খুশবুঃ এক হৃদয়ের গল্প

খুশবুর না বলা গল্পগুলো নিয়ে গল্প। খোঁড়া পা আর বিয়ে না হওয়ার মন্দ ভাগ্য বয়ে বেড়ানো এক মানুষীর গল্প।কঠিন চোখের অন্তরালে বিগলিত এক হৃদয়ের গল্প।

খুশবুঃ এক হৃদয়ের গল্প
খুশবু এক হৃদয়ের গল্প


'কিরে খুশবুরাণী,আইজ পাতা কুড়াতে যাস নাই?'

রাস্তার যে পাশটায় খুশবুদের ঘর তার ঠিক বিপরীত পাশে থাকা অর্ধভগ্ন প্রাচীরটায় বসেছিলো রাশেদ।


'শুনেন রাশেদভাই,আমি প্রত্যেকদিন পাতা কুড়াই সত্য কথা কিন্তু পাতা কুড়ানি ছাড়া যে আমার আর কোনো কাজ থাকতে পারেনা তা আপনারে কে কইলো। '


খানিক আগের হাসিহাসি মুখটাকে বেশ কঠিন করে রেখেছে খুশবু। কঠিন থমথমে মুখেই বেশ লাগে খুশবুকে। পৃথিবীর সব মেয়ের বেলায় লজ্জারাঙা মুখে যথেষ্ট সৌন্দর্য ভর করলেও খুশবুর বেলায় ভিন্ন মনে হয় রাশেদের। অবশ্য খুশবুর লজ্জারাঙা মুখটা কখনও দেখা হয় নি তার।


হাতের সিগারেটটা প্রাচীরের অপরপাশে ফেলে দিয়ে প্রাচীর থেকে নেমে দাঁড়ায় রাশেদ। তারপর প্রস্থানোদ্যত হয়। ভাবখানা এমন, যেন সে খুশবুকে এড়িয়ে যেতে চায়।


কিছুটা বিরক্তিমিশ্রিত গলায় খুশবু বলে উঠে , 'আপনারে আমি সবার থেইকা আলাদা মনে করছিলাম কিন্তু আপনিও গেরামের আর সকলের মতো। '


রাশেদ দু'কদম হেঁটে চলে গিয়েছিল । খুশবুর শেষের বলা কথায় ফিরে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় তার। পলকহীন দৃষ্টিতে খানিক চেয়ে থেকে সহজ কন্ঠে বলে, ' খুশবু নামটা তোট সাথে যায় না। খুশবু নাম শুনলে মনে হয় তিড়িং- বিড়িং লাফানো সুন্দরী ফুটফুটে কোনো এক কিশোরী যার দু'গালে তোর মতো মেছতার দাগ নাই। '


কথাগুলো বলেই হনহন করে হেঁটে চলে যায় রাশেদ। থ মেরে যায় খুশবু। কি বলে গেলো রাশেদ ভাই! কত সহজে বলে ফেললো কথাগুলো! মনের মানুষটার কিছু সেকেন্ডের অপলক দৃষ্টি যতটা লজ্জার লালিমা ফুটিয়েছিল মুখে,সেই মানুষটার কটাক্ষ তার চেয়ে অধিক বিবর্ণতার ছাপ আঁকতে বাধ্য। নিমিষেই কেমন গলা শুকিয়ে গেলো খুশবুর অথচ চোখজোড়ায় তখন খানিক অশ্রুধারা।


কিছুটা দূর থেকে রাশেদ গলা উঁচিয়ে বলে উঠে, ' অসময়ে সাজতে নাই খুশবু, মাইনসে খারাপ কইবো। '


