কুসংস্কার গর্ভবতী মা ও প্রসূতি মায়ের সুষম পুষ্টির অন্তরায়

আমাদের দেশে এখনো গর্ভবতী মা ও প্রসূতি নিয়ে নানা কুসংস্কার ছড়িয়ে আছে। ফলে তারা নানা অপুষ্টিতে ভুগছে এবং পরিবারে কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হয়। তাই আমাদের বিজ্ঞানের আলোকে জীবন-যাপন করা উচিত এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রয়োজন। নতুবা আমরা উন্নতি পথে এগিয়ে যেতে পারব না।

কুসংস্কার গর্ভবতী মা ও প্রসূতি মায়ের সুষম পুষ্টির অন্তরায়
কুসংস্কার গর্ভবতী মা ও প্রসূতি মায়ের সুষম পুষ্টির অন্তরায়

আমাদের দেশের গ্রামে -গঞ্জে মানুষের প্রতিদিনের জীবন যাত্রায় কিছু না কিছু কুসংস্কার লেগে থাকে। শুধু কি গ্রামে আমাদের শহরের মানুষের মাঝেও কম-বেশি কুসংস্কারে বিশ্বাসী।


যা আমাদের জীবন যাত্রা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদিকে প্রভাবিত করছে। আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা নানা কুসংস্কার আমাদের গর্ভবতী নারী ও প্রসূতি মাকে নানা অসুবিধার সম্মুখীন করছে।


চলুন জেনে নিই কিভাবে কুসংস্কার গর্ভবতী ও প্রসূতি মাকে নানা অসুবিধার সম্মুখীন করছে -

গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে যত কুসংস্কার :ডাক্তার ও পুষ্টিবিদগণের মতে, গর্ভাবস্থায় মায়ের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মা অপুষ্টিতে ভুগলে শিশুও অপুষ্টিতে ভোগে।


ফলে নানা সমস্যা নিয়ে শিশু জন্ম গ্রহণ করতে পারে। এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। কিন্তু সেখানে আমরা অনেক পুষ্টিকর খাবার খেতে গর্ভবতী মাকে নিষেধ করি।


এই যেমন আমাদের ধারণা কলার মোচা খেলে জরায়ু মুখ সহজে খোলে না। অন্যদিকে ডাক্তার ও পুষ্টিবিদের মতে, কলার মোচায় রয়েছে প্রচুর ভিটামিন বি সিক্স, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ফাইবার, প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যা শরীরের জন্য উপকারী।


এছাড়া কলার মোচা রক্তস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে যা গর্ভাবস্থায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শাকের মধ্যে লাল শাক জনপ্রিয় খাবার। খেতে যেমন সুস্বাদু তেমন পুষ্টি উপাদানে ভরপুর লাল শাক।


এই শাকে রয়েছে প্রচুর ফাইবার, ভিটামিন-এ, আয়রন, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম। যার প্রত্যেকটা ভিটামিন গর্ভবতীর জন্য উপকারী। অথচ আমাদের অনেকের ধারণা, লাল শাক খেলে শিশুর লাল বাত হয়। তাই লাল শাক গর্ভবতী মাকে দেয়া যাবে না।


ডাব নিয়েও আমাদের মধ্যে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। গর্ভাবস্থায় ডাব খেলে নাকি শিশুর চোখ ঘোলা হয়। যদি ও এর কোন সত্যতা নেই। আমার দুই সন্তান।


গর্ভে থাকা অবস্থায় শ্বশুর বাড়ির পরিবারকে না জানিয়ে অনেক ডাব খেয়েছি। কিন্তু আমার দুই সন্তানের চোখ স্বাভাবিক। ডাব হলো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন একটি প্রাকৃতিক পানীয়।


প্রচুর মিনারেল থাকায় এই পানি পান করলে শরীর মুহূর্তেই সতেজ হয়ে উঠে। গর্ভাবস্থায় হরমোন পরিবর্তনের কারণে নারীর রক্তচাপের পরিবর্তন হয়।


এই সময় যেসব নারী নিম্ন রক্তচাপে ভোগে তারা ডাবের পানি পান করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এছাড়া ডাবে রয়েছে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, শর্করা, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি ও জলীয় অংশ। যা গর্ভবতী নারী ও শিশুর জন্য  খুবই উপকারী উপাদান।


সমাজের এসব কুসংস্কার যদি আমরা এখনো মেনে চলি তাহলে জাতির উন্নতির পথে বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সব পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়।


তাই এসব পরিবারের গর্ভবতী মায়েরা যদি লাল শাক, কলার মোচা, ডাবের পানি ইত্যাদি সহজলভ্য খাবার খেতে না পারে ভবিষ্যতে মা ও শিশু পুষ্টি হীনতায়  ভোগবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।


তবে গর্ভাবস্থায় সাবধানতা অবলম্বন করা ও শরীরের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। এজন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও গবেষকরা কিছু খাবার এড়িয়ে চলতে বলে। যেগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে।


এমন কিছু খাবার হলো :

১. ভালো  করে সেদ্ধ না হওয়া খাবার, যেমন :কাঁচা মাংস, ডিম। এতে অন্ত্রের সংক্রমণ হতে পারে।

২. অতিরিক্ত ভাজা -পোড়া খাবার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়ায়।

৩. ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করতে হবে। কারণ এসব খাবার রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।

