানে - সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে চমৎকার একটি নভেলা
আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যাওয়ার আগে মীরাকে যদি বলে যেতে পারতাম, মীরা, গল্পের পুরোটা মিথ্যে নয়, পুরোটা গল্পও নয়। গল্পের মধ্যে লুকিয়ে আছে গল্পকারের প্রিয় সত্যিগুলো। সত্যিগুলো খোঁজার দায়িত্ত্ব আমি তোকে দিলাম। আমি জানি তুই পারবি।

তখন বসন্তের সকাল, হাতে সকালের পত্রিকাটা নিয়ে বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। পাখিগুলো আমগাছে বসে কোলাহল জুড়েছে খুব। আমি খবরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি একবারের জন্য। কোন ভাবনা নেই, একেবারে চিন্তাশূন্য সকাল যেন।
মনটা তবুও কেমন জানি ভারি হয়ে আছে। অনেকবার কারণ খুঁজার চেষ্টা করেও কোন হদিস করতে পারলুম না- কেনই বুক ভারী ভারী ঠেকছে। কি জানি বাপু বুড়ো বয়সে, কত রোগই না করে! তাই ততটা ভাবলুম না। পাখির গান, আর একটু পর পর বওয়া মৃদু হাওয়ায় নিজেকে এলিয়ে দিলাম।
আহা! এখন একটা ভায়োলিন বাজতো যদি কানের কাছে! একটা বিরহের সূরে ভরে যেত মন! তবুও বেশ ভালো ঠেকতো। তাতে কি! এইটুকু না পাওয়া নিয়েই সকালটা পার করে দেয়া যাবে। বারান্দায় মাটির টবে রাখা গোলাপগুলোতে একটা দোল খেলে গেলো ভারী বাতাস।
নাতিশীতোষ্ণ এ হাওয়া, ঠিক বুকে এসে জাপটে ধরলো। এবার একটু বেকায়দাই হলো, পেছন ঘুরে দেখি মীরা। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর চোখে এখন যে আমি একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি, এ বুঝতে অসুবিধে হলো না।
আমি অপরাধীর ন্যায় একটা মুঁচকি হাসি দিয়ে বললাম- "কি রে, মা? আরেক কাপ চা খাওয়াবি?" মুখের ভঙ্গিটা কোন এক অভিনেত্রীর মতো করে বললো, "উহু, তোমাকে কফি করে খাওয়াবো। এক্সপ্রেসো"।
- আচ্ছা রাগ করছিস কেনো? বুঝলাম না।
- তা কেন বুঝবে? বুড়ো হয়েছো আর এটুকো বুঝো না? এই বাতাসে বসে থাকলে তোমার অসুখ করবে! তারপর তোমাকে নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে হবে আমার!
- বসন্তের বাতাসে শরীরের কিছুই হবে না, বুঝলি? তুই যা, এক কাপ কফি নিয়ে আয় বরং। আর আসার সময়, আমার জন্য বুক শেলফ থেকে জীবনানন্দের একটা বই নিয়ে আসিস।
- বাবা, তুমি ভেতরে আসো। নইলে কফি তো পাবেই না, বরং আজকে রান্নাই করবো না।
- খাবার ফুডপ্যান্ডা থেকে অর্ডার করে দিচ্ছি। তোর আজকে রান্না করতে হবে না। তুই কফি আর বইটা দিয়ে যা।
- আমি পারবো না, ফুডপ্যান্ডা থেকে অর্ডার করে নাও।
- আরে...
- মনে রেখো, এবার অসুখ করলে আমি তোমার কাছেও আসবো। এই বলে দিলাম, হ্যাঁঁ!
- আরে চললি কোথায়? মীরা...
মীরা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো ভেতরে। মীরা আমার ছোট এবং একমাত্র মেয়ে। একটা ছেলেও আছে অবশ্য আমার। সে বড় হয়েছে, নিজের পরিবার হয়েছে, সে পরিবার নিয়ে হিটলারের দেশে ঘর করেছে। বুড়ো বাব আর বোন নিয়ে তার তেমন মাথাব্যাথা নেই।
আমাদেরও তাকে নিয়ে মাথা ব্যাথা হবার কথা না। যাইহোক, মীরা এবার ঢাবি থেকে হিস্ট্রিতে স্নাতক শেষ করলো। রেজাল্ট অবশ্য এখনো বেরোয়নি। রেজাল্ট বেরুলেই নাকি, হিস্ট্রি নিয়ে কি একটা রিসার্চ শুরু করবে। মেয়েটা হয়েছে একদম মায়ের মতো। মায়ের সব গুন পেয়েছে। আজ ওর মা বেঁচে থাকলে, হয়তো এতটা আনমনা হতো না।
বাকি মেয়েদের থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখে মীরা। ওর ধারণা, ওর পরিচিত বেশিরভাগই, না সব মেয়েই আধুনিকতার নামে উশৃংখলতায় মত্ত। তাছাড়া আজকালকার মেয়েরা নাকি সব ন্যাকা ষষ্ঠী! তাই ওদের ছায়াও মাড়ায় না।
বাসায়ই পড়ে থাকে সারাটাদিন, হয় বই নিয়ে অথবা ওর বাগানের ফুল নিয়ে। আমাকে সারাক্ষণ অভিযোগ করে, এই ফুল গাছটা মরে যাচ্ছে, ঐ গাছটার যত্ন হচ্ছে না। আমি বলি, "বাগানটা তো তোর, তাহলে আমাকে কেন এত বলছিস?"
বলে, "তোমার খেয়াল রাখতে হয় বলেই তো আমি গাছগুলোর দিকে মন দিতে পারিনা। তাই দোষ তো তোমারই!" আমি আর কিছু বলি না। শুধু তাকিয়ে থাকি, মা মরা মেয়েটার দিকে আর ভাবি, আমি কি ওর জন্য একজন বাবা হতে পেরেছি? ওর মায়ের শূন্যতা কি আমি পূরণ করতে পেরেছি? পারলেও কতটুকু?
সময় পেলে ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরুই। শীতকালে যাই পাহাড় দেখতে। আর গ্রীষ্মে, সমূদ্র কিংবা ঝর্ণার খোঁজে। আর সাধারণ দিনগুলোতে, আমরা বাসায়ই থাকি। রান্নার কাজটা মীরাই করে। আমি বলেছিলাম একজন বুয়া রাখি।
ও বলে, "আমি থাকতে বুয়া কেন রাখবে? আর বুয়ার রান্না কি তুমি খেতে পারবে? তাছাড়া সারাদিন তো বাসায়ই পড়ে থাকি। এইটুকু করতে পারবো না? বিয়ের পর যদি রান্না করতে না পারি, তাহলে কি বলবে ওরা? ওরা বলবে, "বাবার বাসা থেকে কিছু শিখেনি। তখন তো তোমারই বদনামি হবে!"
একটুবাদেই কি ভেবে, ফিরে এলো মীরা। হাতে একখানা চিঠি।
- ও হ্যাঁঁ, তোমার একটা চিঠি এসেছে। দিতেই ভুলে গেছি।
- কে পাঠিয়েছে?
- কোন একটা মান্তাশা।
মান্তাশা আবার কে? এই যুগে চিঠি! অবাক কান্ড বটে।
- কিন্তু আমার খানিকটা সন্দেহ হচ্ছে, এটা কেমন নাম!
- কেমন নাম আবার? মানুষের নাম।
- বাবা তুমি বুঝতে পারছো না? নামটা কেন জানি অবাঙ্গালি মনে হচ্ছে। আর একজন অবাঙ্গালি বাংলাতে তোমাকে চিঠি কেন লিখবে?
- মান্তাশা নামটা তোর কাছে অবাঙালি মনে হলেও, শব্দটা কিন্তু বাংলা। মান্তাশা হলো নারীর হাতের এক ধরণের স্বর্ণালংকার। আর, তুই কি করে নিশ্চিত হয়ে বলছিস চিঠি বাংলায় লিখেছে? ভেতরে তো ইংরেজিতেও লিখা থাকতে পারে। তুই কি এটা খুলেছিস?
- বাবা তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে! চিঠি কোন ভাষায় লেখা তা জানার জন্য কি ওটা খুলে পড়তে হয়? নাম ঠিকানা যে বাংলায় লিখেছে, তার পক্ষে বাংলায় চিঠি লেখা অসম্ভব কি? আচ্ছা বাদ দাও, আগে বলো কে এই মান্তাশা?
- নামটা এই প্রথম শুনছি। তবে কেন জানি পরিচিত মনে হচ্ছে ।
- আমারও মনে হচ্ছে কোথায় যেন শুনেছি অথবা পড়েছি। এক সেকেন্ড দাড়াও গুগল করি।
মা- ন- ত- সা, মানতাসা...
- কি পেলি?
- মানতাসা মিম, একজন মডেল!
- তাতে কি হয়েছে, অন্য কেউ থাকতে পারে না এ নামে!
- থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে আমার মনে পড়ছে না এ নামের কোন মেয়ে পরিচিত। তারচেয়ে বড় কথা তোমাকে লিখেছে চিঠি, অথচ তুমিই এ নামের ব্যাক্তিকে চিনো না। হুম... ভাববার বিষয়। বাবা, আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি এবং আমার ধারণা এটাই সঠিক।
- কি সিদ্ধান্ত?
- আমার ধারণা, নামটা কোন সাংকেতিক ভাষায় লেখা হয়েছে, যাতে বাকিরা চিনতে না পারে কিন্তু যাকে লেখা হয়েছে সে ঠিকই চিনতে পারবে। এটা, চিঠি এবং এর বিষয়বস্তুকে গোপন করার জন্য হতে পারে। কিন্তু কেন? তোমাকে কেউ একজন এতো গোপনীয়ভাবে কেন চিঠি লিখবে বাবা?
- কেন লিখবে?
- তুমি প্রেম করছো, বাবা?
- মীরা তোমার বয়স কত হলো?
- সামনের মাসেই ২১ হবে। কেন জিজ্ঞেস করলে?
- না এমনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমার বয়স ২১'র থেকে বেশ বেশি, আবার কখনো মনে হয় তুমি ১০/১২ বছরের পিচ্চি।
আমি ওর সাথে আর কথা বাড়ালাম না। জানি ওর ছেলেমানুষি যুক্তির কোন শেষ হবে না। তবে আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। নামটা অতি পরিচিত মনে হচ্ছে। বহুল উচ্চারিত শব্দটি যেন, কিন্তু মনে কেন পড়ছে না এটা কার নাম! আচ্ছা মীরা যেটা বললো, নামটা যদি সাংকেতিক ভাষায়ই লিখা হয়,তাহলে? হতে পারে।
আচ্ছা, একবার তাহলে চেষ্টা করেই দেখা যাক। সাংকেতিক ভাষা! আচ্ছা এটা কোন ক্রিপ্টোগ্রাফিক কোড নয়তো! যদি তাই হয়, তাহলে এটা হয়তো আসল নামের এ্যানাগ্রাম হতে পারে। আর এটা এ্যানগ্রাম হলে আমি হয়তো এটাও জানি, এই চিঠি কে লিখেছে।
এ্যানাগ্রামে লিখতে পারে এমন মানুষ তো একজনই আছে, আমাকে চিঠি লেখার মতো! তাহলে এটা সে? না না, এটা হতে পারেনা! এত বছর পর? আমাকে চিঠি লিখবে সে!
- এত কি ভাবছো বাবা?
- হ্যাঁঁ? ও হ্যাঁঁ। আচ্ছা মান্তাশার এ্যানাগ্রাম কি হয় দেখ তো!
- উমমম... মান- তা- শা, মা- ন্তা- শা, শা- মা- ন্তা। শামান্তা! এটা শামান্তা!
তাহলে এটাই সত্যি! শামান্তা আমাকে চিঠি লিখেছে! এত বছর পর, হঠাৎ কি ভেবে চিঠি লিখলো আমাকে! তার মানে আমাকে ভুলেনি। চোখ দিয়ে কেন জানি দু'ফোঁটা জল নাছোরবান্দার ন্যায় টপটপ করে পড়ল গায়ের পাঞ্জাবিটায়। কি লিখেছে সে! তর সইছে না আর।
চিঠির খামটা বেশ কয়েকবার পরখ করে নিলাম। একটা বাদামী বর্ণের অফসেট পেপারের খাম, বেশ মসৃণ। তার উপর ডান কোনায় একটা স্ট্যাম্প। আর মাঝ বরাবর একটি দাগ টেনে দু'পাশে ওয়েল জেল এ লেখা কিছু অক্ষর।
প্রেরকঃ মান্তাশা
৩/৪ ধানমন্ডি
প্রাপকঃ আহমেদ সাদ
৩৮/৩ সেগুনবাগিচা
এতক্ষণ মীরা চুপচাপ ছিল, আমাকে চিঠি খুলতে দেখে ও ঝুকে পড়লো চিঠির দিকে। "মীরা তুই যা কফি নিয়ে আয়, আমি দেখছি। ব্যাক্তিগত কিছুও তো হতে পারে। বাবার প্রাইভেসিতে নিশ্চয়ই তুই হস্তক্ষেপ করবি না!
"ও হ্যাঁঁ। দেখো তোমার চিঠি। আমি ভাইয়াকে বলে দেবো, তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে আর আমাদের এতদিন জানাওনি"। ভেংচি কেটে মীরা চলে গেল। মীরা যেতেই চিঠিটা খুললাম, অধীর আগ্রহে।
প্রিয় সাদ,
আশা করি ভালো এবং সুস্থ আছো। পত্রপাঠ নাতিবিলম্ব ল্যাবএইড, ধানমন্ডি এ চলে আসবে। আশা করি আমাকে চিনতে তোমার অসুবিধে হবে না।
বি.দ্র. অতি গুরুত্বপূর্ণ
ইতি
তোমার মান্তাশা
আমি হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলাম লেখাগুলোর দিকে। এত বছর পরে! কেনো হঠাৎ? এতবছর পর আমাদের সাক্ষাৎ হবে, কিন্তু হাসপাতালে? তবে কি খারাপ কিছু ঘটেছে? না না, ভালো ঠেকছে না কিছু। আমার এক্ষুণি যাওয়া দরকার হাসপাতালে।
- আমারও তাই মনে হয় আমাদের এখনই হসপিটালে যাওয়া উচিত।
- লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের চিঠি পড়া অপরাধ। তাছাড়া শুধু আমাকে যেতে বলা হয়েছে। আমরা- কেন বললি?
