ঘুরে আসুন বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলা থেকে

দেশকে গুরুত্ব না দিয়ে চলে যায় বিদেশ। উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। অথচ আমাদের দেশের অনেক মানুষই দেশের এসব দেখতে চায় না। চলে যান পৃথিবীর অন্য সমুদ্র সৈকতে। কবি বলেছেন যে, দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দু’পা ফেলিয়া: একটি ধানের শীষে একটি শিশির বিন্দু। এ আমাদের এক বড় দূর্ভাগ্য।

ঘুরে আসুন বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলা থেকে
ঘুরে আসুন বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলা থেকে


মানুষ মনকে সতেজ ও আনন্দদায়ক করতে অনেক বিনোদনের মধ্যে ভ্রমণকেই বেছে নেয়। ভ্রমণ ইচ্ছুক অনেক মানুষ আছে। একটু সময় পেলেই তারা দেশে বা বিদেশে ঘুরতে যায়; মনকে করে সতেজ।


ঘোরার জন্য দেশে এবং বিদেশে অনেক স্থান আছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, প্রাগৈতিহাসিক, প্রাচীণ নিদর্শন, প্রত্নতাত্ত্বিক ইত্যাদি ভিত্তিক অনেক স্থান আছে।


আমাদের দেশে যেমন মানুষ ভ্রমণে বা ঘুরতে যায় ঠিক তেমনি দেশের বাইরেও যায়।


পৃথিবীতে এতো বেশী ঘোরার জায়গা আছে যে, তা যদি লিষ্ট করা হয় তবে কয়েকটি ডিকশনারী হয়ে যাবে। এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা দেশের প্রাকৃতিক স্থান, সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশণ, ধর্মীয় নির্দশন ইত্যাদি না দেখে দেশের বাইরে চলে যায়।


অথচ দেশের মধ্যে যে দেখার বা ভ্রমণের দর্শণীয় স্থানগুলো আছে সেখানে যেতে চায় না বা গুরুত্বও দেয় না। তারা গুরুত্ব দেয় বিদেশকে।


কিন্তু আমাদের দেশে যে সুন্দর সুন্দর স্থান, স্থাপত্য, প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শণ ইত্যাদি আছে, যা পৃথিবীর অনেক দেশেই নাই।


দেশকে গুরুত্ব না দিয়ে চলে যায় বিদেশ। উদাহরন স্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। অথচ আমাদের দেশের অনেক মানুষই দেশের এসব দেখতে চায় না।


চলে যান পৃথিবীর অন্য সমুদ্র সৈকতে। কবি বলেছেন যে, "দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দু’পা ফেলিয়া: একটি ধানের শীষে একটি শিশির বিন্দু”। এ আমাদের এক বড় দূর্ভাগ্য।


আবার আরেক শ্রেণীর ভ্রমণ পিয়াসু লোক আছে যারা আগে দেশের মধ্যে ভ্রমণ করতে বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করেন বা বেশী আগ্রহী। তাই তাদের জন্য আজকের এ প্রয়াস।


জেলা ভিত্তিক তথ্য থাকলে আপনার সময় ও অর্থ দু’টোই সাশ্রয়ী হবে। আজ আমরা পঞ্চগড় জেলার কোথায় কি আছে তা আমরা পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরব।


জেলা পরিচিতি

পঞ্চগড় বাংলাদেশের সর্বোত্তর জেলা বা জনপদ যা দেশের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে এবং হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। পঞ্চগড় জেলার তিন দিকেই ভারত যা ২৮৮ কিলোমিটার বেষ্টিত।


পঞ্চগড় জেলার আয়তন ১,৪০৪.৬৩ বর্গ কিলোমিটার মাত্র। ৫টি উপজেলা নিয়ে গঠিত পঞ্চগড় জেলা। পঞ্চগড় জেলা আয়তনে ছোট হলেও এর প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক ইতিবৃত্ত অনেক সমৃদ্ধ।


হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগে পুন্ড্র বর্ধন নগরীর অনতিদূরেই ছিল আজকের পঞ্চগড়ের অবস্থান বা ভিন্নমতে, গৌড় রাজ্যকে এক সময় বলা হতো পঞ্চগৌড়।


পঞ্চগড় জেলার সর্বোত্তরের উপজেলা তেঁতুুলিয়া যেখান থেকে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মধ্যে অথবা আকাশ পরিষ্কার থাকলে বছরের যে কোন সময়ই কাঞ্চনজঙ্গা চূড়া স্পষ্ট দেখা যায়।


জেলার দর্শণীয় স্থানগুলো -


১। মহারাজার দিঘী

ভিতরগড় দূর্গ নগরীর এক ঐতিহাসিক নিদর্শণ এ দিঘী যা মহারাজার দিঘী নামে পরিচিত। এটি পঞ্চগড় সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত। ১৫০০ বছর পূর্বে প্রায় ৫৬ একর জায়গা জুড়ে রাজা পৃথ্বিরাজ খনন করা হয় এ দিঘী।


দিঘীর আয়তন ৮০০ গজ/৪০০ গজ এবং গভীরতা ৪৫ ফুটের মত। দিঘীর চারটি পাড় জুড়ে শতবর্ষী নাম জানা বা না জানা বিশাল বিশাল গাছ এবং দিঘীর জল খুব স্বচ্ছ। শীতকালে এখানে প্রচুর পাখি আসে।


এছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ও অনেক পাখি এখানে বিচরণ করতে দেখা যায়। ২০১৮ সালে দিঘী এলাকাকে সরকার পাখির অভয় আশ্রয় হিসেবে ঘোষণা করেছেন। দিঘীর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন।