ফিক করে হেসে ফেলে খুশবু,আঁখিকোণে তখনও একবিন্দু জল ছিলো।


সবসময় এলোমেলো থাকা লালচে চুলগুলোর মেথি মেশানো নারকেল তেলে চুবচুবে হয়ে বেণুনী পাকিয়ে দোল খাওয়া, মেছতাময় মুখজুড়ে সামান্য স্নো এর আবরণ আর আঁখিযুগলের নিচে সরু কাজল রেখা চোখ এড়ায় নি রাশেদের। রাশেদ খেয়াল করেছে তাতেই খুশবু খুশি। বিশেষ সৌন্দর্যে রিক্ত খুশবু ভেবে পায়না রাশেদ কেন তাকে সমীহ করে। রাশেদ কখনই তার খোঁড়া পা নিয়ে প্রশ্ন করে নি। একারণেই রাশেদকে ভালো লাগে খুশবুর।


কিন্তু রাশেদ?রাশেদের মনের গহীনে খুশবুর জন্য কি রয়েছে?সহানুভূতি নাকি অন্য কিছু? ভেবে পায় না খুশবু। রাশেদের ভাবনা ভাবতে গিয়ে খুশবুর ভাবনাকাশে কালো-সাদা মেঘেদের তীব্র ছোটাছুটি শুরু হয়।


খুশবু তখনও প্রাচীরটার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে । রাশেদের চলে যাওয়ার পানে নিষ্পলক চেয়ে আছে সে। মন আকাশের সূর্যটা গত একত্রিশটা বসন্ত মেঘের আড়ালেই ছিলো। কিরণ দেবার প্রয়োজনবোধ করেনি সে। আজ কেন জানি উঁকিঝুঁকি দিতে চাইছে। কিশের বাসনায় সূর্যটার হঠাৎ এই হলদে আলো ছড়ানোর বাসনা হয়েছে কে জানে!কি করা উচিত খুশবুর? সূর্যটাকে পূর্বাবস্থানে ফিরিয়ে দিবে নাকি রৌদ্রজ্জ্বল নীল আকাশে মুক্ত বিহঙ্গিনীর ন্যায় উড়ে বেড়াবে?খুশবুর জানামতে তার তো সেই বয়সটা পেরিয়ে গেছে।


তবে তাই করা হোক,এতোদিন সে যেটা করেছে। ভাগ্যের হাতেই সবটা ছেড়ে দেয়া যাক।


কিন্তু রাশেদকে নিয়ে প্রতিরাতে দেখা স্বপ্নগুলো ক্রমশই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলছে তাকে। সেই স্বপ্নজাল থেকে যদি কখনো বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে তবে সে কাজ উত্তাল সমুদ্রে সাঁতরে বেড়ানোর মতোই কঠিন হবে তার জন্য। ভীষণ রকমের দোটানায় অস্থির হয়ে পড়ে খুশবুর মন। খুশবুর প্রস্থানে অর্ধভগ্ন প্রাচীরটাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।


খুশবুদের একচালাযুক্ত ইটের দেয়াল দেয়ালবিশিষ্ট ঘরটার ঠিক পাশেই একটা বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। সেখানেই মিস্ত্রীদের দলের একজন রাশেদ। ভিন্ন এলাকার লোক সে। এখানে কোথায় যেন একটা পরিত্যক্ত দোকানঘর ভাড়া করে থাকে সে। দুপুরের খাবারের পর মিস্ত্রীরা সবাই কিছু সময়ের জন্য জিরিয়ে নেয়। সেই ফাঁকেই প্রাচীরটার উপর বসে নিশ্চিতে সিগারেটে ফুঁক দেয় রাশেদ। ছাইরঙা ধোঁয়ার কুন্ডলীতে খুশবুর মুখটা ভেসে উঠে কখনও কখনও। মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হয় রাশেদের। এ কদিনে খুশবু সম্পর্কে যেটুকু জেনেছে তাতে মনে হয় জীবনের সকল সুখ থেকে বঞ্চিত খুশবু। পড়াশুনা,সাজগোছ ,বন্ধু-বান্ধব,বিয়ে, স্বামী ,সংসার,সন্তান কিছুই পাওয়া হয়নি মেয়েটার। অথচ পাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে খুশবুর। খুশবুকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য রাশেদের মাথায় কেবল দুটো শব্দই আসে। তা হলো "অদৃষ্টের পরিহাস"। তার উপর খোঁড়া পা আর বিয়ে না হওয়ার মতো দুটো সামাজিক কলঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছে সে। অথচ দুটোতেই কোনো হাত নেই খুশবুর।