- স্যরি বাবা, আসলে কি করবো বলো। তোমাকে একটা মেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে, সেটা দেখার জন্য কৌতুহল দমাতেপারিনি। আর তুমি আমাকে বাসায় একা রেখে যাবে?
- এটা মোটেও ভালো কাজ করিসনি।
- আচ্ছা বাদ দাও। আমিও তোমার সাথে চলি? আমার ভদ্রমহিলাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমার ধারণা তিনি অসুস্থ আর শেষবারের মতো তোমাকে দেখতে চাইছে। তোমার দেরি করা উচিত হচ্ছে না বাবা। চলো যাই।
- বলছিস? তোকে নিয়ে যাবো এক শর্তে।
- কি শর্ত?
- চুপচাপ থাকবি। অন্তত হাসপাতালে গিয়ে একটাও কথা বলবি না, প্রয়োজন ছাড়া।
- ঠিক আছে। এখন চলো। আমি মতি চাচাকে ডাকছি।
আমি মোটামোটি নয়, বেশ ভালোই চিন্তায় পড়লুম। শামান্তা আমাকে হাসপাতালে কেন দেখা করতে বলেছে? তার মানে মীরার ধারণা ঠিকও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাকে কেন ডাকবে? খারাপ কিছু হয়েছে ওর সাথে! এত বছর পর কেনই বা আমাকে এভাবে হাসপাতালে ডাকবে! তার উপর নিজের নামটাও লিখেছে সাংকেতিক ভাবে।
কেন? একজন অসুস্থ মানুষ কেন এত ভেবে পড়ে নাম গোপন করে চিঠি লিখবে? আরেকটা সম্ভাবনাও অবশ্য আছে। অন্য কাউকে নিয়ে হয়তো হাসপাতালে এসেছে। কিন্তু কাকে নিয়ে? মাথায় প্রশ্নের জট খুলতে পারছি না। শ্বাস- প্রশ্বাস বেড়েই চলেছে।
আমাকে কখনো সে চিঠি লেখেনি, যার থেকে ভীষণরকম চিঠির আশা করতাম। সে প্রথমবার আমাকে লিখেছে, আমার আহ্লাদে আটখানা হওয়ার কথা। তবে হাসপাতাল! আমাকে কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না।
- বাবা তুৃমি এমন করছো কেন? কিছু হয়েছে? শামান্তা কে?
- শামান্তা!
- হ্যাঁঁ শামান্তা। শামান্তা কে বাবা?
- শামান্তা, আমার অতি কাছের কেউ ছিলো। যাকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে হারিয়েছিলাম। তারপর আর পাইনি, বলতে পারিস খুঁজিনি।
- কেন খুঁজনি?
- যে আপনি হারানোর জন্য বিদায় নেয়, তাকে কি আর খোঁজা যায়!
- আচ্ছা, মা জানতো? শামান্তার ব্যাপারে?
- জানতো বৈকি। হুমায়রাকে আমি প্রথমেই সব বলেছিলাম। তোর মা খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন। আমি সারাজীবন ওর শূন্যতা অনুভব করবো। আচ্ছা থাক সে কথা।
- এত বছর এই কথাটা তুমি আমাদের থেকে লুকিয়ে এসেছো!
- তো, কি বলতাম?
- না বাবা, আমি আসলে জানতে চাচ্ছি, তোমার লাভ স্টোরিটা।
- এখানে লাভ স্টোরি কোথায় পেলি?
- হয়েছে বাবা, আর ইয়ে করতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি প্রথমেই। এখন বলো। প্লীজ বাবা, আর লুকিয়ো না। আমি না তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড?
- হুহ....
বুক থেকে নিমিষেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে পড়লো, গলা- নাক চিরে। পঁয়ত্রিশ বছর আগের সেই স্বপ্নময় দিনগুলো যেন আবার স্মৃতির বারান্দায় মাথাচাড়া উঠছে। ধুকে ধুকে উকি দিচ্ছে আবছায়া দেয়ালের ওপার থেকে।
- বলছো না যে?
- কি বলবো?
- তুমি শামান্তাকে বিয়ে কেন করলে না? মানে, তোমাদের বিচ্ছেদ কীভাবে হলো?
- কে বলেছে আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে?
- তাহলে?
- আমাদের কখনো বিচ্ছেদ হওয়ার মতো সম্পর্ক তৈরী হয়নি।
- ঠিক বুঝলাম না।
- আচ্ছা আমাদের যদি সত্যি বিচ্ছেদ হতো, তাহলে এত বছর পর, আমার ঠিকানা জোগাড় করে আমাকে সে চিঠি লিখতো?
- সেটাও! আচ্ছা প্রথম থেকে বলো তো, কি হয়েছিলো তোমাদের?
- আমরা পৌঁছে গেছি। পরে বলবো তোকে, অদ্যপান্ত সব। এখন চল ভিতরে চল।
শামান্তার স্মৃতিকে দীর্ঘদিন কোন এক চার দেয়ালে বন্দি রেখেছিলাম, যাতে সে সারাক্ষণ অবাধ বিচরণ না করতে পারে। কারণ হৃদয় মমে তার উপস্থিতি আমাকে জাগতিক সকল ভাবনা থেকে পর করে দেয়। আমি তখন একাকিত্ত্বের রাজত্ত্বে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
তাই মানবীয় জীবন-যাপনের জন্য আমি তাকে বন্দি রেখেছিলাম, একান্তই নিজের করে। আজ সে ভীষণভাবে জেগে উঠেছে। তাকে আর বন্দি রাখা সম্ভব নয়। এখন শত- কোটিবছরে জমে থাকা কান্না, পাহাড়-সমূদ্রভেদ করে অনির্বাণ বর্ষণের জন্য উতলা হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি সে বর্ষণের অনুমতি দিতে পারছি না। কারন আমি এখন মানবীয় সমাজে বাস করি কিনা।
তার দিকে যতই পা বাড়াচ্ছি, প্রতি কদমেই হৃদয় বাধঁনহারা হতে চাইছে। হৃদযন্ত্র মুক্তি চাইছে। হাতুরিপেটার মত প্রতিটি শব্দেই সে জানাচ্ছে- আমি আর পার পারছি না। আমাকে মুক্তি দাও এবার। তবে মুক্তি তো তাকে দেয়া যাবে না। তাকে মুক্তি দেবার অধিকার আমার নেই।
মীরা রিসিপশনের দিকে এগুতেই আমার কেন জানি মনে হলো- আমি শুন্য খাচায় এসে উঠেছি। "হ্যাঁলৌ ম্যা'ম. কীভাবে সাহায্য করতে পারি?" " উম.. শামান্তা নামে কোন প্যাশেন্ট ভর্তি আছে কিনা একটু দেখুন তো।" শামান্তার নাম করতেই রিসিপশনিস্ট মেয়েটা চকিত হয়ে উঠলো যেন।
আগ্রহের সূরে জানতে চাইলো, " আপনি কে? আহমেদ সাদ এসেছে কি?"
আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমিই সাদ। মেয়েটা অবাক করে দিয়ে বললো, "স্যার আমি আসলে আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমি কৌতুহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম, "আমার জন্য অপেক্ষা কেনো?"
"কারন আপনার একটা পার্সেল আমার কাছে রেখে যাওয়া হয়েছে। আপনি এসেছেন এবার আমি আপনার পার্সেলটা আপনাকে বুঝিয়ে দিয়ে আমি দায়মুক্ত হতে পারবো।"
আমি দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলাম, "কিসের পার্সেল? আর কে রেখে গেছে?"
"কিসের পার্সেল সেটা তো আর আমি জানি না। রেখে গেছেন শামান্তা ম্যাম। আসলে তিনি আমাদের এখানে ৪ দিন ছিলেন। তিনিই যাওয়ার সময় এই পার্সেলটা রেখে যান, আর বলেন ওয়াসিম রেজা আসবে এটা নিতে। একমাত্র আপনাকেই দিতে বলেছে।"
- কি হয়েছিলো ওর সেটা বলতে পারেন?
- আমি বিস্তারিত জানি না তবে, এন্ট্রির সময় দেখেছিলাম কার্ডিয়াক ইঞ্জুরি। কার্ডিয়াক ইনজুরি। আমি একটা ধাক্কা মতন খেলাম। যদিও প্রথমেই ভেবেছিলাম কোন দুঃসংবাদ শুনতে হবে। তার মানে হৃদরোগে ভূগছে শামান্তা! এ রোগ তো মানুষকে দীর্ঘদিন পৃথিবীতে থাকতে দেয় না। বুঝতে পারলাম সকালে কেন বুক ভারী ঠেকছিলো।
- রিলিজের সময় কি, সে সম্পুর্ণ সুস্থ্য ছিলো?
- তেমনই তো দেখলাম।
- আচ্ছা কত নাম্বার রুমে ছিলেন তিনি?
- ২৬৬ নাম্বার স্যার
- যদি কিছু মনে না করেন আমি একটু রুমটা দেখতে চাই।
- ঠিক আছে স্যার। আমি বলে দিচ্ছি।
আমি বক্সটার দিকে তাকিয়ে আছি। গিফট পেপারে মোড়া 10 ইঞ্চি বাই 10 ইঞ্চি সাইজের একটা বক্স। কি থাকতে পারে এর মধ্যে? আমি কি এখানে আসতে দেরি করে ফেলেছি? তাই তার সাথে দেখা হলো না? আর একটা বক্স রেখে গেলো? আমার মনে পড়লো চিঠির কথা।
"মীরা, চিঠিতে তারিখ কত ছিলো?"
"তারিখ তো আজকেরই ছিলো।"
তাহলে কি এটা শামান্তারই ইচ্ছা, আমি এখানে আজকে আসি? সেটাই এখন যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। রুমটাতেও থাকতে পারে কোন মেসেজ। তাই রুমটা ভালো করে দেখতে হবে। একজন নার্স এসে আমাদেরকে ২৬৬ নাম্বার রুমটার সামনে নিয়ে আসলো।
রুমটা বাইরে থেকে হাসপাতালের আর পাঁচটা রুমের মতোই। খোদাই করা নকশা বিশিষ্ট কাঠের দরজা, উপরে রুম নাম্বার সেটে দেওয়া। নার্স দরজা খুলে দিতেই ভেতর থেকে একটা নাতিশীতোষ্ণ সুগন্ধি হাওয়া এসে নাকে- মুখে লাগলো।
এমনটা কোন হাসপাতালের রুমে ঢুকলে পাইনি কখনো। এই রুমে সে ছিল! তার অস্তিত্বের গন্ধ মিশে আছে এখানে। সেই অস্তিত্বে এখন আমি গা ডুবিয়েছি, ভাবতেই শিহরণ জাগছে পুরো শরির- মন জুড়ে।
- মীরা একটু ভালোকরে খেয়াল করিস তো কোনরকম মেসেজ কোথাও পাস কিনা। আমার ধারণা এই রুমে কোথাও হয়তো কোন মেসেজ রাখা হয়েছে।
- তেমন কিছুই তো চোখে পড়ছে না। দেয়ালে কোথাও কিছু লেখা নেই। শুধু এই কিছু ছবি ছাড়া।
- এই রুমে কি কোন বাচ্চা ছিলো কখনো?
- না স্যার, আমাদের এখানে চাইল্ডরুমগুলো তো থার্ড ফ্লোরে। এই ছবিগুলোও আগে কখনো এখানে দেখিনি।
- আচ্ছা বাবা, এই ছবিগুলো কি কোন মেসেজ হতে পারে?
- আমার সেটাই মনে হচ্ছে।
দেখলাম দেয়ালের একপাশে, সারি ধরে কিছু ছবি টাঙ্গানো। ছবিগুলো এমন, বামদিক থেকে প্রথমে এক কাপ চা, তারপর একটা টুপি, ডিম, তারপর একটু ফাকা রেখে বই, কমলা এবং এক্স রে! কি মানে এসবের? এই অগোছালো ছবিগুলো দ্বারা সে কি বলতে চাচ্ছে আমাকে? কি মেসেজ সেটা?
মীরা ওর ফোনে দেয়ালের একটা ছবি তুলে নিলো। এখন পারছি না, পরে ভাবলে হয়তো উত্তর পেয়েও যেতে পারি। রিসিপশনিস্ট এর কাছ থেকে বক্সটা নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। মনে হচ্ছে শামান্তা আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে। সে নিজেকে এখন আমার কাছে ধরা দিতে চায়।
তবে এতো অপেক্ষার ফল এতো সহজে পাওয়া যায় না, কিংবা দেয়া যায় না। তাই হয়তো এই লুকোচুরি খেলা। ওকে পেতে হলে আমাকে একটু ব্রেইন গেইম খেলতে হবে। তা না হয় খেলবো। এ আর এমন কি। এত আকাঙ্ক্ষিত বস্তু এতো সহজে পেলে অবশ্য তাতে ততটা প্রশান্তিও নেই।
শামান্তা, তোমার দেখা পেতে আমি নীলনদ পাড়ি দিতে রাজি আছি। এই গুপ্তবিদ্যা আর এমন কি! গাড়িতে উঠে মীরা জিজ্ঞেস করলো, "এখন আমরা কথায় যাবো আমরা? তাকে তো পেলাম না"।
- বাসার দিকেই চলি না হয়।
- আচ্ছা বক্স টা খুলে দেখি চলো।
- না, তার আগে দেয়ালের ঐ ছবি গুলোতে কি মেসেজ আছে সেটা জানতে হবে।
- এই ছবিগুলো দ্বারা কি বুঝাতে চাইছেন তিনি?
- জানিনা। কয়টা ছবি আছে সর্বোমোট?
- উম... ছয়টা.
- ছয়টা ছবি যদি একেকটা শব্দকে নির্দেশ করে, তাহলে একটা বাক্য হতে পারে।
- ঠিক বলেছো। ছবিগুলো পরপর সাজালে হয়, চা টুপি ডিম বই কমলা এক্স- রে। এগুলো দিয়ে কি বাক্য হতে পারে?
- কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
আসলেই আমার মাথায় ঢুকছে না। কি লিখেছে শামান্তা! হঠাৎ মাথায় একটা তড়িৎ খেলে গেল। ছবিগুলো দিয়ে যদি একটা শব্দ হয়? আমি বলার আগেই মীরা বলে উঠলো কথাটা।
- একটা ইংরেজি শব্দ। তাহলে?
- হতে পারে।
- বাবা, চা এর ইংরেজি কি?
- টি, কেন তুই ভুলে গেছিস?
- টি এর 'T' তারপর, টুপি মানে হ্যাঁট এর 'H', এগ এর 'E' হলো - THE
- ঠিকই ধরেছিস। তারপর?
- তারপর এভাবে করলে, বুক এর B, অরেঞ্জ এর O আর এক্স রে'র X হলো BOX। THE BOX। বাবা শামান্তা চাইছে আমরা বক্স টা যেন দেখি।
- এবার বুঝেছি। বক্স আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। দেখি বক্সটা।
বক্সের উপরে কোথাও কোন লেখা নেই। সচারাচর উপহারে যেমনটা থাকে। সাধারণ গিফট পেপারে মোড়া। বেগুনি বর্ণের। কি আছে বক্সটায়! আমি নিজেকে সামলাতে পারছিনা।
"চলো বাবা, বক্সটা খোলা যাক।"
গিফট পেপার সরাতেই চোখ ধাধানো একটা সোনালি কাঠের বক্স, আর মিষ্টি একটা সুগন্ধ। পুরো গাড়ি যেন ভরে গেলো সুগন্ধে। বক্সটা সোনালি কাঠের। সোনালি কাঠ এর আগে কখনো আমি দেখিনি। কাঠের উপর নকশা খোদাই করা। সোনালি কাঠ! না সবকিছুই কেমন অদ্ভুত ঠেকছে।
- বাবা, সোনালি কাঠ এই প্রথম দেখছি।
- সোনালি রং করা হতে পারে।
- না বাবা, কালার করা হলে বুঝব না? এটা কালার না, সত্যি সোনালি কাঠ। ইন্টারেস্টিং মানুষ, তোমার এই শামান্তা।
- কিন্তু বক্সটা যে, লকড। এর 'কি হোল' কোথায়? কিভাবে খুলবো? সে সমন্ধে কোন ধারণা আছে?
- ডোন্ট ওরি বাবা। যখন আমি এখানে আছি, তুমি এসব নিয়ে টেনশনই করো না। দেখতে দাও আমাকে। হুমম....দেখে মনে হচ্ছে কোন কোডে এটা আনলক হবে। কিন্তু প্রশ্ন টা হচ্ছে এর আনলক কোডটা কি? আমরা কি সেটা জানি?
- না না, শামান্তা আনলক কোড কোনো না কোনভাবে আমদের নিশ্চই দিয়েছে। আনলক কোড না দিয়ে এটা আমাদের হাতে কেন দিবে। আমরা কিছু মিস করছি কি?
- না আমার মনে হয় না, আমরা কিছু মিস করেছি। আমরা হাসপাতালে গেলাম, রিসিপশনিস্টের সাথে কথা বললাম। সে একটা বক্স দিলো। আমরা এক্সট্রা আরো রুমটা দেখে এলাম। সেখান থেকেও একটা মেসেজ পেলাম। তাহলে, মিসটা হলো কি?
- কিছু একটা তো আছে যেটা আমাদের এখন মনে পড়ছে না। আচ্ছা শামান্তা আমাদেরকে কি কি দিয়েছে। মানে ওর থেকে আমরা এখন অবধি কি কি পেয়েছি?
- প্রথমে একটা চিঠি, তারপর একটা বক্স, তারপর একটা মেসেজ।
- আগে বক্স পরে মেসেজ! বক্সটা তো আমরা আগেই পেয়েছি। তাহলে ওটার গুরুত্ত্ব বোঝাতে মেসেজ কেন? তোর কি মনে হচ্ছে না, এই মেসেজটাই হতে পারে বক্সের আনলক কি?
- দারুন বলেছো বাবা!
- দেখ তো কয়টা ক্যারেক্টার লাগবে লকটা খুলতে?
- হুম? এক, দুই,.... ছয়টা
- দেয়ালের মেসেজটা তে ও ছটা ক্যারেক্টার ছিলো! ব্যাস, আমার যেটা মনে হচ্ছে। তুই একবার চেষ্টা করে দেখ।
- হ্যাঁ বাবা।
T H E B O X
আনলক বাটনে প্রেস করতেই উপরের অংশ খুলে গেলো। আর ভেতর থেকে ধুঁয়ার মত উড়ে গেলো একটা সুগন্ধি। ভেতরে কিছু একটা কাগজ রোল করে তা লাল ফিতে দিয়ে বাধা আছে। যেমনটা কোন ডিগ্রি বাধা থাকে। কিন্তু একটা বিষয় হলো - সুগন্ধি।
প্রত্যেকটা ধাপেই আমরা একটা করে নতুন সুগন্ধি পাচ্ছি। সুগন্ধি কেন? এটাও কি কোন মেসেজ?
- মীরা, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস?
- হ্যাঁঁ, পারফিউম! কিন্তু পারফিউম কেন?
- আচ্ছা সেটা পরে দেখবো। আগে চল দেখে নেই, কাগজে কি লেখা।
একদম ধবধবে সাদা, অতি মসৃণ এবং সুগন্ধযুক্ত রোল করা একটা কাগজ , যা একটি লাল ফিতে দিয়ে বাধা। ফিতে খুলে কাগজটা মেলে ধরলাম চোখের সামনে। একটু অবাকই হলাম লেখাটা দেখে। এবং খানিকটা হতাশও। ভেবেছিলাম হয়তো বড়সড় কোন চিঠি হবে।
কিন্তু এত বড় সাইজের একটা কাগজের একেবারে মাঝখানে চারটে শব্দের একটা সাংকেতিক মেসেজ ছাড়া আর কিছুই নেই! একদম ফাকা! লেখাটা এই - 0H:8 1R:2 RMIP XURX
কী লিখেছে শামান্তা, কেন এত হেয়ালি? আমাকে কেন এত ঘোরাচ্ছে? নতুন করে একটা ধাঁধা? কি বোঝাতে চাইছে সে? ধরে নিলাম ওর দেয়া সবগুলো ধাঁধা আমি সমাধান করলাম, তারপর? তারপর কি? আমি ওকে পাবো? জানি না, ভাবতে পারছি না। তবে ধাঁধাটা সমাধান করাও এখন গুরুত্ত্বপুর্ণ।
- বাবা?
- হ্যাঁঁ বল।
- ওমন মুখ করে বসে আছো কেন? দেখো আমরা ঠিক এসব ধাঁধার সমাধান করে তোমার শামান্তার কাছে পৌছে যাবো। মিলিয়ে নিও।
- তাই যেন হয়।
- কিন্ত বাবা তুমি এখনো আমাকে শামান্তার ব্যাপারে কিছুই বলোনি। প্লীজ বাবা, আই ওয়ান্ট টু নৌ।
আমার বোধশক্তির উদয় হলো।
মীরা শামান্তার ব্যাপারে এতক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করছে। তাছাড়া ওকে তো বলা উচিতও বটে। আমি মোহাবিষ্ট হয়ে বলতে শুরু করলাম - "ও যখন ঢাকা চলে আসে, ওর ছোট খালার বাসায়। দীর্ঘদিন ওর সাথে দেখা হয়নি, কথা হয়নি। আমার তখন এইচএসসি শেষ, একদিন মিরপুর- ১২ তে আসি একটা কাজে।
লাঞ্চ করার জন্য ঢুকি ঐখানকারই একটা রেস্টুরেন্ট এ, নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। ভেতরে ঢুকে স্বাভাবিক ভাবেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। বুঝতেই পারছিস আমি ওখানে শামান্তাকে দেখেছি। দু'বছর পর! ভাবা যায়! যার সাথে রোজ তিন বেলা কথা না বললেই নয়। যাইহোক, আমি ওকে ডাকার আগেই, ও আমাকে দেখতে পায়।
- কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ খুব ভাল। তুমিও ভালো আছো আশা করি।
- হ্যাঁঁ ভালো থাকারই কথা, তাই না?
- এখানে, কি করছো?
- কাজিনকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে এসেছিলাম। দুপুর হয়ে গেলো, তাই ভাবলাম লাঞ্চটা করেই যাই। তুমি কোন কাজে এসেছো নিশ্চই?
- কাজিন, মানে নিতু?
- নিতুকে মনে আছে তোমার! যাক বাবা। তারপর তোমার কি খবর বলো?
আমি, শামান্তা আর নিতু মিলে খাওয়াদাওয়া আর গল্প শেষে ফেরার উদ্দশ্যে রওনা দেই। আমি যেখানে যাবো, একই পথে ওরাও যাবে। তাই একসাথেই চললাম। পথে পাশাপাশি হাঁটছি আমরা, পিছনে নিতু। কতশত গল্প করলাম।
দুবছরের জমে থাকা কথা কি আর, কয়েক ঘন্টায় বলে শেষ করা যায়? আমরা হাঁটছি, কথা বলতে বলতে। দুজন অতি ঘনিষ্ঠ মানব-মানবী যেমন একসাথে রাস্তায় হাঁটে। মুহুর্তে আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের দুবছর দেখা না হওয়া, কথা না হওয়া। আমরা এই তো আছি, হৃদয়ের কাছাকাছি আমাদের বসবাস। তবে কিসের দুরুত্ব, কিসের প্রতিবন্ধকতা? সময়ের বাধা কোথায়? জাগতিক সকল বন্ধন কোথায়? সামাজিক বেড়িবাধ কোথায়?
যে বাঁধ আমাদের দূরে রেখেছে এতকাল! আমরা যেমন হাসছি এখন, এমনই যেন ছিলাম চিরকাল, এমনই থাকবো অনন্তযুগ ধরে।
সেদিন বিকেলে বৃষ্টি হয়েছিলো। রাস্তায় আলোকবিন্দুর মতো জমেছিলো থোকা থোকা জল। ভেজা স্যাতস্যাতে রাস্তা, আর থমথমে আকাশ। সব রঙ যেন সরে গিয়েছিলো জগত থেকে। শুধু তার চুলের রঙ, তার পোশাকের রঙ, তার শরিরের রঙ অটুট ছিলো।
যেন সে বিকেল শুধু তাকে দেখার জন্যই, বিমোহিত হওয়ার জন্যই। যতটুকু সময় আমি তার পাশে ছিলাম, আমি ছিলাম যেন অনুভুতির জগতে। যেখানে অনুভুতি প্রবল। আবেগও।
অবশেষে ওর বাসার কাছে আসলাম। বিদায় জানিয়ে আমি রাস্তায় পা বাড়াতেই চিৎকার করে উঠলো শামান্তা। বুঝলাম, অঘটন কিছু ঘটেছে। পেছন ফিরে দেখি, পা পিছলে পড়ে আছে ভেজা ফ্লোরে। কাছে এগিয়ে গেলাম, ও ব্যাথায় কাঁদছে। হোঁচট খেয়ে পড়ে ডান হাটুতে চোট পেয়েছে খুব। এছাড়া ডান চোখটা অল্পের জন্য বেচেছে, দেয়ালের ধারালো প্রান্ত থেকে। আমি সেই প্রথম ওকে কাঁদতে দেখি।
যে চোখে সবসময় হাসি ঝলমল করে, সে চোখে ব্যাথার কান্না দেখতে নিশ্চই ভালো লাগছিলো না। আমারও কান্না চলে এসেছিলো প্রায়। কিন্তু কি করার, আমি চাইলে নিজে কেঁদে তো আর, ওর ব্যাথা কমাতে পারবো না, চাই পেইনকিলার। তাই কোন রকমে আমার কাধে ভর দিয়ে উঠে দাড়াতে বললাম। বাসায় চলে যেতে বললাম তখনই। ও চলে গেলো খোড়াতে খোড়াতে। আমি শেষবারের মতো ওর চলে যাওয়া দেখলাম। এটাই ছিলো ওর সাথে আমার শেষ দেখা। এরপর আর আমাদের কখনো দেখা হয়নি।
- কথাও হয়নি এরপর?
- না। কোন যোগাযোগ হয়নি এরপর।
বাসায় ফিরে নিজেকে এলিয়ে দেই বিছানায়। কোন প্রশ্নের উত্তর এখন আর খুঁজবো না। নিজেকে খানিকটা শুন্যে ছেড়ে দিলাম। তাতে যদি কিছুটা প্রশান্তি মিলে। তারপর, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভাঙ্গলো মীরার ডাকে। "বাবা, উঠো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তোমার জন্য কফি করে এনেছি।"
আমি হুরমুর করে উঠে বসলাম। মাথাটা খানিকটা হালকা ও সতেজ লাগছে। এখন হয়ত ধাঁধা সমাধানে মন দিতে পারবো।
- কিছু কি ভেবেছো?
- কি ভাববো?
- মানে, কোডটা কিভাবে ব্রেক করবো?
- আচ্ছা, দেখি কি করা যায়। লেখাটা কোথায় যেন রাখলাম!
- এই তো, দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলাম অগোছালো কোডগুলোর দিকে। মনে সিফার হতে পারে।
"আচ্ছা শোন, এটা কোন সিফার নয় তো?"
- হতে পারে। একটা কথা বাবা, তোমার শামান্তা কিন্তু আসলেই বেশ বুদ্ধিমতি, মানতেই হবে।
- একটা বিষয় খেয়াল করেছিস? প্রত্যেকটা শব্দই এখানে ৪টা বর্ণের।
- হ্যাঁঁ। আচ্ছা বাবা, আমার মনে হচ্ছে এটা রেইল ফেঞ্চ সিফার।
- কিন্তু নাম্বার গুলো? রেইল ফেঞ্চ এ তো নাম্বার ব্যবহার করা হয় না।
- সেটাও। কিন্তু একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? প্রত্যেকটা বর্ণকেই আমরা ব্যাবহার করে দেখি। ধরে নেই এটা রেইল ফেঞ্চ। তাহলে প্রথম চারটা বর্ণকে আগে দেখতে হবে। এগুলো এলোমেলো ভাবে আছে।
আগে সাজিয়ে দেখতে হবে কোন অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায় কিনা। পাওয়া গেলে একই নাম্বার কম্বিনেশনে বাকিগুলো পাওয়া যাবে।
0H:8 > 08H: > H0:8
- এটার কোন অর্থ দাড়ায়?
