খাগড়াছড়ির আঞ্চলিক খাবার ও বৈচিত্রময় একদিন

বন্ধুরা মিলে ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। ভ্রমণের কথা চিন্তা করলেই নিজের ভিতরে এক অন্যরকম অনুভূতি শুরু হয়। দেশের মধ্যে ভ্রমণের চিন্তা করলেই মনে হয় সমুদ্র কিংবা পাহাড়। এবার আমাদের ইচ্ছে হলো শহরের কোলাহল থেকে দূরের উঁচু পাহাড় দেখবো।

খাগড়াছড়ির আঞ্চলিক খাবার ও বৈচিত্রময় একদিন
খাগড়াছড়ির আঞ্চলিক খাবার ও বৈচিত্রময় একদিন


করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন আমরা গৃহবন্দি। ঘরে বসে বসে যখন বিরক্তিরসীমা অতিক্রম হতে লাগল তখন বন্ধুরা মিলে ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম।


ভ্রমণের কথা চিন্তা করলেই নিজের ভিতরে এক অন্যরকম অনুভূতি শুরু হয়। দেশের মধ্যে ভ্রমণের চিন্তা করলেই মনে হয় সমুদ্র কিংবা পাহাড়।


এবার আমাদের ইচ্ছে হলো শহরের কোলাহল থেকে দূরের উঁচু পাহাড় দেখবো। আমাদের ইচ্ছের কথা খাগড়াছড়ির বন্ধু স্বপ্নীলের কাছে বললাম এবং পরামর্শ চাইলাম।


পরিকল্পনার কথা শুনেই আমাদের উষ্ণ নিমন্ত্রণ জানালেন বন্ধু। এবার চার বন্ধু মিলে ঢাকা থেকে রওনা দিলাম খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে।


ব্যস্ত শহরের বুকে বাস চলছে আপন গতিতে। মাঝ রাতে বাস এসে পৌঁছালো কুমিল্লায়। ভ্রমণ বিরতিতে হাল্কা নাস্তা সেরে নিলাম।


বাসে উঠে সুপারভাইজারকে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কয়ারে নামিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।


রাত শেষে, ভোরে পাহাড়ি রাস্তায় বাস চলছে হেলে-দুলে। দোলতে দোলতে ঘুম ভাঙলো সবার। জানালা দিয়ে ভোরের আলো আসতে শুরু করেছে।


চোখ মেলে জানালা দিয়ে তাকাতেই বুঝতে পারলাম আমরা এখন পাহাড়ের চূড়ায়। বাস থেকে পাহাড়ের খাঁদ দেখা যাচ্ছিল।


সবুজ চাঁদরে ঢাকা পাহাড়, তার মধ্য দিয়ে আঁকা-বাঁকা পথে বাস চলছে। সবুজ সমাহারের বিশালতা দেখে মন আর মানছিলো না।


তাই সম্পূর্ণভাবে জানালা খুলতেই গাছের পাতা থেকে ছিটকে আসা জল আর হিমেল হাওয়া যেন প্রকৃতির মাঝে আমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে।


কিছুক্ষণের মধ্যেই খাগড়াছড়ি জেলার প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলাম শহরের ভিতর। সকাল সাতটায় আমরা পৌঁছালাম সেই চেঙ্গী স্কয়ারে।


বাস থেকে নামা মাত্রই স্বপ্নীল বন্ধুর দেখা মিললো। বন্ধুর সাথে এবার বুকিং দেওয়া হোটেলের দিকে চললাম। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে আমরা বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়লাম।


দুপুরে বন্ধুর ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙ্গল। স্বপ্নীলদের বাসায় নিমন্ত্রণের কথা ঘুমের মধ্যে ভুলেই গিয়েছিলাম। ঝটপট রেডি হয়ে এবার বন্ধুর বাসার দিকে রওনা হলাম।


আধাঘন্টার কম সময়ের মধ্যেই তাদের বাসায় পৌঁছে গেলাম। বাসার সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে নাস্তার জন্য বসলাম।