খুশবুর জন্য খুব মন খারাপ হয় রাশেদের। মাঝেমাঝে খুশবুর জন্য আচার কিনে রাশেদ। দুটো আচারের প্যাকেট পেয়ে কিভাবে এতো খুশি হওয়া যায় ভেবে পায় না রাশেদ। দুঃখী খুশবুরাণীর এই সামান্য খুশি বেশ ভালোই লাগে রাশেদের।


খুশবুর প্রতি কিছু সহানুভূতি আর মায়ার সংমিশ্রন খুশবু কি চোখে দেখছে সেই সূক্ষ্ম ভাবনা ভাবার প্রয়োজনবোধ করেনা রাশেদ। বারবরের মতো প্রেম-ভালোবাসায় অনাগ্রহী সাঁইত্রিশ পার হওয়া রাশেদ অদূর ভবিষ্যতে ও যাযাবর হয়ে জীবন কাটানোর সংকল্প করে ফেলেছে। বাবা-মা চলে যাওয়ার পর থেকেই তার মাথায় এই অদ্ভুত চিন্তার উৎপত্তি । বেশ ভালোই কাটছে তার দিনগুলো । এভাবেই পিছুটানহীন জীবন কাটাতে চায় রাশেদ।


কিছু মানুষ আজন্ম মন্দ ভাগ্যকে শিরা-উপশিরায় বয়ে বেড়ায়। না পেতে পেতে না পাওয়ার সংজ্ঞাই তারা ভুলে যায়। কোনটা না পেলে তাকে ঠিক না পাওয়া বলে সেটাই তারা বুঝে না। সেই হিসেবে খুশবুর না পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ হওয়ার কথা হলেও আসলে দীর্ঘ নয় । সত্যি বলত খুশবু জানেই না, না পাওয়া কাকে বলে।


খুশবুর না পাওয়ার তালিকায় আছে শুধু বিয়ে। বিয়ে টা হলেই খুশবুর আর কিচ্ছুটি চাওয়ার নেই। ছ'বোনের মধ্যে খুশবু তিন নম্বর। ওর বড় দুই বোনের বিয়ে হলেও বড় বোন তিন সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িই থাকে। মেঝো বোনের অবশ্য নিজের সংসার। ভালোই আছে সে । খুশবুর ছোট দুইবোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। আর সবার যে ছোট,সেও বিবাহ উপযুক্তা । যুতসই সম্বন্ধ পেলে বাবা-মা তারও বিয়ে দিয়ে দিবে। শুধু খুশবুর পড়ে আছে ঘরের কোণে এক অপ্রয়োজনীয় আসবাবের মতো।


যেদিন তার ছোট বোনটারও বিয়ে হয়ে যাবে, খুশবুও তার কাঁটাময় জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে নিবে। ইহকাল তো পাওয়া হলোনা,পরকালও পাওয়া হবে না তার। কিছু মানুষ জন্মায় শুধু করুণ পরিণতির জন্য। খুশবুও তাদের একজন। তার রাশেদভাইকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলোও যদি মিথ্যে প্রমাণিত হয়,তবে তার আর কোনো পিছুটান থাকবে না। দু'কালের মন্দ ভাগ্যই সঙ্গী হোক তবে।


