ক্লিভল্যান্ড টর্সো কিলারের সম্পূর্ণ ইতিহাস
আমেরিকার মোট ৫২ টি স্টেট এর মধ্যে অন্যতম একটি হল ওহাইও স্টেট। আর এই স্টেট এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হল ক্লিভল্যান্ড শহর। কায়াহোগো নদীর পাশে অবস্থিত এই শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৯৬ সালে। সিটি হল, কায়াহোগো কোর্ট হাউজ, বিভিন্ন রকমের জাদুঘর সহ চমৎকার সব স্থাপনা নিয়ে ক্লিভল্যান্ড শহর টি গঠিত। তবে শুরুর দিকে শহরটিতে এতটা সৌন্দর্য এবং মাধুর্যতা বজায় ছিল না। বেশ কিছু খুন এবং অপরাধ এ শহরটিকে অন্যতম জঘন্য শহরের তালিকায় এনে দিয়েছিলো ।

১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ক্লিভল্যান্ড শহরে মোট ১৩ জন খুন হন, যাদের মধ্যে ৬ জন ছিলেন নারী এবং বাকি ৭ জন ছিলেন পুরুষ।
খুন হওয়া নারী ও পুরুষদের মধ্যে কেউ ছিলেন যৌনকর্মী, কেউ ছিলেন গৃহহীন আবার কেউ ছিলেন ভবঘুরে।
সবগুলো খুনই একজন সিরিয়াল কিলার দ্বারা সম্পন্ন এবং খুনের পর লাশ গুলোর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা ছিল। খুনের এ জঘন্য রকম ধরনের জন্য সিরিয়াল কিলারটির নাম দেয়া হয়েছিল ক্লিভল্যান্ড টর্সো কিলার।
খুনগুলোর বর্ণনা দেবার আগে প্রাচীন ক্লিভল্যান্ড শহরের একটু বর্ণনা দেওয়া দরকার। বর্তমানের সভ্য ক্লিভল্যান্ড শহরের মতো এতটা সভ্য তৎকালীন ক্লিভল্যান্ড শহর ছিল না।
মদ, জুয়া, পতিতালয় সহ এমন কোন অপরাধ নেই যার অস্তিত্ব সেখানে ছিল না। উচ্চবিত্ত এবং সভ্য পরিবারের কেউ সেখানে বসবাস করার সাহস পেত না।
সেখানকার অধিবাসীরা বেশিরভাগই ছিল অসচ্ছ্বল এবং খুবই নোংরা একটা পরিবেশে তারা বসবাস করতো।
খুনের সূচনা ঘটে সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৩৪ সালে। এদিন ৩০ বছর বয়সী একজন অজ্ঞাত মহিলার লাশ পাওয়া যায় লেক ইরি এর তীরবর্তী অঞ্চলে।
ঠিক লাশ বললে আসলে ভুল হবে, লাশের অংশ বিশেষ বলা যেতে পারে। শুধু ঘাড় থেকে শুরু করে ঊরুর কিছু অংশ পাওয়া গিয়েছিলো কিন্তু কোন মাথা পাওয়া যায়নি।
শরীরের যেসব অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল, সেগুলোতে লালচে একধরনের প্রিজারভেটিভস পাওয়া গিয়েছিলো।
সেপ্টেম্বর ২৩, ১৯৩৫ সালে দ্বিতীয় ভিকটিম, ২৮ বছর বয়সী এডওয়ার্ড অ্যানড্রাসি নামের একজন ভদ্রলোকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
লাশের গায়ে কোন ধরনের কাপড় ছিল না, তার সমস্ত শরীর থেকে সমস্ত রক্ত শুষে নেয়া হয়েছিল এবং তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছিল।
একই দিনে তৃতীয় ভিকটিম একজন অজ্ঞাত ৪০ বছর বয়সী লোকের লাশ পাওয়া যায়। এই লোকের মাথা এবং পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়া হয়েছিল।
লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হল, এই লাশেও প্রথম লাশটির মতো লালচে একটা কেমিক্যাল প্রিজারভেটিভস পাওয়া যায়।
