গ্লোরিয়া রামিরেজের বিষাক্ত মৃত্যু রহস্য
আজকে আমরা এমন একটি কেস সম্পর্কে জানবো যা আমেরিকার মিডিয়া জুড়ে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কেসটি এতটাই আশ্চর্যজনক যে এই কেসের উপর ভিত্তি করে আমেরিকার বেশ কিছু টিভি সিরিজও নির্মিত হয়েছিলো। কেসের পুরোটা অংশ জুড়ে আছেন ৩১ বছর বয়সী গ্লোরিয়া রামিরেজ। ইন্টারনেটে গ্লোরিয়া রামিরেজের নাম দেয়া হয় "টক্সিক গার্ল"। একজন মহিলা কীভাবে যে একটা পুরো হাসপাতালের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে তা এই কেসের আগে মানুষ কখনও চিন্তাও করতে পারে নি।

ফেব্রুয়ারী ১৯, ১৯৯৪ সাল, রাত ৮ টা ১৫ মিনিটে ৩১ বছর বয়সী ক্যান্সারের রোগী গ্লোরিয়া রামিরেজ রিভারসাইড জেনারেল হাসপাতাল এর ইমার্জেন্সি রুমে ভর্তি হন।
কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা লক্ষ্য করলেন গ্লোরিয়ার হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসকেরা তার হৃদস্পন্দন কমানোর সব রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন।
তারা আরও লক্ষ্য করলেন যে গ্লোরিয়ার সমস্ত শরীরে এক রকম তেল তেলে আস্তরণ পড়ে যাচ্ছে এবং তার মুখ থেকে রসুনের মতো একটা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
এ সময়ে সুসান কেন নামের একজন নার্স ব্লাড টেস্টের জন্য গ্লোরিয়ার শরীর থেকে সিরিঞ্জের সাহায্যে কিছুটা রক্ত নিচ্ছিলেন।
তিনি লক্ষ্য করলেন গ্লোরিয়ার রক্তে হালকা হলুদ রং এর ছোট ছোট দানা দেখা যাচ্ছে। প্রথমে নার্স সুসান ভাবলেন তিনি চোখে ভুল দেখছেন।
তাই বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য তিনি পাশে থাকা ডাক্তার হামবার্তো ওচোয়াকে সিরিণ্জটি দেখালেন। ডাক্তার হামবার্তো ও একই জিনিস দেখলেন এবং তার বিস্ময়ের কোন সীমা রইল না।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার হামবার্তো ওচোয়া লক্ষ্য করলেন নার্স সুসান চিৎকার করে বলছেন যে তার চেহারা নাকি পুড়ে যাচ্ছে এবং এক সময়ে নার্স সুসান অজ্ঞান হয়ে যান।
এ সময়ে ইমারজেন্সি রুমে থাকা জুলি গোরচেন্সকি নামের আরেকজন নার্সের মাথা ঘুরতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তিনি ও অজ্ঞান হয়ে যান।
তার শ্বাস প্রশ্বাসও বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। ইমারজেন্সি রুমের আরেকজন রেসপিরেটরি থেরাপিস্ট মেরিন ওয়েলচ, তিনিও অজ্ঞান হয়ে যান।
পুরো হাসপাতালের অন্যান্য সদস্যরাও বিভিন্ন শারীরিক অসুবিধায় ভুগতে থাকেন এবং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে হাসপাতালের ইমারজেন্সি রুমের ভিতরেই যেন আরেকটি মারাত্মক ইমারজেন্সি অবস্থার সৃষ্টি হয়।
হাসপাতালের অন্য সব রোগীদেরকে ইমারজেন্সি রুম থেকে বের করে পার্কিং লটে নিয়ে আসা হয়। তবে ইমারজেন্সি রুমে তখনও কিছু সংখ্যক নার্স ও ডাক্তার অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলো গ্লোরিয়ার জীবন বাঁচনোর জন্য। তবে তারা ব্যর্থ হন। রাত ৮টা ৫০মি. এর দিকে গ্লোরিয়া মৃত্যুবরণ করেন।
কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্স ঠিক করলেন গ্লোরিয়ার মৃতদেহ আর সেখানে রাখা যাবে না, তাই তারা মৃতদেহটিকে আইসোলেশনে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেন। দুই জন নার্স মৃতদেহটিকে আইসোলেশনে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
এদের মধ্যে একজন নার্স ছিলেন স্যালি বালডেরাস। তিনি মৃতদেহটিকে নিয়ে যাবার সময় হঠাৎই বমি করতে শুরু করলেন এবং নার্স জুলি গোরচেন্সকির মতো তার চেহারাতেও জ্বালা পোড়া শুরু হয় এবং শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।
তবে গোরচেন্সকির অবস্থা ছিল সবচেয়ে বেশি খারাপ। তাকে এক পর্যায়ে আই সি ইউ তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার অ্যাভেস্কুলার নেক্রোসিস (এটি এমন এক অবস্থা যার ফলে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে টিস্যুর মৃত্যু ঘটে) এর পরিস্থিতির সৃষ্টি ঘটে।
এভাবে আস্তে আস্তে করে গ্লোরিয়া রামিরেজের মাধ্যমে কোন এক অজানা রোগে হাসপাতালের মোট ২৩ জন ডাক্তার ও নার্স আক্রান্ত হয়।
প্রায় দুই ঘন্টা পর প্রোটেকটিভ স্যুট (Hazmat Suit) পড়া একটি একটি টিম সেই হাসপাতালে উপস্থিত হয়। তারা হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা - নিরীক্ষা চালানোর পর সেখানে তেমন কোন ক্ষতিকর কেমিক্যাল পান নি।
গ্লোরিয়ার ময়নাতদন্ত করার সময় তার দেহ থেকে টিস্যু, রক্তের স্যাম্পল, এবং অন্যান্য অংশ সংগ্রহ করে সেগুলো ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় পরীক্ষার জন্য কিন্তু অতি আশ্চর্যজনক তেমন কিছুই পাওয়া যায় নি।
প্রায় ১০ টি স্টেটের বিভিন্ন ধরনের তদন্তকর্মকর্তারা এ কেস নিয়ে তদন্ত চালান। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ২০ এপ্রিল রিভারসাইড ক্যালিফোরনিয়াতে গ্লোরিয়ার দাফন সম্পন্ন হয়।
এখন স্বভাবতই সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি উঠে আসে, কীভাবে একজন মহিলা নিজে অসুস্থ হবার পাশাপাশি এতজন মানুষকে অসুস্থ করে তুললেন?
বিভিন্ন তদন্ত কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এই ঘটনাটি তদন্ত করেছেন। তাদের তদন্তে উঠে এসেছে বিভিন্ন রকমের থিওরি। আজ আমরা সে রকমই কয়েকটি থিওরি সম্পর্কে জানবো।
থিওরি নং এক
প্রথম থিওরিটি প্রদান করা হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ সংস্থা থেকে। এই সংস্থার কর্মকরতাগণ সেই হাসপাতাল এবং ইমারজেন্সি রুমের মোট ৩৩ জন ডাক্তার ও নার্সের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এবং একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে তারা সবাই হিস্টেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।
উল্লেখ্য হিস্টেরিয়া হল এমন একটি রোগ যার প্রভাবে একজন মানুষের মাঝে অনিয়ন্ত্রিত আবেগের আধিক্য দেখা যায়। একজন হিস্টেরিয়াগ্রস্ত ব্যাক্তি অতিরিক্ত ভয় পেয়ে তার আত্ম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
হিস্টেরিয়ার মূল কারণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তবে হিস্টেরিয়া সংঘটনের জন্য বেশ কিছু পরিবেশগত ট্রিগার কাজ করে থাকে।
ক্যালিফোরনিয়া স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ সংস্থা মনে করে এই ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছিল রসুনের মতো সেই দুর্গন্ধ।