সময় নামক রেলগাড়ীটা তার নিজস্ব পথ ধরে ছুটছে তো ছুটছেই। তার এই ছোটা অবিশ্রান্ত। বুদ্ধিমান তো সেই,যে ওই রেলগাড়ীটার সাথে পাল্লা দিয়ে চলে কিংবা সুযোগ বুঝে সময়ের ওই গাড়িটাতেই উঠে পড়ে। খুশবুর বাবা-মায়েরও সময়ের সেই অবিশ্রান্ত যাত্রায় গা ভাসিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় ছিলো না।


খুশবুকে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ পছন্দ করে তার ছোট বোনদের। খুুশবুর তো বিয়ের বয়স পেরিয়েই গেছে,বাকি মেয়েদের বেলায় দেরী করা ঠিক হবে না। উপায় না পেয়ে খুশবুকে রেখেই ছোট মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন তারা। অভাগী মেয়েটার প্রতি করা অন্যায়ের অনুশোচনার কালো দীর্ঘশ্বাস ক্রমশ ভারী হতে থাকে খুশবুর বাবা দিনমজুর কলিমউদ্দিনের।


এখন সর্বকনিষ্ঠ মেয়েটারও বিয়ের পাকা কথা সেরে ফেললেন তিনি। মেহমানদের আনা মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা মিষ্টির অর্ধেকটা মুখে ফুরে দেয় ঠিকই কিন্তু গিলতে কষ্ট হয়। একরাশ দীর্ঘশ্বাস হঠাৎ দলা পাকিয়ে আসে।


এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে খুঁজতে থাকেন খুশবুকে। ঘরে নেই মেয়েটা। পরের সপ্তাহে ছোটবোনের বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে শুনলে খুশিতে কেঁদে ফেলবে মেয়েটা। সবার প্রতি অদ্ভুত টান খুশবুর। কিন্তু কলিমউদ্দিনের সংসারে দুয়েকজন ছাড়া বাকি সকলেই খুশবুর প্রতি বিরক্ত। খুশবুর জন্য সমাজে চলা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের।


মিঞাঁ বাড়ির পিছনের আমবাগানে পাতা কুড়াচ্ছে খুশবু। আমবাগান হলেও কড়ইগাছও কম নয় সেখানে। কড়ইপাতাগুলো কুড়িয়ে এক জায়গায় জড় করছে খুশবু। তারপর সেগুলোর ঠায় হচ্ছে চট কিংবা প্লাস্টিকের বস্তায়।


সেই কখন থেকে বিরামহীন পাতা কুড়িয়ে যাচ্ছে খুশবু। ঝাড়ু আর শুকনো পাতার শব্দদ্বয় মিশ্রিত হয়ে অদ্ভুত সুন্দর এক শব্দ ঝংকার তৈরী করে। সেই শব্দ ঝংকারে চাপা পড়ে খুশবুর রক্তাক্ত ক্ষতের যন্ত্রণাগুলো। আজ তার ছোটবোনের বিয়ের পাকা কথা হবে। হয়তো সপ্তাহখানেক বাদে বিয়ের দিন ঠিক হবে। ঘরের সকল কাজকর্ম গুছিয়ে মেহমানরা আসার আগে বেরিয়ে এসেছিলো খুশবু। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরবেনা সে। ততক্ষণে হয়তো মেহমানরা চলে যাবে। মেহমানদের সামনে পড়তে চায় না খুশবু। মেহমানরা জানে পাত্রীর সব বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। মেহমানদের সামনে গেলেই যদি তারা জিজ্ঞেস করে,' শ্বশুরবাড়ি কোথায়?স্বামী কি করে?'তখন কি জবাব দেবে সে। ঘরে না থাকা নিয়ে তেমন কোনো সমস্যাও হবেনা। বরং সবাই স্বস্তিতেই থাকবে। নিজের পরিবারেই বড্ড অপ্রয়োজনীয় খুশবু।