জানুয়ারি ২৬, ১৯৩৬ সালের দিকে চতুর্থ ভিকটিম ফ্লোরেন্স পোলিলো নামের একজন মহিলার দ্বিখন্ডিত লাশ পত্রিকায় মোড়ানো অবস্থায় ডাস্টবিনে পাওয়া যায়।
পোলিলো ছিলেন একজন যৌন কর্মী। সেই সাথে তিনি একটি মদের বারে মদ সার্ভ করতেন।
জুন ৫, ১৯৩৬ সালে পঞ্চম ভিক্টিম, একজন অজ্ঞাত ব্যাক্তির কাটা মাথা ট্রাউজারে পেঁচানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বাকি অংশ পাওয়া যায় পরের দিন পুলিশ বিল্ডিং এর সামনে।
জুলাই ২২, ১৯৩৬ সালে ষষ্ঠ ভিক্টিম একটি অজ্ঞাত চল্লিশ বছর বয়সী লোকের লাশ উদ্ধার করা হয় ক্লিনটন রোডের পাশ থেকে।
এই লাশটির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ব্যাপার লক্ষণীয়। লাশটির বয়স ছিলো দুই মাস এবং লাশের পাশে রক্ত পাওয়া গিয়েছিলো। এ থেকে বোঝা যায়, খুনটি সেখানেই সংঘটিত হয়েছে।
সেপ্টেম্বর ১০, ১৯৩৬ সালে সপ্তম ভিক্টিম, একজন অজ্ঞাত লোকের লাশ পাওয়া যায় রেল লাইনের পাশে। এতগুলো খুন হয়ে যাওয়ায় জনগণকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখা গেলো। প্রায় প্রতিটি খুনেরই লোমহর্ষক বর্ণনা পত্রিকায় ছাপা হয়।
ফেব্রুয়ারি ২৩, ১৯৩৭ সালে অষ্টম ভিক্টিম, একজন অজ্ঞাত মহিলার দেহের কিছু অংশ পাওয়া যায়, ব্রাতেনহাল এর পূর্ব পাশে।
জুন ৫, ১৯৩৭ সালে নবম ভিক্টিম যার নাম ছিল রোজ ওয়ালাস, তার শরীরের হাড় উদ্ধার করা হয়, লরেইন কারনিগে নামক একটি ব্রিজের পাশ থেকে।
জুলাই ৬, ১৯৩৭ সালে দশম ভিক্টিম ৩০ বছর বয়সী একজন অজ্ঞাত লোকের লাশ পাওয়া যায় কায়াহোগো নদীর ওপর থেকে।
মে মাসের ১৯৩৮ সালে একাদশ ভিক্টিম, একজন অজ্ঞাত মহিলার লাশ পাওয়া যায় কায়াহোগো নদীর ওপর থেকে।
এতগুলো খুন যখন হতে থাকে, তখন ক্লিভল্যান্ড শহরের তৎকালীন মেয়র হ্যারল্ড বারটন এই খুনের রহস্য সমাধানের দায়িত্ব দেন এলিয়ট নেসকে।
আপনারা হয়তো এলিয়ট নেসকে চিনে থাকবেন, কারণ তৎকালীন সময়ে এলিয়ট নেসের স্বীকৃতি ছিল বিশ্বব্যাপী।
মূলত তার কাজই তার এই স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলো। আল কাপোন {স্কারফেস} সহ আরও বড় বড় মাফিয়াদের আইনের আওতায় আনতে এলিয়ট নেসের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। আর এভাবেই তার খ্যাতি সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
এবার একটু শেষ দুইজন ভিক্টিম নিয়ে কথা বলা যাক। অগাস্ট ১৬, ১৯৩৮ সালে দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ ভিক্টিম, দুজনেই ছিলেন অজ্ঞাত এবং দুজনের বয়সই ৩০ এর কাছাকাছি, তাদের লাশ উদ্ধার করা হয় সবচেয়ে আশ্চর্যজনক জায়গা থেকে।
এলিয়ট নেসের অফিসের সামনে থেকে। এলিয়ট নেস দায়িত্ব নেবার পর খুনি তাকে বিদ্রূপ করার জন্যই এ কাজটি করেছে।
তবে এলিয়ট নেস কি শেষ পর্যন্ত জানতে সক্ষম হয়েছিলেন যে খুন গুলো কে করেছিলো?
