কে ছিলেন ধন্বন্তরিঃ দেবতা চিকিৎসক নাকি শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক চরিত্র

চিকিৎসাশাস্ত্রে সুচিকিৎসা এবং ধন্বন্তরি একে অপরের সমর্থক। কে ছিলেন এই ধন্বন্তরি এরূপ প্রশ্ন হয়তো অনেকের মনেই এসেছে। আজকের এই বিশেষ আয়োজনে জানবো কে ছিলেন ধন্বন্তরি এবং তাকে নিয়ে কি বলছে পৌরাণিক গাঁথা এবং মধ্যযুগের সাহিত্য।

কে ছিলেন ধন্বন্তরিঃ দেবতা চিকিৎসক নাকি শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক চরিত্র
কে ছিলেন ধন্বন্তরিঃ দেবতা চিকিৎসক নাকি শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক চরিত্র


ভারতীয় পৌরাণিক গাঁথা বাংলা সাহিত্য তথা চিকিৎসাশাস্ত্র সব জায়গাতেই ধন্বন্তরি নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। এমনকি উজ্জয়িনীর সম্রাট বিক্রমাদিত্যের রাজসভার নবরত্ন ধন্বন্তরি নামক এক ব্যক্তির সন্ধান মেলে। কে ছিলেন এই ধন্বন্তরি এমন প্রশ্ন নিয়ে জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই।


বাস্তবে কি তার কোনো অস্তিত্ব ছিল নাকি তিনি ছিলেন শুধুমাত্র একজন কাল্পনিক চরিত্র এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি আজকের লেখাতে। এখানে প্রাচীন পুরাণ, মধ্যযুগের সাহিত্য এবং প্রচলিত কল্পকাহিনীর মাধ্যমে ধন্বন্তরির অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। 


প্রাচীন যুগে ধন্বন্তরি 

প্রাচীন সনাতন ধর্মগ্রন্থগুলোতে ধন্বন্তরির উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে ধন্বন্তরি কে দেবতাদের চিকিৎসক হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রাচীন পুরান উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থে ধন্বন্তরি কে দেবতাদের চিকিৎসক হিসেবে দেখানো হয়েছে যেখানে ধন্বন্তরি ছিলেন একজন অব্যর্থ চিকিৎসক।


আয়ুর্বেদ সহ আধুনিক শল্যবিদ্যা মত চিকিৎসা ক্ষেত্রগুলোতে ধন্বন্তরি প্রসিদ্ধ ছিলেন। মহাভারতের আদি পর্ব অনুসারে যখন সমুদ্র মন্থন হয়েছিল তখন ধন্বন্তরি কে অমৃত হাতে সমুদ্র থেকে উঠে আসতে দেখা গিয়েছিল। একদা অমৃত কে কেন্দ্র করে দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলে অমৃত সমুদ্রে পতিত হয়।


অমৃত কে পুনরায় ফিরে পাওয়ার জন্য দেবতা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে বিষ্ণু কচ্ছপের রুপ ধারণ করে এবং সমুদ্র অবস্থান নেয়। তার পিঠের উপর বিশাল মান্দারপুর পতনের জন্য প্রতিস্থাপন করা হয়। এবং নাগ রাজ কে ঋজু হিসেবে ব্যবহার করে সমুদ্রমন্থনের কাজ শুরু হয় যার একপাশে দেবতারা এবং অন্য পাশের অসুরেরা মন্থন কার্য শুরু করে।


সমুদ্র মন্থনের ফলে প্রথম উৎপন্ন হওয়া গরল পান করে মহাদেব নীলকন্ঠ নাম ধারণ করেন। অপরদিকে একেকটি সমুদ্র মন্থনের ফলে মাতা লক্ষী, ঐরাবত, পারিজাত বৃক্ষ ইত্যাদি বের হয়ে আসে। সমুদ্রমন্থনের শেষ ফল হিসেবে অমৃত হাতি ধন্বন্তরি উৎপন্ন হয়। এই ধন্বন্তরি কে পরবর্তীতে দেবতাদের চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তবে পৌরাণিক কাহিনীর বর্ণনা অনুযায়ী ধন্বন্তরি কে ভগবান বিষ্ণু তার পুত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন। 


আরও পড়ুনঃ জানুন পাঁচজন পৌরাণিক খলনায়ক সম্পর্কে


দ্বাপর যুগে ধন্বন্তরি

পূর্ব জন্মে ধন্বন্তরি দেবতাদের পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিধায় তিনি যজ্ঞের অধিকারী ছিলেন না। এমত অবস্থায় ধন্বন্তরি শ্রী নারায়নের তপস্যা করেন। তার তপস্যাতে সন্তুষ্ট হয়ে শ্রী নারায়ন ধন্বন্তরি কে এই আশীর্বাদ করেন যে পরবর্তী যুগে দ্বাপর যুগে ধন্বন্তরি পুনরায় জন্ম গ্রহণ করবেন এবং খ্যাতি লাভ করবেন। দ্বাপর যুগ উপস্থিত হলে ধন্বন্তরি সোম বংশে জন্মগ্রহণ করে।