- কি জানি, বুঝতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে না রেইল ফেঞ্চ।
- তাহলে?
- আমি জানি না।
- আচ্ছা শেষের চারটা দেখি।
- না না, তৃতীয় ওয়ার্ডটা দেখো দেখি কোন অর্থ পাওয়া যায় নাকি।
RIMP> PIRM > RIMP > MIRP
- মিরপ! পরেরটা সাথে মিলবে হয়তো!
XURX > URXX>
আগেরটা আর এটা মিলালে হয়, MIRPURXX কিন্তু শেষে এই XX টা কেন? রোমান সংখ্যায় XX মানে ২০। কিন্তু মিরপুর ২০ বলে তো কোন জায়গা নেই। তাহলে? অন্য কোন অর্থ আছে কি? আর প্রথমটা দেখলাম H:08 এটা হতে পারে হাউজ নং। আর পরেরটা? পরেরটায় কি আছে? R:12 মানে রোড নং ১২। তাহলে ঠিকানাটা ঠিক দাড়ালো মিরপুর ১২, হাউজ নং ০৮। কিন্ত শেষের দুটো বর্ণ?
- আমার মনে হয় ও দুটো এমনি দেয়া হয়েছে। কারন শেষে মাত্র দুটো বর্ণ বাকি ছিলো। কিন্তু রেইল ফেঞ্চ এ প্রতি ক্ষেত্রে চারটে করে বর্ণ লাগে। তাই চারটে বর্ণের শুন্যতা পুরণের জন্য বাকি দুটো ×× ব্যবহার করেছে।
- এটাই যুক্তিযুক্ত।
- তাহলে? এবার আমরা কোথায় যাচ্ছি?
- মিরপুর ১২।
পরদিন ভোর হতেই নাশতা সেরে আমরা ছুটলাম মিরপুর ১২ এর দিকে। পথে মীরার প্রশ্নের জবাব স্বরূপ ওকে বলতে শুরু করলাম, শামান্তার সাথে আমার প্রথম দেখা আজ থেকে ৪০ বছর আগে, বসন্তের শুরুতে। একটা বেগুনি ফ্রক পড়ে, নদীর পাড় ঘেঁষে আসছিলো, হাতে একটা বড় ব্যাগ, চোখ তার মাটির দিকে।
তখন আমার বয়স ১৫ হবে, ওর ও বোধয় তাই হবে। এ বয়সের মেয়েরা যেমন হয়, ও তেমন না। তার আচরণে ছিলো কেমন একটা প্রাপ্তবয়স্ক ভাব। যেন ২০/২৫ বছরের একজন বুদ্ধিসম্পন্ন নারী।
দূর থেকে ওর অমন হাঁটা দেখে, চেয়ে রই যতক্ষণ চোখের সীমানায় ছিলো। আমি গিয়েছিলাম নদীতে গোসল করতে। নদীর পাড়ে যেখানে খেয়া ভীরত এসে, সেখানে আমরা সবাই যেতাম গোসল করতে। তাই সকাল দুপুর ওপার থেকে আসা অনেক লোকের সাথেই দেখা হতো।
তখন আমাদের বাড়ি ছিল ধনিয়ার বিলে। নামে বিল হলেও আসলে ঠিক বিল সদৃশ ছিলো না। তবে আমাদের গ্রামের চারিদিক ঘিরে ছিলো একটা নদী। নদীটার নাম ঠিক মনে পড়ছে না। আমি গোসল টোসল সেরে, বাসায় যাই। মাকে বলি - ক্ষুধা লেগেছে খেতে দাও।
- রান্না এখনো হয়নি, একটু অপেক্ষা কর।
- মা, আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। ঘরে কি কিচ্ছু নেই?
- ভাত হয়েছে শুধু। তুই তাহলে এক কাজ কর, মনজুদের বাড়ি থেকে তরকারি চেয়ে নিয়ে আয় একটু। ওদের বোধয় রান্না শেষ।
- মা আমি যেতে পারবো না। তুমি এনে দাও।
- আমার হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। আমি গেলে রান্নাটা কে করবে শুনি। তাছাড়া ক্ষুধা তোমারই লেগেছে। মন চাইলে যাও, না মন চাইলে অপেক্ষা কর।
অগত্যা আমি ঘর থেকে একটা পেয়ালা নিয়ে গেলাম মনজুদের বাসায়। মনজুদের বাসা আমাদের বাসার পাশেই ছিলো। আর মনজু আমার দুই কি তিন বছরের ছোট। তবে আমরা বেশ ভালো বন্ধু ছিলাম, একসাথে স্কুলে যেতাম কিনা।
তাছাড়া আমরা একে অপরের ভালো- মন্দ সব কাজের অংশিদারও ছিলাম বটে।
- কাকি,
- কিরে, সাদ যে!
- তোমরা আজকে কি রান্না করেছ?
- তেলাপিয়া মাছ। বাসায় মেহমান এসেছে তো।
- কই দেখছি না তো মেহমানদের!
- আমাদের বাসার মেহমান লাজুক কিনা, তাই বাইরে বেরুয় না।
বলেই মনজুর মা হো হো করে হেসে উঠলো। কিন্তু আমি ঠিক বুঝলাম না, এতে হাসির কি হলো।
- আচ্ছা কাকি, মা বললো একটু তরকারি দিতে। দাও তো, আমার আবার খুব ক্ষুধা লেগেছে।
- তাহলে এক কাজ কর না, আমাদের এখানেই খেয়ে যা।
- বলছো?
- হ্যাঁঁ. মনজুও খাবে এখন, তোরা একসাথেই বসে পর।
কাকির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। ঘরে ঢুকলাম মনজুদের। ঘরে দেখি সেই মেয়েটা বসে আছে, যাকে নদীর পাড়ে দেখেছিলাম। এ ই তাহলে মনজুদের মেহমান। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে যেন, অপ্রস্তুত হয়েই বললো- কে তুমি?
- ও রেজা। এই যে পাশের বাসা ওদের। রেজা কিন্তু মনজুর ভালো বন্ধু।
- ও আচ্ছা, এই হলো তোমাদের মেহমান। আগে বলবে তো- শামান্তা, আমার বড় বোনের মেয়ে। এখন থেকে আমাদের এখানেই থাকবে। বুঝলি?
- হ্যাঁ, বুঝলাম। কাকি তুমি বরং আমাকে তরকারিই দিয়ে দাও এই পেয়ালায়। তোমাদের মেহমান সত্যি ভীষণ লাজুক। আর মনজু আসলে আমার সাথে একটু দেখা করতে বলো কেমন?
আসার সময় লক্ষ করলাম মেয়েটা আমার দিকে কেমন তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টিতে ঠিক কি ছিলো বলতে পারবো না। তবে চোখজোড়া ছিলো ভীষণ মায়াবি। সে দৃষ্টি মোহাবিষ্ট করবে যে কাউকেই। এরপর থেকে ওর সাথে রোজই দেখা হত।
আর দেখা হবেই না কেন, আমাদের বাসায় ওদের নিয়মিত যাওয়া- আসা ছিলো। টুকি- টাকি জিনিস- পত্তর এর জন্য আমাদের দুই পরিবার ছিলো একে অপরের পরিপূরক। ধীরে ধীরে শামান্তা হয়ে উঠলো মনজুদের পরিবারের একজন। আর আমাদেরও সখ্য গড়ে উঠতে লাগল।
আমরা একসাথে নদীতে গোসল করতাম, দৌড়- ঝাপ, দাড়িয়াবান্ধা, ডিম- কুসুম, সে কত রকমের খেলা ছিলো তখন। বর্ষাকালে আমরা নৌকা নিয়ে বেরুতাম শাপলা কুড়াতে। যেদিনই বেরুতাম, আমরা সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরতাম। সেদিন আমরা নদীর বুকে বসে সুর্যাস্ত দেখতাম।
শেষ বিকেলের সেই সুর্যাস্তের রঙ আমার এখনো চক্ষুপটে ভেসে উঠে। আমাদের বড়ই গাছ ছিল কয়েকটা। শীতের সময় যখন বড়ই পাকতো, তখন আমাদের রোজ সকালের প্রতিযোগিতা হতো, কে আগে ঘুম থেকে উঠবে। আর গাছের তলার পড়ে থাকা বড়ইগুলো আগে পাবে।
কখনো মন খারাপ হলে, দুজনে গিয়ে বসে থাকতাম নদীর পাড়ে। নদীর অবাধ জলরাশির মাঝে বিলিয়ে দিতাম নিজেদের মন খারাপের গল্প। এমনি মেলামেশায় আমরা আমাদের বয়স হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমরা ভুলে গিয়েছিাম আমরা এখন কৈশরে আছি। শিশুটি আর নেই। তাই এই বন্ধুত্ব সমাজের চোখে ভালো শুল আকারে বিঁধল।
সমাজের সে শূলবিদ্ধ দৃষ্টি এড়াতে পারিনি আমরা। হয়তো প্রকৃতিও পারেনি। তাই সেবছরই নদী ভাঙ্গনে হারালো আমাদের গ্রাম। আমরা চলে গেলাম পাশের গ্রামে। আর শামান্তা গেল ঢাকায়, তার ছোট খালার বাসায়। কোথায় সে খালার বাসা? সে ঠিকানা আমাকে ও দিয়ে যায়নি। বলে যায়, - এই আমাদের শেষ দেখা, হয়তো। এরপর আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে। তবে তুমি আমাকে খোঁজার চেষ্টা কোরো না।
আল্লাহ চাইলে আমাদের আবার দেখা হবে। ভালো থেকো, আর একজন বড় মানুষ হও। এইচ এস সি শেষে যখন স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে ঢাকা চলে আসি, তখন একবার দেখা হয়েছিলো। কিন্তু সেটাই শেষ দেখা ছিলো। কারন ও আমাকে ওর ঠিকানা কিংবা, যোগাযোগের কোন নাম্বার কিছুই দিয়ে যায়নি।
শুধু বলে যায়- আল্লাহ চাইলে আমরা এক হবো। ওসবের কোন দরকার নেই। ভালো থেকো। তারপর থেকে আমি আমার ক্যারিয়ারে মন দেই, আর ওর কথা আপাতত স্মৃতিচাপা দিয়ে রাখি। কিন্তু মন থেকে কখনোই মুছে ফেলতে পারিনি। আরেকটা ব্যাপারও অবশ্য ছিলো, আমরা কখনোই একে অপরকে বলিনি, ভালোবাসি। হয়ত কখনো বুঝতেই পারিনি, আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।
- এখন বুঝতে পারছো?
- বুঝতে পেরেছি তখন থেকেই, যখন শুনি ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তখন থেকেই ওকে পাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠে আর ওর শুন্যতা চেপে বসে বুকের ভেতর। কিন্তু যখন আমাদের যোগাযোগ ছিলো না, তখন ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছে ততটা প্রবল ছিলো না।
তো যাইহোক, যখন বুঝতে পারি হয়তো ওর প্রতি আমার অনুভুতি এবং অভ্যাসগুলোর নামই ভালোবাসা ততদিনে ও অন্য কারোর অর্ধাঙ্গী হয়ে গেছে। তাই আমার জন্য পড়ে রইলো শুধু ওর স্মৃতি আর অভ্যেস। তারপর ঠিক করলাম বিয়ে করে ফেলি, তাহলে হয়তো সব ভুলে থাকতে পারবো।
এরপর পারিবারিকভাবেই হুমায়রার সাথে বিয়ে হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি এ বিষয়টা আমাদের দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু হুমায়রা অনেক ভালো মনের মানুষ ছিলো। ও ই আমাকে এসব থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করে। বেড়িয়ে আসা অবশ্য হলো না।
তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে। বাস্তবতা শেখায়। একজন ভালো বন্ধু যেমন। ভালো বন্ধু বললেও ভুল হবে, হুমায়রা ছিলো আমার পরবর্তী জীবনের বেস্ট ফ্রেন্ড।
- হুম বুঝলাম। তার মানে হলো তোমরা কেউই জানতে না, তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো? ইন্টারেস্টিং। ঠিক আছে, দেখি মিরপুরে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে।
ঠিকানা অনুযায়ী ড্রাইভার আমাদের যে বাড়ির সামনে নিয়ে দাঁড় করালো, তা দেখে আমি ও মীরা দুজনেই হতবাক। ড্রাইভার আমাদের বাড়ির সামনেই আমাদের নিয়ে এসেছে। না, আমাদের না। কারন আমাদের বাড়ির নাম্বার তো ৫৩। আর এটার নাম্বার ০৭। তাহলে ঠিক বাড়িতেই এসেছি।
কিন্তু হুবহু আমার বাড়ির আদলে তৈরি এ বাড়ি দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। এটাই তাহলে শামান্তার বাড়ি! না ওর স্বামীর। আমাদের বাড়ির মডেল একই হওয়া কোন কাকতালীয় ব্যাপার? নাকি কিছু বোঝাতে চাইছে শামান্তা? যদি কিছু বোঝাতে চায়, তাহলে সেটা কি? একই রকম বাড়ি বানানোর উদ্দেশ্য কি হতে পারে, "তোমাকে ভালোবাসি, তাই তোমার মতোই বাড়ি বানালাম "।
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সামনে আসলো দাড়োয়ান। সে পথ রুখে দাড়ালো।
- কারা আপনারা?
- এটা শামান্তার বাড়ি তো?
- হ্যাঁঁ, আপনি কে?
- শামান্তার আত্মীয়, ওর আমন্ত্রনেই এসেছি।
- আমি আপনার পরিচয় না জেনে ভেতরে ঢোকাতে পারবো না, দুঃখিত। দয়া করে আপনার নামটা বলুন।
- ওয়াসিম রেজা।
মুহুর্তেই তার মুখচ্ছবি পরিবর্তিত হয়ে গেলো। যেন বহুদিন খোঁজার পর আমাকে পেয়েছে, এমন একটা ভাব। সে খানিকটা তোতলানোর মতোই বললো,
- স্যরি স্যার। আপনিই মি রেজা, আগে বলবেন তো। ম্যাডাম বলে রেখেছিল আপনি আসবেন।
- এবার তো ভেতরে যেতে দিন?