বেলা পড়ে এসেছে। শেষ বিকেলের গাঢ় হলুদ সূর্যরশ্মি গাছগাছালির ফাঁক বেয়ে খুশবুর গায়ে আছড়ে পড়ছে। বেশ ভালো লাগছে খুশবুর। পাতা কুড়ানো ক্ষান্ত দিয়ে একটা পাতাভর্তি বস্তার উপর বসে পড়ে সে। পড়ন্ত বিকেলকে সাক্ষী রেখে খুশবুরাণী আর প্রকৃতিরাণীর হৃদয়ালাপ চলতে থাকে। এই প্রকৃতিই খুশবুর সুখ-দুঃখের ভাগীদার। আর তো মাত্র ক'টা দিন। তারপর সব প্রিয়-অপ্রিয়কে ছেড়ে কঠিন পরপারে যাত্রা করবে সে। খুশবুর সশব্দের কান্না নির্বাক প্রকৃতি ছাড়া আর কারো গোচরীভূত হয়নি তখন।


দেখতে দেখতে আরো পাঁচ-ছয়টা দিন কেটে গেলো। বৃহস্পতিবারে খুশবুর ছোট বোনের গায়ে হলুদ আর শুক্রবারে বিয়ে। খুশবুর মা তার বাপের বাড়িতে পাওনা সম্পত্তি বিক্রি করে টাকার জোগাড় করেছেন। আয়োজন মোটামুটি খারাপ নয় । ঝমকালো না হলেও সাধারণ করে একটা গেইট দেওয়া হয়েছে। হলুদের কনে বসার জন্য স্টেজ সাজানো হচ্ছে ফুল দিয়ে। বিয়ে বাড়ি লোকজনে আর আলোয় টুইটম্বুর হয়ে আছে। খুশবু দারুণ ব্যস্ত। বিয়ে বাড়িতে কাজের অভাব আছে নাকি।


হঠাৎ খুশবুর মন চাইলো একবার ফ্যান্ডেলের দিকে যেতে। গেলোও সে। ফ্যান্ডেলের এক কোণে দাঁড়িয়ে তার ছোটবোনটাকে অপলক দেখছে সে। একদম হলুদ পরীর মতো লাগছে তার ছোট বোনকে। এমনিতেও সে সুন্দরী তার উপর পরনে হলুূদ শাড়ী,মাথায় হলুদ গাঁদা ফুলের টায়রা,কানে, গলায় আর হাতেও ফুলের অলংকার, ফর্সা দু'গাল জুড়ে কাঁচা হলুদের ছোঁয়ার অসাধারণ লাগছে কনেকে। খানিকের জন্য খুশবুর চোখে ভেসে উঠে তার নিজের হলুদ সাজের ছবি। আর হঠাৎ ই বুকের বা'পাশের চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়ে যায় খুশবুর। ছুটে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। সকল আলোকসজ্জা ছাড়িয়ে খুশবু গিয়ে বসে সেই অর্ধভগ্ন প্রাচীরটায়,যেখানে তার রাশেদ ভাই আপনমনে বসে সিগারেটে ফুঁক দেয় আর কি যেন ভাবে।


অন্ধকারে বসে তাদের আলোময় বাড়িটাকে দারুণ লাগছে খুশবুর। খুশবু বাড়িটার একটা নামও ভেবে ফেলে। 'আলোর কুটির'। আলোর কুটির শব্দ দুখানা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করে খুশবু। কেমন হতো যদি তার নিজের একটা আলোর কুটির থাকতো!সন্ধ্যে নামলেই সে কুটিরের সকল কক্ষে আলো জ্বলে উঠতো। আর উঠোনজুড়ে থাকতো চাঁদের আলো। সে চাঁদের আলোয় বাড়তি ঝলকানি তৈরী করতো জোনাক পোকারা। উঠোনের দক্ষিণ পাশটায় পাতানো মাচানের উপর মনের মানুষটার সাথে সুখালাপের মালা গাঁথতো খুশবু। বাগানের হাসনাহেনার ঘ্রানে চারিপাশটা মোহময় হয়ে যেতো। খুশবুর মিহি কথার ছন্দে সে মানুষটা মুগ্ধ কবি হতো। সে মানুষটা যদি রাশেদ ভাই হতো!