পুরোপুরি না জানতে পারলেও মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে কেস এক্সপার্ট জেমস ব্যাডেল এই কেসটি নিয়ে গবেষণা করেন এবং তার সাসপেক্ট এর সাথে তিনি এলিয়টের সাসপেক্টের মিল পান।
কারা ছিলেন সেই সাসপেক্ট?
ফ্র্যাংক ডোলাজল
ফ্র্যাংক ডোলাজলকে মূলত গ্রেফতার করা হয়েছিলো ফ্লোরেন্স পোলিলোর ( চতুর্থ ভিক্টিম) সাথে সম্পর্ক থাকার জন্য।
আর এজন্যই তৎকালীন ক্লিভল্যান্ড শেরিফ তাকে প্রচণ্ড রকম মারধর করে এবং স্বীকার করতে বাধ্য করায় যে সে ই সকল খুন করেছে। অথচ খুনগুলোর সাথে তার নূন্যতম কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় নি।
শেরিফ ও তার লোকজন জেলের ভিতর ডোলাজলকে মারতে মারতে মেরেই ফেলে। এ ঘটনা জানাজানি হলে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
একটি নিরপোরাধ মানুষের ওপর এমন জঘন্য অত্যাচারের প্রেক্ষিতে শেরিফ পরবর্তীতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ডাক্তার ফ্র্যান্সিস ই সুইনি
বলা হয়ে থাকে ফ্র্যান্সিস ই সুইনি হলেন জেমস ব্যাডেল এবং এলিয়ট নেস দুজনেরই প্রিয় সাসপেক্ট। যেহেতু সুইনি একজন ডাক্তার ছিলেন, তার অবশ্যই মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গ প্রতঙ্গ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা ছিল।
এছাড়াও তার মধ্যে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, যেমন তার অতিরিক্ত মদ্যপানের নেশা ছিল। এছাড়াও তিনি তার স্ত্রী এবং তার ছেলেমেয়ের গায়ে প্রচন্ড রকমের হাত তুলতেন।
তার মেডিকেল প্র্যাকটিসের প্রতি নেশাও অনেকটা কমে গিয়েছিলো। এলিয়ট নেস সুইনির ওপর একটা সিক্রেট পলিগ্রাফ টেস্ট চালান। পলিগ্রাফ টেস্টের জনক লেনোর্ড কিলারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সুইনি পলিগ্রাফ টেস্টে দুইবার ই ব্যর্থ হন। লেনোর্ড তখন এলিয়ট নেসকে বলেন, "আমি এই টেস্টটি আবিষ্কার করেছিলাম, আমিই তোমাকে বলছি সুইনিই খুনি, সে ই টর্সো কিলার। আমার মেশিন যদি ভুল হয়, তাহলে আমি সেটা জানালা দিয়ে ফেলে দিবো।"
এলিয়ট নেস অবশ্য টেস্টটি কোর্টে নিয়ে যেতে পারেন নি, কারণ সুইনির চাচা ছিলেন তৎকালীন সময়ের ক্ষমতাবান সাংসদদের মধ্যে একজন।
যার কারণে এলিয়ট নেস সুইনিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এজন্যই হয়তো শেষ দুইজন ভিকটিম অর্থাৎ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ ভিকটিমদের লাশ পাওয়া যায় এলিয়ট নেসের অফিসের সামনে, এলিয়ট নেসকে বিদ্রূপ করার জন্য।
অবশ্য পরে সুইনিকে একটি মেন্টাল ইন্সটিটিউটে ভর্তি করানো হয়। সেখানে সুইনির মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণ পান চিকিৎসকেরা।
সুইনি মেন্টাল ইন্সটিটিউটে ভর্তি হবার পর ক্লিভল্যান্ড শহরে সে রকম আর কোন খুনের ঘটনা ঘটেনি।