সকালের নাস্তার আয়োজন বেশ। নাস্তায় রয়েছে কলাপাতায় মোড়ানো বিন্নি চালের গুড়ো এবং নারকেল দিয়ে তৈরি পিঠা বেনীহোগা (সরু লম্বাটে ধরণের) ও হলাপিদে (ত্রিকোণাকার) এবং স্থানীয় পাহাড়ী পেপে, কমলা ও আপেল।


কলা পাতায় মোড়ানো ভাপে তৈরি এ পিঠা আগে আমাদের কেউ খায়নি; বিন্নি চালের সাথেও পরিচয় এই প্রথম। নতুন এ পিঠা স্বাদ ও ঘন্ধে বেশ, ফলে আমাদের পেটেও চলে গেলো বেশ ভালো পরিমাণেই।


নাস্তা পরবর্তী একটু বিশ্রাম ও আলাপের পর আমরা মধ্যহ্নভোঁজের জন্য বসে গেলাম। ডাইনিং টেবিলে বসে আমরা সকলেই অবাক!


বাহারি সব আঞ্চলিক খাবারে ডাইনিং টেবিল পরিপূর্ণ। খুব সাধারণ কারণেই বেশিরভাগ খাবারই আমাদের অপরিচিত তবে প্রতিটি খাবারই ঘ্রাণে ও দেখতে বেশ লোভণীয়।


খাবারের পদগুলি হচ্ছে- হাত্তল টোন (কাঁচা কাঠালের সাথে চিংড়ি ও ছুড়ি শুটকি দিয়ে তৈরি তরকারি), সুগুনি হোরবো (ছুড়ি শুটকি পুড়িয়ে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে তৈরি ভর্তা), মাজ হেবাং (নানা ধরনের ছোট ছোট দেশি মাছ কলাপাতায় ভাপে রান্না করা তরকারি), হুরো এ্যরা (মুরগের মাংস), সবারাং দি পাবদা মাজ (কলাপাতায় ভাপে রান্না করা পাবদা মাছের তরকারি), ডিমভূনা, বাঁধাকপি আর বরবটি সেদ্ধ, সাদা ভাত ও বিন্নি চালের ভাত।


সবগুলো পদের খাবার দেখতে যেমন চমৎকার ছিলো স্বাদেও তেমনই অতুলনীয়।


খাবারের পর বিশ্রাম শেষে বের হলাম শহর ঘোরার উদ্দেশ্যে। প্রথমেই স্বপ্নীল আমাদের নিয়ে গেল চেঙ্গী নদীর পাড়ে।


শীতকাল হওয়ায় নদীতে বেশি জল ছিল না। তবে যেটুকু ছিল, তা বেশ স্বচ্ছ। নদীর ওপারে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছোট-ছোট ঘর।


পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন প্রজাতির সবুজ গাছ-গাছালি। নদীর পাড় থেকে তাকালে মনে হয়, প্রকৃতির দেবী নিজ হাতে সবুজ রঙ-তুলি দিয়ে পাহাড়ের আদ্যোপান্তে এক অপরূপ দৃশ্য তৈরী করে রেখেছেন।


এই দৃশ্যের অনেকটা সৌন্দর্য্য যেন নদীর স্বচ্ছ জলধারা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাখিরা পাহাড় থেকে নদীতে আবার নদী থেকে সবুজ পাহাড়ে ডুবে যাচ্ছে।


এটিই মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বাস্তুসংস্থানিক ঐকতান। শ্রুতিমধুর সুরের ঐকতান শোনার মতো ওই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে চোখে নেমে এসেছিলো এক প্রশান্তি! হঠাৎ সাইফুর ডেকে বললো, বেশ ক্ষুধা পেয়েছে।


স্বপ্নীল সবাইকে ডেকে নিয়ে শহরের পাশ্ববর্তী একটি বাজারের দিকে চললো। এই বাজারে মূলত খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পাহাড়ে আদিবাসিদের চাষ করা তরি-তরকারি ও যাবতীয় সব পণ্য পাওয়া যায়। বাজারে গিয়ে অনেকটা অবাক হলাম।