৪. কাঁচা পেঁপে গর্ভবতী নারীর জন্য ক্ষতিকারক। কারণ এতে ল্যাটেক্স নামক যে উপাদান আছে, তা গর্ভের ভ্রণ নষ্ট করে দিতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাকা পেঁপে খাওয়া যাবে।

৫. অনেকে কাঁকড়া খেতে পছন্দ করেন। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ক্যালসিয়াম, কোলেস্টেরল। যা জরায়ুকে সংকুচিত করে আভ্যন্তরীণ রক্তপাত ঘটাতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় বেশি কাঁকড়া খাওয়া এড়িয়ে যাওয়া উচিত।


এছাড়া অতিরিক্ত সামুদ্রিক মাছ, বেলের শরবত, আনারস গর্ভাবস্থায় কম খাওয়া উচিত।


মায়ের বুকের দুধ নিয়ে যত ভুল ধারণা : শুধু গর্ভবতী মা নিয়ে কুসংস্কার প্রচলিত আছে তা নয়, দুগ্ধদানকারী মাকে নিয়েও আমাদের মধ্যে নানা কুসংস্কার প্রচলিত আছে।


শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বুকের দুধ নিয়ে রয়েছে নানা কুসংস্কার ও ভুল ধারণা। ফলে মায়ের উপর চলে আাসে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা।


এমন কিছু ভুল ধারণা আমাদের আলোচ্য বিষয়:

ডাক্তারদের মতে, শিশু জন্মের পর তার প্রথম খাবার ও টিকা হলো মায়ের শালদুধ। এই শালদুধ যত তাড়াতাড়ি দেয়া যায় তত ভালো।


কারণ এতে প্রচুর প্রোটিন ও ভিটামিন থাকে যা শিশুর রোগ -প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। শিশুর মস্তিষ্ক গঠন ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।


অথচ আমাদের অনেকের ধারণা, শালদুধ খাওয়ানো উচিত নয়, ফেলে দিতে হবে। বুকের দুধ না দিয়ে বরং পানি কিংবা মধু দিয়ে থাকি। এতে শিশুর ইনফেকশন হওয়ার আশংকা বহুগুণ বেড়ে যায়।


ডাক্তারদের মতে শিশুর জন্মের প্রথম ৬মাস বুকের দুধ ছাড়া এক ফোটা পানিও দেয়ার প্রয়োজন নেই।


অনেকে মনে করে মা বেশি ঝাল -মসলা, ডাল -মটরশুঁটি খেলে শিশুর পেট ব্যাথা করে। এজন্য শিশু কান্না করে। এ ধারণার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই। মা যদি পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার না খায় শিশুকে পর্যাপ্ত দুধ দিতে পারবে না।


ফলে শিশু অপুষ্টিতে ভোগবে ও শিশুর নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।


বুকের দুধ কম এলে অনেক ক্ষেত্রে মা'কে অপয়া বলে অপবাদ দেয়। পরিবারের সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে যে, বুকের দুধ আসা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।


মায়ের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে দুধ আসবে। তাছাড়া অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম ও মানসিক অশান্তি মায়ের বুকের দুধ উৎপাদন ব্যাহত করে।


অনেক সময় দুধ স্তনে জমে শক্ত হয়ে যায়, প্রচুর ব্যাথা হয়। এটাকে আমাদের অনেক মা-ঠাকুর মায়েরা দুধে বাতাস লাগা বলেন। বৈদ্য দিয়ে ঝাড়-ফুক করান।


আবার অনেকে মায়ের দুধে মাটির প্রলেপ দেয়। এগুলো অন্ধ কুসংস্কার। ডাক্তারদের মতে, বুকে দুধ জমে গেলে, তা টিপে বের করে দিলে অনেকাংশে সমাধান হয়ে যায়।


মা ঠান্ডা পানি পান করলে বা ঠান্ডা পানি ব্যবহার করলে আমাদের অনেকের ধারণা শিশুর ঠান্ডা লাগে। এবার কোন ভাইরাসের কারণে শিশুর জ্বর -সর্দি  কিংবা কাশি হলে মায়ের থেকে ঠান্ডা লেগেছে বলা হয়।


এজন্য আমাদের মুরুব্বিরা মাকে স্নান বা গোসল করতে দেয় না, মায়ের স্তন চুলায় গরম করতে বলে। যেগুলোর কোন সত্যতা পাওয়া যায় নি।


ডাক্তার ও গবেষকদের মতে, যখন গরুর দুধ দোহন করে তখন আমরা গরুর দুধ কিছুটা উষ্ণ গরম পাই, ঠিক তেমন মায়ের বুকের দুধও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় উষ্ণ গরম হয়ে শিশুর কাছে পৌছায়।


তাই মায়ের দুধ থেকে ঠান্ডা লাগার প্রশ্নই উঠে না।


বয়স্ক মুরুব্বিরা আমাদের গুরুজন। তাদের শ্রদ্ধা করা, তাদের কথা মান্য করা আমাদের কর্তব্য। তাই বলে তাদের কিছু কুসংস্কার  বা ভুল ধারণা আজীবন মেনে চলা উচিত নয়। এতে ভবিষ্যতে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না।


আমাদের বিজ্ঞানের আলোকে জীবন -যাপন করা উচিত। এসব কুসংস্কার ফেলে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গর্ভবতী মা ও প্রসূতি মায়েদের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ভালো হবে।


আরও পড়ুনঃ জরায়ু জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হলে কীভাবে বুঝবেন? মহিলাদের জন্য জরুরী