এসময় তিনি কাশীরাজ ধন্বন্তরি নামে বিখ্যাত হন। দ্বাপর যুগে তিনি মহর্ষি ভরদ্বাজ এর কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করেন। কাশীরাজ ধন্বন্তরি অথর্ববেদ কে প্রথমে আটটি অংশে বিভক্ত করেন। তারই কর্মের দরুন চিকিৎসাশাস্ত্র অনেক দূর অগ্রসর হয়। এ থেকে ধারণা করা যায় তিনি ছিলেন মহাজ্ঞানী। 


ধন্বন্তরির মূর্তি ও পূজা

পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী ধন্বন্তরি সুঠাম যুবক। তিনি ছিলেন অতুলনীয় রোগ এবং কাঠিন্যের অধিকারী। এসময় ধন্বন্তরি কে চতুরহস্ত ধন্বন্তরি রূপে কল্পনা করা হয়। ধন্বন্তরি চারটি হাতে থাকতো শঙ্খ, অমৃতবাভান, জোক, এবং সবুজ গুল্মলতা।


তবে দক্ষিণ ভারতে বেশকিছু মন্দিরে ধন্বন্তরি কে পুজো করতে দেখা যায়। যেখানে ধন্বন্তরির প্রতিমাকে চতুর হস্তেল নির্মাণ করা হয়েছে। ধন্বন্তরি তের প্রতিমার চারটি হাতে থাকতো শঙ্খ, চক্র, অমৃতণান এবং সবুজ গুল্মলতা। তিনি চক্র মন্ত্র দ্বারা পূজিত এবং অনেক সময় ধন্বন্তরি ব্রত রাখতেও দেখা যায়।


আরও পড়ুনঃ আম্রপালি আমের নামকরণের ইতিহাস


মধ্যযুগীয় সাহিত্যে ধন্বন্তরি 

পৌরাণিক চরিত্র এবং দেবতাদের চিকিৎসক ধন্বন্তরির অস্তিত্ব মধ্যযুগীয় সাহিত্যেও দেখা যায়। মনসামঙ্গল পদ্মপুরাণ এর মত গ্রন্থগুলোতে ধন্বন্তরির অস্তিত্ব রয়েছে। তবে পৌরাণিক গাধার সাথে এধরনের সাহিত্যের মিল হচ্ছে উভয় ক্ষেত্রে ধন্বন্তরি কে একজন চিকিৎসক হিসেবে দেখানো হয়েছে। 


বিক্রমাদিত্যের ধন্বন্তরি

প্রাচীন ভারতবর্ষের গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী সম্রাট বিক্রমাদিত্যের সভাসদদের মধ্যেও ধন্বন্তরি নামক এক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। সমুদ্রগুপ্তের পুত্র বিক্রমাদিত্য ছিলেন ভারতের উজ্জয়িনীর শাসক। সে সময় প্রতিটি রাজ্যের রাজ দরবারে নয় জন গুণী মনীষীদের কে নিয়ে নবরত্ন সভা গঠিত হতো।


এ ধরনের নবরত্ন সভার মধ্যে রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভা, সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভা এবং রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নবরত্ন সভার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন অমর সিংহ, কালিদাস, ক্ষপণক, ঘটকর্পর,,বরাহমিহির, বররুচি,বেতাল ভট্ট ও শংকুর পাশাপাশি ধন্বন্তরি অবস্থান ছিল উজ্জল। তিনি ছিলেন সম্রাট বিক্রমাদিত্যের রাজসভার চিকিৎসক এবং আয়ুর্বেদাচার্য। 


আরও পড়ুনঃ ভারতের কয়েকটি রহস্যময় গ্রাম যা আপনি বিশ্বাস করবেন না


পৌরাণিক গাঁথা হোক অথবা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য অথবা বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় হোক না কেন ধন্বন্তরির যে পরিচয় পাওয়া যায় তার সর্বক্ষেত্রে তাকে একজন চিকিৎসক হিসেবে দেখা যায়। বস্তুত ধন্বন্তরি শব্দটির অর্থ হচ্ছে একজন চিকিৎসক বা চিকিৎসক। যার চিকিৎসা অব্যর্থভাবে কার্যকর।


তাই কালের পরিক্রমায় আজও ধন্বন্তরি কে সুচিকিৎসার সাথে তুলনা করা হয়। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় পার করে সুচিকিৎসা জন্য চিকিৎসা শাস্ত্রে আজও ধন্বন্তরি একটি সমর্থক শব্দ হিসেবে রয়ে গেছে।