ঘোর কেটে যায় খুশবুর। দোকলা ভাবনাগুলোতে সবসময়ই রাশেদকে দেখতে পায় খুশবু। রাশেদকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে খুশবু। কিন্তু রাশেদ খুশবুকে নিয়ে কি ভাবে তা জানা হলোনা খুশবুর। জানতে চায়ও না সে। জানলে  আরো একটা কষ্ট নিয়ে মরতে হবে তাকে। শেষ সময়ে কষ্টের ভার টা আর বাড়াতে চায় না খুশবু। গভীর দীর্ঘশ্বাস আর রাশেদ ভাইয়ের প্রতি তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে ওড়নার খুঁটে বেঁধে বিদেয় হতে চায় সে।


শুক্রবারদিন সকাল বেলা খুশবু অদ্ভুত একটা ইচ্ছে নিয়ে এদিকওদিক ছুটে কাজ করতে থাকে। তার পাতা কুড়াতে ইচ্ছে করছে খুব। হয়তো আজকের দিনটাই তার শেষ দিন। এই শেষ দিনেই তার প্রিয় কাজটা করতে চায় খুশবু। কিন্তু পারবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রতিবেশীরা জানলে এনিয়ে খুব কটু কথা শোনাবে। তাই মনের ইচ্ছে মনে রেখেই সব কাজকর্ম করছে সে। আজ খুশবুকে খুশি খুশি দেখা  যাচ্ছে। একটা ভালো জামাও পড়েছে সে। কেন জানি তার আপনজনদের জন্য খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না। শুধু বাবা আর মায়ের জন্য কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। আর একজন আছে। তার জন্যও খানিক কষ্ট অনুভূত হচ্ছে।


পাশের নির্মানাধীণ ভবনটায় আজও কাজ চলছে। । রাশেদও এসেছে আজ কাজে। খুশবু সুযোগ খুঁজছে কিভাবে তার রাশেদ ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলা যায়। রাশেদ ভাইকে দাওয়াত করার খুব ইচ্ছে ছিলো খুশবুর পাছে কে কি মনে করে সেই ভয়ে দাওয়াতটা শেষমেশ করা হয়ে উঠে নি। আজ প্রাচীরটার উপর অনেক ছেলেছোকরারা দুষ্টুমি করছে। আজ হয়তো দুপুরের খাবারের পরে রাশেদ ভাই ওখানে বসবে না।


বাড়ির পিছন দিকের রাস্তা ধরে আনমনে হাঁটছে খুশবু। রাশেদকে খবর পাঠিয়েছে একটা ছোট বাচ্চার সাহায্যে। রাশেদের সাথে কথা বলার জন্য ই তার এখানে আসা। লোকজন দেখলে মন্দ কথা বলবে ঠিকই কিন্তু এখন কিছু যায় আসেনা খুশবুর। মন্দ কথাগুলো হজম করার জন্য খুশবু তো থাকবেই না। খুশবুর এমন কাজে তার বাবামায়ের মান খোয়া যাবে কিছুটা,তা খুশবু ভালো করেই জানে। কিন্তু কিছুদিন কেটে গেলে সবাই সবকিছু ভুলে যাবে। তখন সবাই ভালো থাকবে। শুধু খুশবুটাই থাকবে না। বুক ফেটে কান্না পায় তার। কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে খুব ইচ্ছে করছে খুশবুর। কিন্তু সেরকম একটা অবলম্বনই তো তার নেই । থাকলে এ সিদ্ধান্ত নিতে হতো না খুশবুকে।


রাশেদকে দ্রুত কদমে হেঁটে আসতে দেখে নিজেকে সামলে নেয় খুশবু। রাশেদের কপাল বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। রাশেদের বিরক্তিমাখা মুখ দেখে খুশবুর মনে হয় হৃদপিণ্ডে কেউ যেন একটা পেরেক গেঁথে দিয়েছে। ঝাঁঝালো কন্ঠে রাশেদ প্রশ্ন করে,'কিরে ডাকছস ক্যান?'