- স্যার, ভেতরে গিয়ে আপনার বিশেষ লাভ হবে না।
- কেন? লাভ হবে না কেন?
- ম্যাডাম তো গতকালই চলে গেছেন। আর আপনার জন্য এই চিঠিটা রেখে গেছেন।
- হায়, আল্লাহ! এবার নিশ্চই এটা বলবেন না যে, ম্যডাম কোথায় গেছে তা বলে যায়নি?
- আমি সত্যিই দুঃখিত স্যার।
দারোয়ান এর থেকে চিঠিটা নিয়ে ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে আসলাম। আবার একটা চিঠি! এবারও ওকে হারিয়ে ফেললাম। কে জানে এবার কোন ধাঁধা রেখেছে! গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বললাম, একটা রেস্টুরেন্টে যেতে।
কিন্তু মীরা চেপে বসলো, রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাবে না। ওর কথামত ড্রাইভার আমাদের নিয়ে চললো ধানমন্ডি লেকের দিকে। শামান্তা আমাকে এত ঘোরাচ্ছে কেন! কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। ধরা দিয়েও কেন দেয়না ধরা! মনে হচ্ছে যেন, সাদা কাশবনে ও দৌড়ে বেড়াচ্ছে পেছনে আমিও দৌড়াচ্ছি। কিন্তু তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না।
- চিঠিটা খুলে দেখবে না বাবা?
- হ্যাঁ, দেখবো ক্ষণ।
চিঠির ভাজ খুললাম। সমন্ধসহ বড়সড় এক কথামালা। যা লিখেছে,
প্রিয় সাদ, আহমেদ সাদ
ভালো আছো নিশ্চই? আমি ঠিক কেমন আছি বলতে পারবো না। এই মনে হয় খুব সুখে আছি, আবার মনে হয় ভীষণ শুন্যতায় ডুবে আছি। জানতে চাও না কিসের সেই শুন্যতা? সে শুন্যতা তোমার। তোমার অভ্যাস, তোমার কন্ঠস্বর। ভাবছো এত বছর পর এই শুন্যতার কথা কেমন অবলীলায় বলে যাচ্ছি? হ্যাঁঁ, এখন বলতে পারছি, কারন বয়স বাড়ার সাথে সাথে লজ্জা কেটেছে। বোধশক্তি তীব্র হয়েছে। বুঝতে শিখেছি।
সারাজীবনই সুখের সন্ধান করেছি, যা সব মানুষই করে। কিন্তু জানো তো, আল্লাহ সবার ভাগ্যে সুখ লিখে রাখে না। ছোটবেলায় এতিম হওয়ার পর, খালাদের বাসায় কেটেছে কৈশর। একজন কিশোরীর সহজ সুখ খুঁজেছি। পাইনি কখনো।
তারপর ভেবেছিলাম বিয়ের পর নতুন জীবন শুরু করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে ঐ যে, আল্লাহ যার ভাগ্যে যেটা রাখেনা সেটা পাওয়া তো অসম্ভব। বিয়ে হলো একজন মানুষের সঙ্গে। মানুষ হিসেবে সে খারাপ ছিলো না কোন দিকে থেকেই। কিন্তু শুন্যতা বোধয় কাটছিলো না তখনো। এরপর সখ- আহ্লাদ পূরনের পথে হাটলাম। পূরন হলো অনেক।
কিন্ত তাতেও সুখ নেই জানো। শুন্যতা তখনো যায়নি। সবসময় মনে হতো কিছু একটা ভুল হয়ে আছে। সেই ভুলটা কি, তা বের করতে কেটে গেলো সারাটা যৌবন। আমি এখন চুয়ান্ন বছরের বৃদ্ধা। জীবনের সব মানে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিচ্ছে এখন। অনুধাবন করতে পারছি সেই গুরুত্বপূর্ণ ভুলটা যার খেসারত স্বরূপ পুরোটা জীবন সুখের মাঝেও সুখ পাইনি।
বুঝতে পারছো বোধয় কি ভুল ছিলো আমার। তোমাকে ছেড়ে যাওয়া। শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ছেড়ে রেখে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, আল্লাহ যদি আমাদের একে অপরের জন্য সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে আমাদের মিল একদিন ঠিকই হবে। আমার সে ধারনা ভুল ছিলো। তোমাকে দূরে রেখে কাছে পাওয়ার আশা আমার পূরন হয়নি, যখন তা ভীষণ রকম দরকার ছিলো। এখন অনেক দেরি করে ফেলেছি। তবুও শেষ চেষ্টা স্বরূপ তোমাকে একটা প্রস্তাব দিয়ে দেখি- "বিয়ে করবে আমাকে?"
ভাবছো তখন কেন বললাম না? তখন পরিবারের বালাই ছিলো। আমার ছিলো না নিজস্ব পরিবার, তাই আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছেও ছিলো না বলতে পারো। আমার ইচ্ছে তখন মাটিচাপা দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন পরিবারটা আমার। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরো ক্ষমতা আমার আছে। আর তুমি তো পুরুষ মানুষ, সবসময়ই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দিয়েছেন। তবুও তোমার এবং তোমার পরিবারের সম্মতি নিয়ে আমার প্রস্তাবে রাজি থাকলে চিঠিতে দেয়া পরবর্তী ঠিকানায় যোগাযোগ কোরো। আর যদি ভালো না বাসো, তাহলে এখানে ইতি টানো। আমিও একটা উত্তর পেয়ে যাবো।
সবিশেষ ভালো থেকো পরিবার নিয়ে। তোমার মেয়েটার কি যেন নাম- মীরা! মীরাকে আমার ভালোবাসা দিও। ভালো থেকো।
ইতি
তোমার শামান্তা
পুনশ্চ: শুক্লাদ্বাদশীপুরে দেখা করো।
এই ধাঁধার উত্তর আমাকে এখুনি বের করতে হবে। নাহয় আবার গিয়ে দেখবো সে চলে গেছে। আমি আবার ওকে হারাতে পারবো না। এবার তো দেখা চাই। এই মুহুর্তে আর কিছু ভাবা যাবে না। শুধু ধাঁধার উত্তর।
- বাবা শামান্তা তোমার সমন্ধে এত কিছু জানে অথচ তুমি তার সমন্ধে খুব অল্প তথ্যই জানো। এটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না?
- খুবই সহজ, ও আমার সমন্ধে খোঁজ করেছে, আমি করিনি।
- কেন করোনি? যাকে তুমি এত ভালোবাস, তার খোঁজ কেনো করোনি?
- কারণ, ওর খোঁজ করতে ও বারণ করেছিলো।
- অতি উত্তম, অতি উত্তম।
- আরো কয়েকটা বিষয়ে খটকা লাগছে, বাবা। কিন্তু সে প্রশ্নগুলো এখন করবো না।
- কেন? খটকা কোথায় লাগলো তোর?
- বললাম তো এখন বলবো না। পরে বলবো। হতে পারে আমার ধারণা গুলো নিতান্তই অমূলক।
- বেশ।
মীরার কি খটকা সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি ভাবছি, ধাঁধাটার উত্তর নিয়ে। এই মুহুর্তে এটাই আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্তপুর্ণ। শামান্তার কথা অনুযায়ী এটা একটা ঠিকানা। তাহলে - শুক্লাদ্বাদশীপুর! শুক্লাদ্বাদশীর অর্থ কি? চন্দ্রের বারোতম রাত? তাই যদি হয় বারতম রাত আর চন্দ্র তারপর পুর! চন্দ্রপুর বারো? চাদপুর বারো? চাঁদপুরে ১২ নাম্বার রাস্তা? চাদপুর তো শহর নয়, তাহলে সেখানে রোড নাম্বার কোত্থেকে আসবে? তাহলে এই ১২ কি? সে যা ই একটা হবে। আমকে এই মুহুর্তে চাঁদপুর যেতে হবে।
- আমাদের চাঁদপুর যেতে হবে।
- এখন?
- হ্যাঁ। দেরি করা ঠিক হবে না।
- তুমি কি ঠিকানাটা বের করতে পেরেছো?
- হয়তো
- মানে? আচ্ছা চাঁদপুরের কোথায়? এক্সাক্টলি কোথায়?
- সেটা ওখানে গেলেই বুঝতে পারবো। মতিভাই, চাঁদপুর যাবো। ফেরিঘাটের দিকে চলো।
আমার নির্দেশে ড্রাইভার লেকের গন্তব্য বাতিল করে, চাঁদপুরে যাওয়ার উদ্দশ্যে গাড়ি ঘোরালো। ঘন্টাখানেক এর মধ্যে আমরা এসে পৌছলাম ফেরিঘাট। ফেরিতে চড়ে বসলাম আমরা, তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। পেটে ক্ষুধার অনুভূতি হলো, মনে পড়লো সেই সকালে নাস্তা করে বেড়িয়েছি।
আমি না হয় কোন এক ঘোরের মধ্যে আছি তাই খাওয়ার কথা ভুলে গেছি। কিন্তু মীরা এবং ড্রাইভার মতি ভাই? ওদের তো ক্ষুধা লেগেছ খুব। হয়তো বলতে পারছে না। তাই মতি ভাইকে দিয়ে কিছু খাবার আর পানি আনিয়ে নিলাম। ফেরি ছাড়লো ৪টার দিকে। তারপর আরো ৩ঘন্টার নদী ভ্রমণ।
পরিশেষে, আমরা গিয়ে উঠলাম চাঁদপুর ফেরিঘাটে। এরপর চাঁদপুর শহরে পৌছতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেল। ঢাকা থেকে বেরুতেই যত সময় লেগেছে। রাস্তায় ছিল প্রচন্ড জ্যাম। চাঁদপুর আসার পর মাথায় চিন্তারা ঝাক ধরে এসে বসল। এখন কোথায় যাবো? কোথায় খুঁজব। আর রাতটাই বা কোথায় কাটাবো।
কিন্তু মতি মিয়া এ চিন্তা থেকে বাঁচালেন। মতি মিয়ার বোনের বাড়ি চাঁদপুর সদরেই। আজ রাতটা আমরা সেখানেই কাটাবো। মতি মিয়া ফোন করে আগেই জানিয়ে রাখলেন তার বোনকে। যাইহোক, রাতটা আমাদের সেখানেই কাটল।
ঘুম ভাঙ্গলো ভোরে।
গ্রামের ভোর অনেকদিন দেখা হয়নি। যদিও মাথায় এখনো চিন্তার পাহাড়। তবু, মতি মিয়া কে সঙ্গে নিয়ে একটু বেরুলাম গ্রামটা দেখতে। এই ভেবে যে, একটু সতেজতা যদি ফিরে পাই।
ফিরে এসে দেখি সকালের নাশতা নিয়ে বসে আছে মতি মিয়ার বোন। নাশতার আয়োজন করা হয়েছে উঠোনে চাঁটাই পেতে। যেখানে বসে আছে মতি মিয়ার বোন, তার ছোট ছোট দুটো ছেলে- মেয়ে আর সাথে আমার মেয়ে মীরা। অধীর আগ্রহে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে, কখন আমরা আসবো। আমারা হাত মুখ ধুয়ে নাশতা করলাম। এবার বেরুনোর পালা।
মতি মিয়ার বোনের থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু ঠিক কোথায় যাবো, এটাই বুঝতে পারছি না। মীরা খানিকটা বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলো - আচ্ছা বাবা, আমরা ঠিক কোথায় যাব?
- জানি না।
- জানি না মানে? ছেলেমানুষী করো না বাবা। চাঁদপুর এলাম, কিন্তু এখন কোথায় যাবো? আচ্ছা ঠিকানাটায় কি লিখা ছিলো?
- চাদপুর ১২
- চাদপুর ১২? চাদপুর ১২ মানে কি হতে পারে? এটা কি কোন গ্রামের নাম্বার? নাকি কোন হোটেলের নাম?
- আচ্ছা মতি চাচা, চাঁদপুরে কি এমন কোন জায়গা আছে যে জায়গার নামের সাথে ১২ সংখ্যাটার কোন সম্পর্ক আছে?
- এমন কোন জায়গার নাম তো মনে পড়ে না। বারো, না?