তবে একটি সাক্ষাৎকারে নার্স জুলি গোরচেন্সকি এবং নার্স মেরিন ওয়েলচ দুজনেই বলে ছিলেন যে তারা নিশ্চিতভাবেই হিস্টেরিয়া রোগে আক্রান্ত হন নি।
থিওরি নং দুই
দ্বিতীয় থিওরিটি এসেছে লিভারমোর ল্যাবরেটরি থেকে। এ থিওরি অনুযায়ী গ্লোরিয়া তার ক্যান্সারের ব্যথা কমানোর জন্য এক ধরনের জেল ব্যবহার করতো যার নাম ছিলো ডি এম এস ও (DMSO)।
এই জেলের মধ্যে তেল তেলে একটা ভাব ছিল আর সেই সাথে ছিল রসুনের মতো একটা দুর্গন্ধ। সম্ভবত নার্স আর ডাক্তাররা এই রসুনের মতো গন্ধটাই পেয়েছিলেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে,এই ডি এম এস ও জেলটি যে কোনোভাবে আর একটি অক্সিজেন পেলেই পরিণত হয় ডাইমেনথাইল সালফোন এ।
আর এই ডাইমিথাইল সালফোন নামক উপাদানটি ই ময়নাতদন্তের সময় গ্লোরিয়ার দেহে পাওয়া যায়। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ডাইমিথাইল সালফোন বিদ্যুতের সংস্পর্শে আসলে ডাইমিথাইল সালফেটে পরিণত হয়।
আর এই ডাই মিথাইল সালফেটের কারণে একজন মানুষের বমি বমি ভাব, অজ্ঞান প্রবণতা, হাত পা অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনা ঘটতে পারে।
একটু মিলিয়ে নিলেই দেখা যাবে যে, এই লক্ষণ গুলোই কিন্তু সেই নার্স আর ডাক্তারদের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিলো।
কিন্তু অন্যান্য বড় বড় বৈজ্ঞানিকেরা এই থিওরি সমর্থন করেন না কারণ লিভারমোর ল্যাবরেটরি এই থিওরির কোন পরীক্ষালব্ধ কোন প্রমাণ দিতে পারে নি।
থিওরি নং তিন
এ থিওরিটি এসেছে গ্লোরিয়া রামিরেজের পরিবার থেকে। তার পরিবার মনে করে গ্লোরিয়া এবং ডাক্তারদের এ রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার মূল কারণ হলো হাসপাতালের জঘন্য অবস্থা।
গ্লোরিয়ার মৃত্যুর তিন বছর আগে ১৯৯১ সালে সেখানে বিষাক্ত গ্যাস পাওয়া যায়। ১৯৯৩ সালে সেই হাসপাতালে শুয়ারেজ গ্যাস পাওয়া যায়। একটি সাক্ষাৎকারে গ্লোরিয়ার বোন ম্যাগি রামিরেজ বলেন,
"আমি নিশিতভাবে বলতে পারি, আমার বোন যদি ওই দিন ওই হাসপাতালে না যেত তাহলে কখনই তার এ অবস্থা হতো না।"
তবে রিভারসাইড কাউন্টি ব্যাপারটি যে লুকিয়েছে তার অবশ্য বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন ড্যান কুপিডো, যিনি গ্লোরিয়ার ময়নাতদন্ত করেছিলেন, তিনি প্রথমে বলেছিলেন যে গ্লোরিয়ার মৃত্যু স্বাভাবিক কোন মৃত্যু নয়।
কিন্তু কিছুদিন পর সে তার বক্তব্য পরিবর্তন করে বললো যে গ্লোরিয়ার মৃত্যু স্বাভাবিক ই ছিল। এছাড়াও স্টেফেনি আলব্রাইট নামক একজন তদন্ত কর্মকর্তা কেসটি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে হঠাৎই আত্মহত্যা করেন।
তবে রিভারসাইড কাউন্টির মুখপাত্র টম ডেসান্টস এর ভাষ্যমতে, স্বতন্ত্র তদন্ত কর্মকর্তাগণ এই কেসটি নিয়ে তদন্ত করেছিলেন কিন্তু তারা রহস্যজনক কিছুই পান নি।
পরিশেষে বলা যায়, প্রায় বহুদিন ধরে ঝুলে থাকা এই কেসটির কোন সমাধান করতে পারে নি তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ। হয়তো বা একদিন না একদিন জানা যাবে এর প্রকৃ্ত রহস্য।
আরও পড়ুনঃ মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ থেকে ইতালির স্বৈরশাসক হয়ে ওঠার গল্প