' শেষবারই ডাকলাম ,আর ডাকবো না। ' কান্না গিলে বলে ফেলে খুশবু।

বলেই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে খুশবু। ভড়কে যায় রাশেদ। মেয়েটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে। কিন্তু শেষমেশ মানে কি?অজানা আশংকায় রাশেদের বুক ভারী হয়ে উঠে। কি করতে চলেছে খুশবু?

খুশবুর কি বিয়ে হয়ে যাবে?নাকি খুশবু নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছে?দৌঁড়ে গিয়ে খুশবুর সামনে দাঁড়িয়ে যায় রাশেদ।

সকাতরে প্রশ্ন করে,' তুই কি করতে চাইতাছস খুশবু? আমারে খুইলা বল। '


খানিক চুপ থেকে খুশবু একদমে বলে ফেলে, 'আমারে বিয়া করবা, রাশেদ ভাই? আমার কলঙ্কময় জীবন থেইকা আমারে মুক্তি দিতে পারবা তুমি?ও রাশেদ ভাই, কও না,পারবা তুমি?সবাই আমারে দয়া করে ক্যান রাশেদ ভাই?কি হইলো রাশেদ ভাই,কথা কও না ক্যান? বুঝছি,পারবানা। তবে সরো। পথ আটকাইয়ো না। আমার যেইটা করা উচিত আমি এখন সেইটাই করবো। '


দাঁত খিঁচে কান্না আটকায় খুশবু। তারপর হনহনিয়ে হাঁটা ধরে। ভেবেছিলো রাশেদের ভাবনাটা সে জানতে চাইবে না। কিন্তু নিজেকে আর অবশেষে আটকাতে পারলো না। খুশবু ভেবেছিলো রাশেদের উত্তর হ্যাঁ হলে বাঁচার  একটা সুযোগ পেয়ে যাবে। এখন রাশেদের নিরবতা খুশবুকে উত্তর পাইয়ে দিয়েছে। খুশবুর আর কোনো পিছুটান নেই। আজকের দিনটা অপেক্ষা। কালকের প্রভাতটা তার হয়তো আর দেখা হবে না।


অনেকটা হেঁটে চলে এসেছে খুশবু। হঠাৎ খুশবুর মনে হলো পিছন থেকে কেউ যেন ডাকছে। পিছনে তাকাতে ভয় হচ্ছে তার । যদি তার কান ভুল শোনে! সেকেন্ডের ব্যবধানে তৈরী হয়ে যাওয়া আশা যদি ভুল হয়ে যায়!


খুশবু এবার স্পষ্টই শুনতে পেলো তার রাশেদ ভাই তাকে ডাকছে। পিছন ফিরে দেখে রাশেদ ভাই এগিয়ে আসছে তার দিকে।


বাঁচার অতি আকুতি আর অতি আবেগের তাড়নায় খুশবুর মতো কঠিন মেয়ে ভাবতে ভুলে যায় রাশেদ ভাইয়ের এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলের কারণ।


কিন্তু রাশেদ তো জানে,খানিক আগের নিরবতার পর এতো দ্রুত  মন বদলের কারণ। ভালোবাসা নাকি করুনা তা জানে না রাশেদ। তবে খুশবুর জীবনকে কাঁটামুক্ত করার ভীষন বাসনা জমেছে তার মনে। সেই বাসনা মেটানোর বাসনায় খুশবুর নাম ধরে দু'বার ডাক দেয় রাশেদ।