সেখানে বেশিরভাগ দোকানীই নারী। তাদের কাছ থেকেই আবার নারী-পুরুষ সবাই তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করছেন। বাজারে নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান। সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই।


এবার আমরা বাজার থেকে খানিক দূরের একটি স্থানীয় রেঁস্তোরায় গেলাম সেখানকার বিখ্যাত ‘পাঁজন’ নামক একটি খাবার খেতে।


এটি প্রায় ১২ ধরনের সবজির সমন্বয়ে তৈরী একটি খাবার। রেঁস্তোরাটিও দেখতে বেশ সুন্দর। বাঁশ-কাঠের সমন্বয়ে রেঁস্তোরার ডিজাইন বেশ নান্দনিক।


ভেতরে অনেকেই বসে খাচ্ছে। আবার কেউ খাবারের অপেক্ষা বসে। হালকা ভলিউমে চলছে আঞ্চলিক গান। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেই এলো আমাদের সেই কাঙ্খিত ‘পাঁজন’।


হরেক রকমের সবজির মিশ্রণে গন্ধটাও বেশ লোভনীয়। রুটির সাথে খেতে হয় এই পাঁজন। খাওয়া শেষে স্বপ্নীলের কাছে তাদের আরও কিছু আঞ্চলিক খাবার খাওয়ার ইচ্ছে জানালাম।


আমাদের আগ্রহ দেখে বন্ধু নিয়ে গেল শহরের আরেকটি মোড়ে। সেখানে বার্মিজদের বিখ্যাত একটি খাবার ‘মুংডি’ পাওয়া যায়।


এটি মূলত বার্মিজদের তৈরী এক ধরনের স্যুপ নুডুলস। দোকানে বসার খুব অল্প সময়ের মধ্যে চলে আসলো সেই বিখ্যাত স্যুপ। প্রথম চুমুকেই আমরা বেশ ঝাল অনুভব করলাম।


ঝাল খাওয়ার খুব একটা অভ্যাস না থাকায় আমি ও নিলয় অল্পতেই থেমে যাই। কিন্তু স্বপ্নীল, তনক, সাইফুর ও আকাশ বেশ মজা নিয়েই শেষ করল ‘মুংডি’।


এখানে একজনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই। তনক দেওয়ান হচ্ছে স্বপ্নীলে খুব কাছের বন্ধু। ইতোমধ্যে সেও আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে যুক্ত হয়েছে।


এদিকে বেশ রাত হয়েছে। তবুও আমরা শহরের শাপলা চত্বরের বিভিন্ন শপিং মলে একটু ঢুঁ মারলাম।


স্থানীয় দুই বন্ধুর কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। পৃথিবীর এমন কঠিন দুর্দশার মুহুর্তে আমাদের ভ্রমণকে সফল, আনন্দঘন ও রোমাঞ্চকর করে তোলার অবদান পুরোটাই তাদের।


এমন বৈচিত্রপূর্ণ অভিজ্ঞতা ও প্রকৃতির খুব কাছে যাওয়ার জন্য আমরা বার বার পাহাড়ে আসতে চাই।


পরবর্তী পর্বে রিছাঙ ঝরণা, আলুটিলা গুহা ও স্বর্গের সিড়ির অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো।


আমাদের দলের সবার পরিচয় হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিম নিলয়, সাইফুর রহমান, মেহেদী হাসান আকাশ, স্বপ্নীল চাকমা ও আমি আব্দুস সবুর লোটাস এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তনক দেওয়ান।


আরও পড়ুনঃ পশ্চিমবঙ্গে হানিমুনের জন্য সেরা ডেস্টিনেশন - সঙ্গীর সাথে ঘুরে আসুন


এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে কিছু দৃশ্য ক্যামেরায় ধরে রেখেছি। ছবিগুলো নিচে দেওয়া হলো,

ছবি - ০১: চেঙ্গী নদীর পাড়ে আমরা



ছবি ২: মুঙডি(খাবার)



ছবি ৩: স্বপ্নীলের বাসায় নিমন্ত্রণ



ছবি ৪: পাঁজন খাবার