গুগলের আবিষ্কার ও ইতিহাসঃ কিছু না জানা তথ্য
বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভিজিটেড ওয়েবসাইট হলো গুগল। ইন্টারনেট ব্যাবহারকারীদের অধিকাংশই অন্তত একবার হলেও এই ওয়েবসাইটটিতে ঘুরে গেছেন। কিন্তু আমরা কি জানি গুগলের আবিষ্কার কেন এবং কিভাবে হয়েছিল? সেটা জানতেই আজকের এই লেখা। পাশাপাশি থাকছে গুগল সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য।

বর্তমান সময়ের পৃথিবী হলো তথ্য প্রযুক্তির ঢেউয়ে ভাসা পৃথিবী। সেই ঢেউকে নতুন মাত্রা দিয়েছে যে প্রতিষ্ঠানটি সেটি হলো গুগল এলএলসি। গুগল মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা ও পণ্যে বিশেষায়িত একটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি। এটি বিশ্বে বিভিন্ন ডেটা সেন্টারে প্রায় এক মিলিয়ন সার্ভার চালায়। এক বিলিয়নের ওপর সার্চের অনুরোধ এবং প্রায় ২৪ পেটাবাইট ডেটা প্রসেসিং করে। গুগলের মূল স্লোগান হলো "বিশ্বের তথ্য সন্নিবেশিত করে তাকে সবার জন্য সহজলভ্য করা।" আর অপ্রাতিষ্ঠানিক স্লোগান "Don't be evil." গুগল ছাড়া প্রযুক্তির সাথে যুক্ত প্রায় প্রতিটি ব্যক্তি এক মুহূর্তও চলতে পারে না। এই ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাদান প্রতিষ্ঠানটি মানুষের জীবনকে অনেক সহজ করেছে তথ্যকে সবার কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে।
গুগলের আবিষ্কার
নতুন কিছু করার চেষ্টা থেকেই আবিষ্কৃত হয় গুগল। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন পিএইচডি ছাত্র ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে তারা একটি গবেষণা প্রজেক্ট হিসেবে এর কাজ শুরু করে। তাদের থিওরি ছিল সেইসময়ের কৌশলগুলোর চেয়ে নতুন কৌশলে একটা সার্চ ইঞ্জিন বানানো যা ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের হিসাবের ভিত্তিতে আরো ভালো ফলাফল আনবে। শুরুতে তারা নতুন ইঞ্জিনের নাম রাখেন ব্যাকরাব। কারণ এতে একটি সাইট কত গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ধারণ করার জন্য সেই সাইটের ব্যাকলিংকগুলো যাচাই করা হতো।
পরবর্তীতে নাম বদলে গুগল রাখা হয়, যা আসলে একটি ভুল বানানে লেখা শব্দ googol থেকে এসেছে। এর অর্থ এক এর পেছনে একশত শূন্য। তাদের ওয়েবসাইটে যে বিপুল পরিমাণ উপাত্ত ঘাঁটাঘাঁটি বা সার্চ করা হবে তা এই নাম দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন। প্রথমদিকে এটি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের অধীনে চলতো যার ঠিকানা ছিল google.stanford.edu এবং z.stanford.edu। গুগল ডোমেইন নেম হিসেবে রেজিস্ট্রার্ড হয় ১৯৯৭ সালে এবং কর্পোরেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৮ সালে।
গুগলের ইতিহাস
ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন google.com একটি ডোমেইন নেম হিসেবে রেজিস্টার করেন ১৯৯৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ১৯৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রাথমিকভাবে এটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবেই ছিল। তখন এটি চালানো হতো তাদের এক বন্ধুর গ্যারেজ থেকে যার নাম সুজান ওজচিচকি। তিনি ম্যানলো পার্ক, ক্যালিফোর্নিয়ার ক্রেইগ সিলভারস্টাইনে থাকতেন। গুগলের প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত লোকটি ছিল স্ট্যানফোর্ডের ফেলো পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত একজন ছাত্র। ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট গুগল ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং দেয়। সে সময় ল্যারি পেজ, সের্গেই ব্রিন এবং এরিক স্কমিট গুগলে ২০ বছর একসাথে কাজ করতে সম্মত হন। এরপর থেকেই গুগল নতুন নতুন কোম্পানি কিনে এর বহুমুখী কার্যক্রম সুদৃঢ় করেছে।
২০০৬ সালে গুগলের সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেইন ভিউতে স্থানান্তর করা হয়, যেটি গুগলপ্লেক্স নামে পরিচিত। এরপর থেকে গুগলের পরিধি সবদিক থেকে আরো বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে গুগল এর বিভিন্ন কার্যক্রম অ্যালফাবেট কর্পোরেটেড নামে সমন্বিত করার পরিকল্পনার কথা বলে যে, অ্যালফাবেটের প্রধান অধীনস্থ সংগঠন হিসেবে গুগল এর ইন্টারনেট কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তখন সুন্দর পিচাই গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ল্যারি পেজের স্থলাভিষিক্ত হন। ল্যারি পেজ বর্তমানে অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