- একটু মনে করে দেখুন না চাচা।
- ছোটমনি, বারো আউলিয়া হোটেল নামে একটা হোটেল আছে একটু সামনেই।
- হোটেল? আমার মনে হচ্ছে সেখানেই যেতে বলেছে। - ঐখানেই নিয়ে চলুন মতি ভাই। হোটেলে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। হয়তো সেখানেই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
হোটেলে সামনে গিয়ে যেটা মনে হলো, একটা তিন তাঁরা হোটেল। এমন হোটেল এ শামান্তা কখনোই থাকতে পারে না। ওর রূচিবোধ প্রবল। তাহলে ভুল ঠিকানায় আসলাম কি? কি জানি।
তাও ভেতরে গিয়ে দেখি। হয়ত, এখানেও কোন মেসেজ রেখে গেছে। হোটেলে ঢুকে প্রথমেই ঢুকলাম রিসিপশনিস্ট এর খোঁজে। একটু খুঁজতেই পাওয়া গেলো তাকে। শামান্তার নাম করতেই সে জানালো, শামান্তা তার কাছে একটা চিঠি রেখে গেছে ওয়াসিম রেজার জন্য।
আমি ওয়াসিম রেজা এই প্রমাণ দিতে পারলে তবেই চিঠিটা পাবো। তাকে শেষমেশ আমার এনআইডি অবধি দেখাতে হলো। অবশেষে পাওয়া গেল সেই চিঠি।
সুপ্রিয় সাদ,
আমি খুবই আনন্দিত এটা জেনে যে, তুমি এখানে এসেছো। তুমি চিঠিটা পড়ছো তার মানে হল, তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো এবং আমার প্রস্তাবে রাজি। আমি সত্যি অনেক খুশি আজকে। কিন্তু খারাপ লাগছে, তোমার সাথে দেখা না করে চলে আসতে হয়েছে। কিন্তু এছাড়া আমার কিছু করারও ছিলো না। শরিরটা খুব খারাপ করেছে। কে জানে, আর কতক্ষণ হৃদকম্পনটা থাকবে। তবে আমি খুশি, অনেক খুশি। এটা জেনে যে, তুমি আমাকে ভালোবাসো আর আমিও তোমাকে।
আচ্ছা বিয়েটা তো দুজনের সম্মতিতে একটা সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ। হওয়া! আমরা দুজনে যেহেতু রাজি, আমরা বিয়েটা করে নিতে পারি না? পারি। আমি এই চিঠিতেই বলছি, তোমাকে আমি স্বামী হিসেবে গ্রহন করে নিলাম। কবুল, কবুল, কবুল। তুমিও কবুল বলে নাও। এখন থেকে আমরা স্বামী- স্ত্রী, আমার মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত।
চিরকাল এটাই চেয়েছিলাম, আমরা দুজন। তাই না? এখন হয়ে গেলো! ভাবতেই পারছি না। আমি তোমার সামনে থাকলে হয়তো জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম। কিন্তু প্রকৃতি সবাইকে সব সুখ দেয় না। তবে এটুকূ না পাওয়া নিয়ে বিদায় নিতে আমার কোন আপত্তি নেই। এখন আমি পরিপূর্ণ মানবী, আমার কোন শুন্যতা নেই। আমার শুন্যতা তোমাকে পাওয়ার মাধ্যমে পূরণ হলো।
তুমি এসো, আমি অপেক্ষায় রইবো হাসপাতালের জানালা ঠেলে। খোলা হাওয়ায় কাচা- পাকা চুলগুলো উড়বে যখন বসন্তের মৃদুমন্দ এই বাতাসে, তুমি এসো প্রিয়। আমি অপেক্ষায় রইবো।
এখন চলে গেলেও খুব একটা আফসোস থাকবে না। তবে একবারের জন্যও যদি তোমার সাথে শেষ দেখা করতে পারতাম! জানিনা এত সময় আছে কিনা, তুমি পারলে এসো পপুলার এর মিরপুর ব্র্যাঞ্চ এ। হতেও পারে আমাদের শেষ দেখা। তোমাকে অনেক ঘুরিয়েছি। আর না। এবার আমার ক্লান্তি চলে এসেছে। তোমার আর তোমার মেয়ের কাছে, এজন্য দু:খিত। পারো তো এটুকু ক্ষমা করে দিও।
ইতি
তোমার শামান্তা
আমার ভেতর প্রদাহ শুরু হয়েছে। কি করবো এখন? হাসপাতালে যাবো? নাকি বিরহ ব্যঞ্জন গাইবো? আমাকে ছেড়ে যাওয়ার ছাড়পত্র আমি কীভাবে তাকে দিতে পারি? চোখ ফেটে এখন জল কেন বেরুয় না। শক্ত হয়ে গেছে ভেতরটা? আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি, তবে? এতটা কাছে এসে বিদায় কেনো চাচ্ছে?
- এখনো চলে যায়নি বাবা, তাই অতটা উতলা হওয়ার মানে হয়না। হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। চলো শেষ চেষ্টাটা করে দেখি। দেখি তোমার স্ত্রীর দেখা পাই কিনা। মতি চাচা, আমরা মিরপুর ফিরে যাবো। যত দ্রুত সম্ভব।
গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আমি শুধু চোখের জল গুনছি। কেন কাঁদছি? তাকে তো পেয়েও না পাওয়ার যন্ত্রনা বুকে বিধে আছে, কাঁদবো না? আল্লাহ যদি আমাকে তার হাতে হাত রেখে একসাথে আমাদের দুজনকেই তুলে নিতো! তাহলে হয়তো আফসসের পরিমাণটা অনেকাংশেই হ্রাস পেত।
আমি প্রতিক্ষার প্রহর আর গুনতে পারছি না। আর কতদুর? আর কতদুর আছি আমি তার থেকে? আমরা কি খুব কাছা- কাছি? হাতে হাত রাখার মতো কাছা কাছি? নিশ্বাসের শব্দ অনুভব করার মতো? পবনে উড়ে আসা তার চুলের স্পর্শ পাওয়ার মত কাছা- কাছি? তারপর? আমি ভাবতে পারছি না।
সে এখন আমার স্ত্রী। তার পরিচয় হয়ছে! তার আর আমার সম্পর্কের একটা নাম হয়েছে। আমরা স্বামী- স্ত্রী! আমরা একে অপরকে ভালোবাসি সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি দুজনেই! আমি ভাবের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি বোধয়। তবে এখন একটা কথাই উড়ছে মনের মধ্যিখানে।
আমি দেখা পাবো তো তার? দেখা পেলেও কি অবস্থায়? সে কি হাসিমুখে বসে আছে আমার প্রতিক্ষায়? নাকি হাসপাতালের আনুষাঙ্গিক জটিলতায় জড়ানো একজন কার্ডিয়াক প্যাশেন্ট? আমি শুধু হাসিমুখ- খানাই ভাবতে পারছি। সে কৈশর বিকেলের হাসিমুখ।
আমি দ্বিতীয়বারের জন্য শামান্তার খোজে হাসপাতালে আসলাম। প্রথম বারের তুলনায় এবারেরটায় রয়েছে রাত- দিন তফাৎ। জানিনা এবারো কোন শান্তনাদায়ক চিঠি অপেক্ষা করছে কিনা! গাড়ি থেকে নেমে হুট ছুটে ঢুকে পড়লাম হাসপাতের গেট পেড়িয়ে, ভেতরে।
আমাকে অমন ছুটতে দেখে হাসপাতালেরই কেউ একজন এগিয়ে আসলো।
- স্যার, স্যার কি হয়েছে স্যার? কাউকে খুঁজছেন?
- শামান্তা?
- রিসিপশনে জিজ্ঞেস করে দেখুন স্যার। চলুন আমার সাথে চলুন। ছেলেটা আমাকে ধরে রিসিপশনে নিয়ে গেলো। পেছন ছুটে আসতে দেখলাম,মীরা আর মতি মিয়া কে।
- আপা, দেখুন তো, শামান্তা নামে কোন প্যাশেন্ট আছে ভর্তি।
- আপনি শামান্তার কে হোন?
- আমি, আমি ওর স্বামী।
- স্যার, তাহলে তো আপনার জানার কথা উনি আজ সকালে
- আজ সকালেই কি?
- উনি আজ সকালেই চলে গেছেন।
- কোথায় চলে গেছেন?
- স্যরি স্যার, আপনার জন্য স্যাড নিউজ এটা। তিনি আর নেই। গতকাল রাতে তিনি মারা যান। আর সকালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আপনি বলছেন আপনি তার স্বামী, তাহলে এ খবরটা কেউ আপনাকে দেয়নি?
যা ভেবেছিলাম, তাই। বড়সড় ধাক্কার মতন খেলাম না। শুধু বুকটা হঠাৎ করেই শূন্য হয়ে গেল কেমন। শামান্তা বরাবরের মত এবারও আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। এবার চিরকালের মত। আর বোকা বোকা চিঠি রেখে আমাকে ঘোরাবে না। আমাকে মুক্তি দিয়েছে, এবার। ওর সকল বন্ধন থেক, মুক্তি দিয়েছে এবার। সকল স্মৃতি নিয়ে, ও চলে গেল। ভালোই করেছে, ও যেহেতু থাকবে না, ওর স্মৃতি কেনো থাকবে আমার সাথে?
- আচ্ছা, আরেকটা সাহায্য করুন, আপনি কি এটা বলতে পারেন কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে? মানে কোথায় দাফন করা হয়েছে?
- ঠিক বলতে পারবো না। তবে উনাদের বলতে শুনেছি, মুন্সিগঞ্জে হবে হয়তো।
- ধন্যবাদ।
আমি ছুটলাম মুন্সিগঞ্জের দিকে। কোন অপেক্ষা নয়। এখনই রওনা দিতে হবে। আমি বাসে চড়ে বসলাম। চললাম মাওয়ার দিকে। ওখান থেকে মুন্সিগঞ্জ।
মুন্সিগঞ্জ পৌছলাম যখন বিকেল হয়ে হয়ে এসেছে, এখন কোথায় খুঁজবো তাঁর কবর? মুন্সিগঞ্জে কোথায়? আমার কেন মনে পড়ছে না? আচ্ছা রিসিপশনে কোন চিঠি রেখে গেছে শামান্তা? আমি কেন জিজ্ঞেস করলাম না! এখন কোথায় যাবো আমি। এভাবে দাড়িয়ে থাকবো, এই পদ্মারপাড়ে? পদ্মার বিশাল জলরাশিতে শামান্তা, তুমি কই? তোমার খোঁজে আমি এসেছি।
তুমি বলছো? পদ্মার গভীর জল ফেটে আওয়াজ এলো যেন, তার কন্ঠস্বর বলে উঠল, 'আমার শরীরের খোঁজে এত কেন পন্ডশ্রম! হারালে তো শেষমেশ! আমি তোমার হয়ে গিয়েছি, তোমার সাথেই আছি। তবে আমারে খুঁজো কেন তেপান্তরজুড়ে? তোমার বাগানে সদ্য ফোঁটা ব্ল্যাক রোজে আমার হাসিমুখ তুমি খুঁজে পাওনা? তোমার বইয়ের পাতায় যত্নে রাখা চিরকুটে কি আমি নেই? বসন্ত যখন প্রথম সকালে উকি দেয়, উষ্ণ আবদারে, সে সূর্যোদয়ে আমাকে তুমি পাও না? ভাবনার গভীরে হঠাৎ যখন মুচকি হাসো, তোমার সেই মুচকি হাসার কারন কি আমি নই?
তাহলে কেন হতাশ হচ্ছো, আমার দেহাবশেষ না পেয়ে। আমি তো তোমার কাছেই আছি, চিরটাকাল, যেভাবে ছিলাম। দূরে কেন খুঁজো আমারে, আমরা এই তো আছি, হৃদয়ের কাছাকাছি।
বসে আছি পদ্মার পাড়ে, একটা পাথরের উপর। পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়ছে উতলা পদ্মার ঢেউ। ভাবনায় শামান্তা। আমাদের কৈশর। ও আলে যাওয়ার পর, একটা সময় আমি ওর অভ্যাসগুলো ভুলতে বসেছিলাম।
তখন সারাক্ষণ এটাই ভাবতাম, আরেকটিবার যদি দেখা হত তাঁর সাথে! সে কেমন করে কথা বলে এখন? আগের মতোই সামনে দৃষ্টি বিস্তৃত রেখে? নাকি এখন বদলেছে তার কথা বলার ভঙ্গি? এখন কি সে কথা বলার সময় হাত নাড়ায়? তাঁর মুখের হাসিটা কি ঠিক আগের মতোই আছে? সে চুল কিভাবে বাঁধে এখন? তার পছন্দের রং কি বদলেছে? তাঁর কি এখন আর বসন্তের বিকেলে গান গাইতে মন চায়? তার কন্ঠস্বর কেমন হয়েছে এখন? আরো মিষ্টি হয়েছে কি? তার চোখ আগের মতোই মায়াবী আছে তো? নাকি কোন বিষাদে তাতে জল জমেছে? তার ভেতরকার মানবীর চেতনাবোধ আরো প্রবল হয়েছে কি?
সবচেয়ে বেশি যেটা ভাবতাম, সে কি আমাকে মনে করে? আমাকে নিয়ে ভাবে?
তবে পরিশেষে মুক্তি মিলেছে। সকল স্মৃতি, সকল মানসিক যন্ত্রণা থেকে। যে মানুষটাই এখন পৃথিবীতে নেই, তার স্মৃতি আর কতদিন থাকবে। শামান্তা আর তার স্মৃতি, সাথে তাকে পাওয়ার মিছে আশা সব, পদ্মার হিংস্র জলে ভাসিয়ে দিয়ে আমি মুক্তি চাই সকল দায়বদ্ধতা থেকে।
আমি মুক্ত হতে চাই। পেছন থেকে ডাক আসলো। মীরার গলা। তাহলে ওরা এখানে পৌছে গেছে! আমি পেছন ফিরে আর দেখছি না। আমার দৃষ্টি নদীর পেটে অর্ধডোবা লাল সূর্যটার দিকে।
- বাবা? বাবা, সাড়া দিচ্ছো না যে? আমি আর নিতে পারছি না বাবা তোমার এই পাগলামো। ক্যান ইউ জাস্ট স্টপ দিস ননসেন্স?
- কি হয়েছে, মীরা? এমনভাবে কথা বলছিস কেন?
- বুঝতে পারছো না? এসব এবার বন্ধ করো বাবা।
- সব তো শেষই! আমি আর নতুন করে কি বন্ধ করবো?
- কোথায় শেষ বাবা? তুমি একজন জীবন্ত মানুষকে মেরে ফেললে? তুমি কি ভেবেছ?
- কি বলছিস এসব?
- আর অভিনয় নয় বাবা। আমি জানি তুমি দূর্দান্ত অভিনয় করো।
খেয়াল করলাম, মীরার পেছনের কোন এক ছায়ামানবী দাঁড়িয়ে। কে সে? ছায়ামানবী নড়ে উঠলো, তার মুখ থেকে বেড়ুলো শব্দের ঝংকার। সে যেন কোন এক পরিচিত কন্ঠস্বর! আমি আৎকে উঠলাম,
- আমি তো ভেবেছিলাম গল্পের সমাপ্তিটা তোমার আত্মহত্যার মধ্য দিয়েই হবে। তাতে তো আর হ্যাঁপি এন্ডিংটা হত না, তাই না? তাই গল্পের নায়িকাকে মেরে দিলে? এটা কি পয়েটিক জাস্টিস হলো? না না না, আমার এন্ডিং ভালো লাগছে না। তুমি বরং এন্ডিংটা রিরাইট করো। হ্যাঁপি এন্ডিং না হলে, আজকাল পাঠক খুব একটা গেলে না। তোমার ভাবতে হবে না, আমিই না হয় বলে দিচ্ছি তোমার গল্পের এন্ডিংটা?
তার প্রতিটা শব্দ সরাসরি বুকে এসে বিঁধছে। কেন সে! এভাবে তো আমি চাইনি!