গুগলের কার্যক্রম
বর্তমানে গুগল সার্চ ইঞ্জিনের পাশাপাশি ইমেইল, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, অফিস প্রডাক্টিভিটি প্রভৃতি বিষয়ে সেবা দেয়। প্রতিদিন নতুন প্রযুক্তি এবং পণ্য দিয়ে ইন্টারনেট দুনিয়ায় টেক জায়ান্ট হয়ে উঠেছে গুগল। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের ছবি, রোডম্যাপ ও ম্যাপের জন্য নিজস্ব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গুগল ম্যাপের সাহায্যে সেবা দেয়। গুগলের ইমেইল সাইট জিমেইল, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট গুগল প্লাস, ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউব এবং গুগল ড্রাইভ দেয় ক্লাউড কম্পিউটিং সেবা যেখানে ৮ গিগাবাইট পর্যন্ত ফ্রি স্টোরেজ করা যায়।
গুগল ট্রান্সলেটর এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা অনুবাদ করা যায়। এছাড়া গুগল ক্রোম, গুগল ক্যালেন্ডার, ব্লগস, ইমেজ সার্চ প্রভৃতি গুগলের অন্যতম সেবাদান কার্যক্রম। এছাড়াও গুগল অনলাইন বিজ্ঞাপনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এর প্রায় ৯৯ ভাগ আয় করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে গুগল ডেমো স্লাম সাইটটি ব্যবহার করে।
গুগল সম্পর্কে কিছু না জানা তথ্য
গুগল সম্পর্কে এমন কিছু চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে যা হয়তো অনেকেই জানে না। যেমন- বিখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস 'ইজ গুগল গড' শিরোনামে তাদের 'মতামত' বিষয়শ্রেণীতে আলোচনা করে। ইন্টারনেটে অনেক ব্লগ আছে যেখানে গুগলকে কেন ঈশ্বরতুল্য মনে করা হয় তার কারণ উল্লেখ আছে। মাউন্টেইন ভিউয়ের গুগলপ্লেক্সে টি-রেক্স জাতীয় ডাইনোসরের বিরাট একটি মূর্তি আছে, যেটিতে প্রায়ই প্লাস্টিকের তৈরি ফ্লামিঙ্গো বসতে দেখা যায়।
অনেকের ধারণা এটা কর্মচারীদের প্রতি এক ধরনের সতর্কবার্তা যাতে তারা গুগলকে কখনো বিলুপ্ত হতে না দেন। এই গুগলপ্লেক্সের ভেতরের সবুজ ঘাসের জন্য প্রায়ই তারা বাইরে থেকে ছাগল ভাড়া করে নিয়ে আসে। প্রথম গুগল ডুডল বানানো হয়ছিল ১৯৯৮ সালে বার্নিং ম্যান নামের একটি অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য। গুগলের প্রতিষ্ঠাতারা এর মাধ্যমে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেদিন তারা কেন অফিসে অনুপস্থিত। সবচেয়ে স্মরণীয় ডুডল ছিল চাঁদে পানির সন্ধান এবং বিখ্যাত শিল্পী জন লেননের ৭০ তম জন্মদিনে। জন লেননের জন্মদিনে বানানে ডুডলটি ছিল গুগলের প্রথম ভিডিও ডুডল।
গুগলই একমাত্র বহুজাতিক কোম্পানি যেখানে কর্মচারীদের বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করা হয়। একমাত্র এখানেই কর্মচারীদের পোষা কুকুর অফিসে আনার অনুমতি আছে।গুগল জিমেইলের ঘোষণা দেয় ১ এপ্রিল ২০০৪ সালে অর্থাৎ এপ্রিল ফুলস ডেতে। অনেকেই এটাকে রসিকততা ভেবেছিলেন। ২০০৬ সালে গুগল দেড়শ কোটি ডলারেরও বাশি দামে ইউটিউব কিনে নেয়। এর ইমেজ সার্চ চালু হয় ২০০১ সালে। গুগল করা ক্রিয়াপদ হিসেবে ২০০৬ সালে ডিকশনারিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
গুগলের একজন ইঞ্জিনিয়ার ২০০৯ সালে ভুলবশত গুগলের ব্লকড ওয়েবসাইটের রেজিস্ট্রিতে ফরোয়ার্ড স্ল্যাশ ('/') চিহ্নটি যুক্ত করে ইন্টারনেট ব্যবস্থা স্থবির করে দিয়েছিলেন। ওই চিহ্নটির কারণে কোনো ওয়েবসাইটেই ঢোকা যাচ্ছিল না। গুগলের অনেকগুলো জন্মদিন থাকলেও তারা ২৭ সেপ্টেম্বরই এর অফিশিয়াল জন্মদিন হিসেবে পালন করে। গুগল সম্পর্কে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হলো এতে ১৫ শতাংশ সার্চই নতুন, যেগুলো আগে কখনো করা হয়নি।
বর্তমানে গুগল শুধু একটি সার্চ ইঞ্জিন নয়। গুগল ছাড়া চলতে পারেন বর্তমান পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। ভবিষ্যতে এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্ট্রিমিং-ভিত্তিক গেম খেলার ব্যবস্থা, এমনকি ড্রাইভারবিহীন গাড়ি রাখার জন্য গবেষণা চলছে। অবশ্য এর কার্যক্রম নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। গুগলের নিউজ সার্চ, ম্যাপ, গুগল বুকস প্রভৃতি সেবা নিয়ে রয়েছে অনেক সমালোচনা। সেবার মান বাড়াতে ২০১১ সালের মার্চে গুগল অ্যালগরিদম পরিবর্তন করা হয়। তবে বিতর্ক আর সমালোচনা যতই থাকুক না কেন, গুগল হয়ে উঠেছে প্রযুক্তির সাথে যুক্ত মানুষদের নিত্যদিনের সঙ্গী।