- তুমি?
- আহা, শেষ করতে দাও। তো এন্ডিংটা হবে এমন, নায়িকা মারা যাবে না। নায়িকা বেঁচে থাকবে। তাদের মিলন হবে শেষমেশ। এই পদ্মারপাড়ই এন্ডিংটার উপযুক্ত জায়গা, বুঝলে তো? মিস্টার সাদ?
- তুমি কেন এখানে?
- ওমা, কি বলো তুমি আমি আসবো না?
- না, তোমার এখানে আসার কোন মানে হয় না।
- ও গড! কি হচ্ছে এইসব! তুমি আমাকে নিয়ে গল্প লিখবে, আমি জানবো না! মেনে নিলাম। গল্প শেষে আমাকে মেরেও ফেলবে? অদ্ভুত! অথচ এটাও আমাকে জানাবে না! তাহলে আমি কে? কেন? তোমার সাহস হয় কি করে আমার অনুমতি ব্যাতিরেকে আমার নাম পরিচয় তোমার ফালতু, থার্ড ক্লাস ড্রামায় ব্যবহার করার? উত্তর দাও আমাকে, আমাকে নিয়ে এভাবে নাটক নির্মাণের অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না! "এসব তুমি কি বলছো?"
- আহাহা, ন্যাকা সেজো না আর। আচ্ছা কুল ডাউন, এখনো তো তোমাকে বলাই হলো না, তোমার গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড পার্ট! তোমার মেয়ের মুখেই শুনো না হয়। মীরা বলো তো তোমার বাবাকে।
আমি মীরার মুখের দিকে তাকালাম। মীরা আমার থেকে মুখ সরিয়ে রেখেছে। কেন? ঘৃণায়?
- প্রথম থেকেই আমার খানিকটা সন্দেহ হচ্ছিলো, ঐ নামটা থেকেই। মান্তাশা। বলেছিলাম না নামটা কোথাও পড়েছিলাম বোধয়।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আমার সন্দেহটা আরো প্রবল হয়। এমন বোকা বোকা প্ল্যান তুমি করেছিলে বাবা। ভেবেছিলে কেউ হয়তো কিছুই বুঝতে পারবেনা। এখানে, কেউ মানে তো আমি। তুমি ভেবেছিলে আমি কিছুই বুঝতে পারবো না।
কিন্তু এটা ভুলে গিয়েছিলে আমি তোমারই মেয়ে! হাসপাতালের ঘটনাটা বাদ দিলেও, তুমি শামান্তা সমন্ধে আমার কাছে যা যা বলেছো তার আংশিক সত্য বলে মনে হয়েছে। একটা ঘটনা বলেছিলে, পা পিছলে পড়ে শামান্তার পায়ে চোট পাওয়ার ঘটনাটা। ওটা যে একদমই মেকি ছিলো আমি তখনই বুঝতে পারি। ওখানে খেয়াল করার মত অনেকগুলো পয়েন্ট ছিলো।
প্রথমত, শামান্তার আন্টির বাসা তোমার কথামত মিরপুরেই ছিলো। কারন তুমি বলেছিলে, তুমি তাকে ওর বাসায় রেখে আসো। কিন্তু এরপর বার বার তুমি এটাই বলতে চেয়েছো তোমাদের কোন যোগাযোগ হয়নি। তুমি তো ওর বাড়ির ঠিকানা জানতে। তাছাড়া, তোমার ফোনবুকেও তো তার নাম্বার সেইভ করা ছিলো, মান্তাশা নামে। তাহলে কেন? আর যেই মানুষটাকে তুমি এতটা চাও তার সাথে কোনরকম যোগাযোগ না রাখাটা কি অস্বাভাবিক নয়, যেখানে যোগাযোগের সুযোগ আছে।
তারপর আসি পায়ে চোট পাওয়ার ঘটনাটায়। ওর পায়ে চোট লাগলো, ও চিৎকার করলো, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো, ওর বাসার সামনে এসে ও চিৎকার করল আর ওর বাসা থেকে কেউ আসলো না? তাছাড়া ওর কাজিন তো ওর সাথে ছিল, সে কোথায় গেলো।
আর তোমার বর্ণনা থেকেও এটা আচ করতে অসুবিধা হলো না যে, তুমি যে গল্পটা আমাকে শুনাচ্ছো সেটা বাস্তব কিংবা সত্যি কোন ঘটনা নয়। হয় এটা তোমার কল্পনা নতুবা তোমার স্বপ্ন। স্বপ্ন হওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। তুমি কি বলো বাবা, ওটা কি স্বপ্ন ছিলো নাকি, কল্পনা?
- স্বপ্ন।
- আচ্ছা। এরপর থেকে আমার সন্দেহ চরম মাত্রায় পৌছে যায়। আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে এই শামান্তা। তুমি তার সমন্ধে আমাকে কেন বলছো না। যা বলছো তা ও মনগড়া। কেনো? আমার কাছে লুকাচ্ছো কেন? নাকি নিজের কাছেই লুকাচ্ছো।
এসব প্রশ্নের উত্তর কেবল মাত্র একজনই দিতে পারত। শামান্তা। অবশ্য তখনো আমার ধারণা ছিলো শামান্তা হয়ত তোমার কল্পনায় তৈরি করা কোন মানুষ। তারপরও খোঁজ করলাম। তোমার ডাইরি, ফোনবুক। এবং সৌভাগ্যবশত আমি পেয়েও যাই। শামান্তার নাম্বার। যেটা তুমি সেইভ করে রেখেছিলে মান্তাশা নামে। ব্যাস, আমার সন্দেহ ফলে গেলো। তুমি কিছু লুকাচ্ছো। তারপর আমি সরাসরি কল করি শামান্তা কে। তখন তুমি ঘুমাচ্ছিলে।
- কেমন আছো?
- হ্যাঁলো।
- কে সাদ না?
- না আমি মীরা, উনার মেয়ে।
- ও আচ্ছা, মীরা ভালো আছো?
- হ্যাঁঁ ভালো। আপনি ভালো আছেন?
- হ্যাঁঁ আছি। তো কি ব্যাপার?
- আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই। ইন পার্সন।
- আমার সাথে কথা বলতে চাও? কি ব্যাপারে?
- সেটা দেখা হলেই বলতে পারবো। খুবই জরুরি। এখুনি আসলে ভালো হয়।
- আচ্ছা ঠিক আছে। আমার বাসায় একটু ঝামেলা আছে। আজকে বড় ছেলে ইউকে ফিরে যাবে দুপুর নাগাদ। আমি তোমার সাথে বরং ৩টায় দেখা করি?
- আচ্ছা ঠিক আছে। কোথায় আসবেন?
- তুমি যেখানে বলো।
এরপরের গল্পটা আমি বলছি, সে বলে উঠলো, মীরা মার সাথে এসে দেখা করে সেন্ট পিটার্স এ। প্রথমে আমাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করে। আমি সেগুলো আর বলছি না। মোট কথা মীরা, আমাদের কি সম্পর্ক সেটা আদ্যপ্রান্ত জানতে চায়। আমিও কার্পণ্য না করে সবই বলি।
তারপরও যে গল্পটা আমায় শোনায়, তাতে আমার ভিমরি খাওয়ার মত অবস্থা আর কি। তোমার কান্ড কারখানার কথা শুনে সত্যি আমি এতটা অবাক হয়েছি। তবে এর শেষ্টা দেখার কৌতুহলও ছিল। তাই মীরাকে বললাম সঙ্গ দিতে। মীরা আমাকে প্রতিদিন কি কি ঘটলো সবই জানাতো।
কিন্তু সাদ, তুমি কেন করলে এমনটা? শুধু মাত্র মীরার থেকে তোমার একটা অপরাধকে ঢাকার জন্য? একটা মিথ্যে গল্প বানিয়ে শুনিয়ে দিলে মেয়েটাকে? এটা তুমি ঠিক করোনি সাদ। একদমই ঠিক করোনি। তুমি তো জানোই একদিন না একদিন সত্যিটা মীরা ঠিকই জেনে যাবে। তখন? তাহলে এত লুকোচুরির কি মানে হয়? তুমি ওকে সত্যিটা বললেই পারতে। তাতে হয়তো এখনকার মত এতোটা কষ্ট ও পেত না। চুপ করে আছো কেন তুমি? বলো মীরাকে সব নিজের মুখে খুলে বলো।
- তুমি কি ভেবেছ, শামান্তার মৃত্যুর মাধ্যমেই এই গল্পের শেষ? আরেকটুখানি বাকি আছে। সেই পুর্ণতাটুকো তোমাকেই দিতে হবে সোহানা।
- সোহানা? কে সোহানা? বাবা?
সোহানার দিকে তাকিয়ে মীরা জিজ্ঞেস করল,"আপনি শামান্তা নন?"
"না আমি শামান্তা নই। কিন্তু যখন থেকে রেজার সাথে দেখা ও তখন থেকেই ও আমাকে শামান্তা বলে ডাকত। কেন ডাকত জানি না। আজই প্রথম ওর মুখে আমার নামটা শুনলাম। হয়তো শামান্তা মারা গেছে তাই এ নামে আর আমাকে ডাকবে না। কিন্তু..."
তার আগেই আমি আমার কথা শেষ করতে চাই, "সোহানা আমি জানি আমি তোমার কাছে শেষবারের মত কিছু চাইলে তুমি না বলবেনা। তুমি কথা দাও মীরাকে দেখে রাখবে। আমি সব কিছু ঠিক করে রেখে গেছি। আমার উইলটা আমার লকারে রাখা আছে। তুমি মীরাকে সব বুঝিয়ে দিবে।
আর ওর বিয়ের আগ পর্যন্ত ওকে তোমার কাছে রাখবে। এখন তো তুমিও একা আছো। মীরা থাকলে তোমার অসুবিধা হবে না নিশ্চই?"
"বাবা, তুমি কি বলছো এইসব? তুমি কোথায় যাচ্ছ? এমনভাবে কেন কথা বলছ বাবা? কোথায় যাচ্ছ তুমি?"
" গল্প শেষ করতে!"
তখন অন্ধকার নেমেছে। চাঁদ আলো ছড়ায়নি এখনো। আমি এই অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম নিস্তব্ধতায়। যেখানে শামান্তা আছে, যেখানে তার হাসিমুখ উড়ে বেড়াচ্ছে। সেখানে নিজেকে এলিয়ে দিলাম। আমাকে এবার নিয়ে নাও। আমার নাসিকা- কর্ণ, মুখবিবর ফোঁরে জলের স্রোত ঝর্ণাধারার সৃষ্টি করেছে। তাঁরা আমকে মুক্তি দিতে এসেছে। আমার বদ্ধ শরির থেকে মুক্তি, আমার বদ্ধ ভাবনা থেকে মুক্তি। আমার থেকে আমাকে মুক্তি।
শরির জলের দখলে নিয়ে আমাকে ঠেলে দিলো গগনপানে। আমি এখন জোৎস্নার জন্য অপেক্ষা করছি। ততক্ষণ আমি মীরা আর সোহানা কে দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি মীরা জলের দিকে ছুটে আসতে চাইছে। সোহানা তাকে ধরে রেখেছে। কারণ, তাঁরা জানে না, আমি পাটাতন এর ফাঁকা কাঠের সুরঙ্গ দিয়ে নদীপথে শরীরকে বিলিয়েছি। সোহানা একবার ফায়ার ফোর্সকেও কল দেওয়ার কথা বললো। এবং কল দিল। তারা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
এখন আমার কর্ণ-চক্ষু হাজারগুন শক্তিশালি হয়েছে। এই অন্ধকারে আমি পিষ্ট দেখতে পাচ্ছি মীরা একটা বাদামি বর্ণের ওড়না গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। আমি ওর চোখের জলও পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ওর চোখের জলের রঙ নীল। মেয়েটা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি পাশে থাকলে স্বান্তনা দিতাম হয়তো।
না না, একি ভাবছি আমি। আমার জন্যই তো ও কাঁদছে। আমি থাকলে তো কাঁদতোই না। তাহলে স্বান্তনা কেনো। আমি দেখলাম সোহানা মীরার কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। মীরাকে সব সত্য বলার চেষ্টা করছে। কি সেই সত্য? আমিও শুনি। আমার কৃতকর্ম।
মীরা কেঁদেই চলেছে। ওর কান্নায় যোগ হয়েছে এবার প্রশ্ন, কেন আমি এমনটা করলাম! এতসব কিসের জন্য। আমি মীরাকে ছেড়েই বা কেনো চলে এলাম! সব প্রশ্নের উত্তর চাইছে মীরা। সোহানা উত্তর দিবে, যতটুকু তার জ্ঞানে আছে। আমার ধারণা সোহানা পুরোটাই বলবে, যতটা মীরার জানা জরুরি।
মীরা সোহানা কে জিজ্ঞেস করছে,"আচ্ছা তুমি বলছিলে কোন অপরাধ লুকানোর জন্য বাবা এসব করেছে। আমার বাবা কি অপরাধ করেছে? আর তুমি শামান্তা নাহলে নিজেকে শামান্তা নামে কেন পরিচয় দিলে? শামান্তা কে? তুমি কে? কে তুমি?
"মীরার কান্নার বেগ বেড়েই চলেছে। আমি আর দেখতে পারছি না ওর কান্নাভেজা চোখ। কিন্তু না চাইলেও এখন আমাকে দেখানো হচ্ছে। এখন আমার চোখ বলে কিছু নেই, যা বন্ধ করে জগতের আলো থেকে নিজেকে আধারে গুঁজে রাখবো। এখন সকল দৃশ্যই আমাকে দেখতে হবে, যা যা আমাকে দেখানো হবে। কিন্তু মীরার কান্না আমার কেন জানি সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। কোথায় কষ্ট হচ্ছে সেটা বোধগম্য হচ্ছে না।
সোহানা এবার মীরার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু তার আগে দুজনকেই শান্ত হতে হবে। সোহানা বড়সড় কোন গল্প বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এ গল্প শুনতে চাই শান্ত পরিবেশ এবং শান্ত মস্তিষ্ক। তাই মীরাকে আগে শান্ত হতে হবে কান্না থামিয়ে, এমনটাই বলছে সোহানা। তারপর কান্না থামলো।
ঝিঝিপোকা, যারা এতক্ষণ অবধি কান্নার আওয়াজের সাথে তাল মেলাচ্ছিলো তারাও হঠাৎ থেমে গেল। চারিপাশ কেমন জানি নিস্তব্ধ একটা রূপে সজ্জিত হলো। কোন গল্প শোনার জন্য এতো প্রস্তুতি? এই গল্পের গাম্ভীর্য্য বিবেচনায় প্রকৃতিও নিজেকে সাজিয়েছে, থমথমে এই সজ্জায়। সোহানা শুরু করলো,
- আমার সাথে সাদের পরিচয় হয় ভার্সিটিতে। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে ছিলাম। সেখান থেকেই আমাদের একটা ভালো বন্ধুত্ত্ব তৈরি হয়। অবশ্য বন্ধুত্ত্বের আরেকটা কারনও অবশ্য আছে, সেটা হলো প্রথম দিনই ওর উদ্ভট ব্যবহার।
আমাকে দেখা মাত্রই ও আমাকে শামান্তা নামে ডাকতে থাকে। আমি তো প্রথমে বুঝিনি আমাকে ডাকছে, পরে দেখলাম আমাকেই ডাকছে। এরপর আমি হাজার দিন হলেও ওকে শামান্তা সমন্ধে জিজ্ঞেস করেছি, ও হয়তো কোন বানোয়াট কোন গল্প বলে শুনাতো নতুবা কিছুই বলত না। একসময় আমিও হাল ছেড়ে দেই। কিন্তু আমি কখনোই জানতে পারিনি কে এই শামান্তা! সে কি সত্যি কোন মানবী নাকি সাদের কল্পনায় তৈরি করা কেউ?
আমার জানামতে সাদের কোন সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার ছিলো না। তাই একসময় এটা ধরে নেই, ও হয়তো ঠাট্টা করছে।
- কিন্তু কি অপরাধের কথা বলছিলে!
- "বলছি বলছি। গ্র্যাজুয়েশন শেষে, সাদ বিয়ে করে, বিয়েতে আমাদের দাওয়াত করে। আমরা, মানে ভার্সিটিতে আমরা যারা হিস্ট্রিতে ছিলাম। আমরা সবাই আসি। মজা হয় অনেক। সাদ সেদিন অনেক হাসিখুশি ছিল। এর আগে ওকে এতটা হাসিখুশি দেখিনি।
এরপর আর তেমন একটা যোগাযোগ হয়নি তোমার বাবার সাথে। আমিও আমার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দীর্ঘদিন দেখা সাক্ষাৎও হয়নি। প্রায় আট নয় বছর পর। একদিন সকালে দেখি আমার বাসার সামনে সাদ দাঁড়িয়ে! উদ্ভ্রান্ত চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম, কিছু একটা হয়েছে। ভেতরে নিয়ে আসলাম। বসালাম সামনে।
জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? ও কথা বলছে না। কান্না শুরু করে দিলো। আর বির বির করে কি যেন বলছে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ কান্নার পর একটু শান্ত হল।
- আমি পাপ করে ফেলেছি, অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি!
আমি মানুষ হিসেবে সাদ কে চিনি বা চিনতাম।ও কখনো বড়সড় ক্রাইম করতে পারে না। অন্তত সজ্ঞানে না। কিন্তু ওর অবস্থা দেখে যা মনে হচ্ছে, সত্যি কিছু একটা হয়েছে।
- কি অপরাধ করেছো?
- আমি মেরে ফেলেছি, আমি হুমায়রাকে মেরে ফেলেছি! আমি...
- কি বলছো এসব? পাগল হয়েছো নাকি। হুমায়রাকে কেন মারবে। একটু শান্ত হও, খুলে বলো সব কি হয়েছে। আচ্ছা এখন বলতে হবে না। তুমি রেস্ট নাও। তারপর বলো।
আমি ওকে একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেই, যাতে খানিকটা ঘুমিয়ে নেয়। এতে হয়ত কিছুটা প্রশান্তি পাবে। তারপর সব শোনা যাবে। ঘুম থেকে উঠে ও বলতে শুরু করে। আমি শুনে যাই। হুমায়রাকে বিয়ে করে সাদ খুশি ছিলো। ওদের দাম্পত্য জীবন বেশ ভালোই কাটতে থাকে। এক বছর পর ওদের প্রথম সন্তান, মানে তোমার ভাই আহনাফের জন্ম হয়। ওদের পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে যায় যেন। এভাবে সাতটা বছর ভালোই কাটে ওদের।
সমস্যাটা দেখা দেয় তোমার জন্মের পর। তোমার জন্মের পর এক মাসের মাথায়, একদিন হুমায়রা আবিষ্কার করে সাদের ফোনবুকে শামান্তার নাম্বার। সন্দেহবশত সাদের ডাইরি এবং অন্যান্য জায়গায়ও হুমায়রা খোঁজ করে এবং সেসব জায়গায়ও শামান্তার অস্তিত্ত্বের নিদর্শন পায়। সাদের ডাইরীতে লেখা সব গল্প পড়ে হুমায়রার সন্দেহ, বিশ্বাসে রূপ নেয়। বুঝতেই পারছো এখন কোন সমস্যাটা হয়।
স্বাভাবিকভাবেই ওদের দাম্পত্য জীবনে একটা দেয়াল গড়ে উঠে, শুরু হয় ঝগড়া। প্রায় রোজই ঝগড়া হত এই ব্যাপারে। সাদ হুমায়রাকে যতই বোঝানোর চেষ্টা করে এসব গল্প সব সত্যি নয়। শামান্তার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই, হুমায়রা ততই চেপে বসত। স্বামী- স্ত্রীর কলহে সন্তানের ভবিষ্যতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এই ভেবে, আহনাফকে পাঠিয়ে দেয় ডে কেয়ার এ।
তুমি অনেক ছোট ছিলে তাই তোমাকে সাথেই রাখে। এমনি একদিন ঝগড়া চলাকালীন, দুর্ঘটনাবশত হাতাহাতির এক পর্যায়ে হুমায়রা মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায়। হাসপাতালে নেয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। তোমাকে এবং আফনাফকে বলা হয়েছিলো সে রোড একসিডেন্টে মারা গেছে।
আসলে তোমার মা মারা গেছে তোমার বাবার হাতে, এমনটাই ধরণা করত তোমার বাবা। এ ঘটনার পর থেকে সাদ পালটে যায় অনেক। ও মনে করে শামান্তার সাথে ওর সম্পর্কের দরূণই মারা গেছে হুমায়রা। আর সাদ এটাও মনে করত সে ই খুন করেছে হুমায়রাকে। এই ধারণা ওর মনের মধ্যে গেথে থাকে। ফলে ভেতরে ভেতরে চাপা অপরাধবোধ ওকে শেষ করে দিচ্ছিলো। ও বেঁচে ছিলো সত্য কিন্তু বুকের ভেতর একটা ভারী আর চাপা দু:খ নিয়ে।
আমি দেখছি, মেয়েটা আমার শুধু চোখের জল ফেলছে। এত বছর পর বাবার কৃতি জেনে, বাবার জন্য শ্রদ্ধার জায়গায় হয়তো ঘৃণা জন্ম নিয়েছে। না, আমি ওর সামনে দাঁড়িয়ে কখনোই এ সত্যগুলো বলতে পারতাম না। আমি মীরার চোখে কখনোই তাকাতে পারতাম না। আমি অপরাধী।
সোহানা আবার শুরু করলো, "সাদ ছিলো ভীষণ চাপা স্বভাবের। সবার সাথে মিশতো না, তেমনই নিজের কথাও মানুষের কাছে তেমনভাবে প্রকাশ করতে পারতো না। ইন্ট্রোভার্টরা যেমন হয়। তাই সাদ এ কথাগুলো তোমাকে কখনোই বলতে পারত না।
কিন্তু ও জানতো সত্যটা তুমি একদিন জানতে পারবেই। তাই তোমার ভবিষ্যত নিশ্চিত করে, নিজে চলে গেছে। ওকে এখন আর তোমার চোখের সামনে দাড়াতে হচ্ছে না। এটাই হয়ত ও চেয়েছিলো, তুমি সত্যটা জানবে কিন্তু ও থাকবে না। যাতে তুমি ঘৃণা করার মানুষটির অস্তিত্ত্ব হারিয়ে ফেলো । অপরাধ আর অপরাধী একসাথেই জলের তলে চলে গেলো, ভালো হল না?
- কিন্তু এখনই কেন বাবা সুইসাইড করল? আরো আগেও করতে পারত?
- আরো আগে ও চলে গেলে, হয়তো তোমার ভবিশ্যত অনিশ্চয়তার মুখে পড়ত তাই আগে যায়নি। এখন তোমার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয়েছে। এখন নিজের জীবন নিজে দেখার জন্য তুমি প্রস্তুত। আমার ধারণা তোমার জন্য সাদ কোন ছেলেও ঠিক করে রেখে গেছে, তোমাকে বিয়ে করবে যে।
আর উইলটা পাওয়া গেলে হয়তো দেখবে, সেখানে তোমাকে সত্তর শতাংশ দিয়ে গেছে। আহনাফ এখন প্রতিষ্ঠিত, তাই তার জন্য হয়ত ত্রিশ শতাংশ। আমি জানি না, আমার ধারণা এটা। আসলে মীরা, তোমার বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসতো। সারাটাজীবন তোমার চোখে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে এমনটা ভেবেই হয়তো চলে গেলো ওর শামান্তার কাছে।
- কিন্তু এত্তসব কেনো করলো, শামান্তাকে নিয়ে এতকিছু কেন?
- ও তোমাকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলো, ও শামান্তাকে ভালোবাসে। শামান্তার স্মৃতি নিয়ে, কিংবা শামান্তাকে পেলে সব ছেড়ে দিতে রাজি আছে। যাতে হুমায়রার সাথে যা হয়েছিল তা কিছুটা আচ করতে পারো।
- আমার কিন্তু তা মনে হয় না, আমার বাবা, চাইলেই এই নাটকটাকে সত্য বলে বানাতে পারতেন। তার প্ল্যানে অনেক ফাঁক- ফোঁকর ছিলো। বাবাকে আমি চিনি, তিনি এমন ঢিলেঢালা কোন নাটক কেন করবেন, যা সহজেই বোঝা যায়? আমার ধারণা বাবা এটা অন্য কোন উদ্দেশ্যে করেছেন?
- অন্য উদ্দেশ্য? কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
- আরেকটা জিনিস খেয়াল করেছেন? বাবা, যদি সুইসাইডই করবেন তাহলে আমাদের জন্য অতটা সময় অপেক্ষা করলেন কেন?
- তোমাকে শেষবার দেখার জন্য হয়তো।
- উহু, এটা না। বাবা শেষে একটা গুরুত্ত্বপুর্ণ তথ্য আমাদের দিয়ে যান। উইলটা কোথায় আছে সেটা বলে যান। এর মানে হলো তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাই যদি হয় তাহলে তিনি প্ল্যানটা এভাবেই করেছিলেন যাতে আমি বুঝতে পারি এটা প্রি- প্ল্যানড যাতে আমরা তার পিছু নিয়ে এখান অবধি আসি আর তিনি শেষ অছিয়ত করে বিদায় নিয়ে চলে যান।
- এটা তো আমি ভেবে দেখিনি!
- তারপর আপনি কেন? আমি আপনার কাছে কেন গিয়েছিলাম? যাতে এই সব গল্প আপনি আমাকে জানান। আমি এটা আগে কেন বুঝতে পারলাম না! বাবার ফোনবুকে মান্তাশা নামের নাম্বারটা না পেলে হয়ত আপনাকেও আমি পেতাম না, আর আমি এসব গল্প জানতেও পারতাম না। বাবা, এটা ভুলবশত করেননি, বরং এটাই ছিল বাবার প্ল্যান! আমি বুঝতে পারিনি!
মীরা এখন হাত- পা ছুড়ছে চারিদিকে, নিজের ব্যার্থতায় ও এমনটাই করে সবসময়। আমি অনেকদিন ওকে বারণ করেছি রাগ উঠলে এমনটা না করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অভ্যাসটা যায়নি। কিন্তু এখন আর বারণ করার জন্য কেউ নেই।
সুতরাং হাত-পা ছুড়তে থাকো মীরা, তবে সাবধান। হাত-পায়ে চোট পেলে বাবার মত কে তোমার যত্ন করবে এখন? বাবা তো নেই আর! নিজের যত্ন এবার নিজেরই নিতে হবে। তাই সাবধান,মীরা।
- "কিন্তু শামান্তা কে? শামান্তা নামে আদৌ কেউ কি আছে? যদি না ই থাকে তাহলে তাকে নিয়ে এত কিছু কেন? দুটি জীবন কেন তার জন্য উৎসর্গ?"
মানুষ যদি কখনো সৃষ্টিকর্তার কাছে তার চরম অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব পাওয়ার সুযোগ পেতো, তাহলে মানুষ যেভাবে চাইতো, মীরা ঠিক তেমন আক্ষেপ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিচ্ছে শূন্যে। তার এ কথাগুলো আকাশে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
যেন পুরো সৃষ্টিজগতে এই মূহুর্তে মীরার কন্ঠস্বর ব্যাতিত অন্য কোন উপাদান নেই। আমার চারিপাশের সকল আওয়াজ ফিকে হতে শুরু করল। সকল বস্তু, কালোয় মিলতে লাগলো। বুঝলাম আমাকে আর দেখতে দেয়া হবে না, আমার শ্রবনশক্তি নিয়ে নেয়া হচ্ছে, আমার দেখার ক্ষমতা এখন আর নেই।
আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যাওয়ার আগে মীরাকে যদি বলে যেতে পারতাম, "মীরা, গল্পের পুরোটা মিথ্যে নয়, পুরোটা গল্পও নয়। গল্পের মধ্যে লুকিয়ে আছে গল্পকারের প্রিয় সত্যিগুলো। সত্যিগুলো খোঁজার দায়িত্ত্ব আমি তোকে দিলাম। আমি জানি তুই পারবি"।
আরও পড়ুনঃ এরপর - জীবন থেকে নেওয়া গল্প