কথিত আছে যে, পৃথ্বি রাজা ’কীচক’ নামক এক নিম্ন শ্রেণীর আক্রমণের শিকার হন এবং নিম্ন শ্রেণীর সংষ্পর্শে ধর্ম নাশের হাত থেকে রক্ষা পেতে পরিবার পরিজন ও ধন রত্নসহ এই দিঘীতে আত্মহনন করেন।


বাংলা নববর্ষে দিঘীর চারিদিকে বিশাল মেলা হয় এবং পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও প্রচুর লোক এখানে এসে থাকেন।


মহারাজার দিঘীতে ঘুরতে গেলে সেখানকার পরিবেশ, গাছপালা, দিঘীর স্বচ্ছ পানি, পাখির কলকাকলী শরীর ও মনকে সত্যিই শান্ত করে দিবে। ঘুরে আসতে পারেন পরিবার, পরিজন ও বন্ধুদের সাথে।


২। রকস মিউজিয়াম বা পাথরের যাদুঘর

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের একমাত্র রকস বা পাথরের যাদুঘর পঞ্চগড় সরকারী মহিলা কলেজ চত্ত্বরে স্থাপন করেন। এই যাদুঘরে বিভিন্ন আকৃতি, বিভিন্ন রং, বিভিন্ন যুগের ও বিভিন্ন বৈশিষ্টের পাথর সংরক্ষিত আছে।


হাজার বছরের পুরানো পাথর ছাড়াও এখানে প্রাচীন ইরামতের ইট, পোড়ামাটির বিভিন্ন মূর্তিও আছে।


এখানে আদিবাসীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্রও সংরক্ষিত আছে যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বহন করে। এখানে বেশ কিছু বড় বড় পাথর এবং শাল কাঠ দিয়ে তৈরী ২২ ফুট দৈর্ঘ ৩০০ বছরের পুরানো একটি নৌকাও আছে।


এখানে ১ হাজারেরও বেশী পাথর সংরক্ষিত আছে। একবার হলেও ব্যতিক্রমী এই পাথরের যাদুঘর ঘুরে আসতে পারেন।


৩। গোলকধাম মন্দির

গোলকধাম মন্দির পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাংগা ইউনিযনে অবস্থিত। দেবীগঞ্জ উপজেলা হতে ১২ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত।


মন্দিরটি ১৮৪৬ সালে গোলক কৃষ্ণ গোস্বামীর স্মৃতি রাক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়। তাঁর নামেই নামকরণ করা হয় গোলকধাম মন্দির।


অষ্টাদশ শতাব্দী স্থাপত্যের একটি নিদর্শন যা গ্রীক স্থাপত্য কৌশলকে অনুসরণ করা হয়েছে। ছ’কোণা বিশিষ্ট মন্দিরটি একটি উঁচু প্লাটফরমের উপর নির্মিত।


মন্দিরে একটি মাত্র কক্ষ আছে এবং চারপাশে অনেক গাছপালা আছে। মন্দিরটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিকট তীর্থ স্থান হিসেবেও পরিচিত। প্রতিদিন অনেক সনাতন ধর্মী লোকেরা এখানে পুজা অর্চনা করে থাকেন।


৪। ভিতরগড়/ভিতরগড় দূর্গনগরী

পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলা থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ভিতরগড় দূর্গ নগরী যার উত্তরে আকাশচুম্বী হিমালয়, কাঞ্চনজঙগা, দার্জিলিং চা বাগান আরো কত কি।


এ এক অপরূপ সৌন্দর্য। ২৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই দূর্গ নগরী। এই দূর্গ নগরীর কিছু অংশ ভারত সীমানার মধ্যে রয়েছে। নগরীটি শক্রুদের আক্রমন থেকে রক্ষা করতে ইট ও পোড়ামাটি দিয়ে চার পরতে উঁচু প্রাচীর তৈরী ও পরীখা খনন করা হয়েছে।


এই ভেতরগড় নগরীর মধ্যেই মহারাজার দিঘী। এখানে দেখার মত অনেক প্রাচীন প্রত্ন তাত্ত্বিক নিদর্শণ আছে।


৫। তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো

জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে আছে একটি ঐতিহাসিক ডাক বাংলো। ডাক বাংলোর নির্মান শৈলী অনেকটা ভিক্টোরিয়া যুগের মত। যতদূর জানা যায় কুচবিহারের রাজা ডাক বাংলোটি তৈরী করেছিলেন।


এর পাশেই আছে একটি পিকনিক কর্ণার। স্থান দু’টি পাশাপাশি হওয়ার সৌন্দর্য বর্ধিত হয়েছে। ভারতের সীমান্তবর্তী মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষা সমতল ভূমি হতে ১৫-২০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।


স্থান দু’টি বর্ষাকালে যেমন উপভোগ্য ঠিক তেমনি শরৎ, হেমন্ত ও বসন্তকালেও উপভোগ্য। কারন এ সময়ে এখান থেকে কাঞ্চন জঙগা খুব ষ্পষ্ট দেখা যায়।


৬। মির্জাপুর শাহী মসজিদ

মির্জাপুর শাহী মসজিদ পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলায় অবস্থিত। মসজিদটির অনেক ঐতিহ্য এবং শিল্প শৈলী আছে। ৩৬৩ বছর পূর্বে এ মসজিদটি নির্মান করা হয়। দেখতে খুবই দর্শনীয়।


৭। বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির

বদেশ্বরী একটি প্রাচীন মন্দির। পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নে অবস্থিত। ২.৭৮ একর এলাকা জুড়ে এ মন্দির।


হিন্দু ধর্মের পুরানের অনেক পৌর কাহিনী এ মন্দিরে সাথে জড়িত। এ মন্দির ভ্রমণে অনেক অজানা বিষয় জানা যাবে।


৮। মিরগড়

পঞ্চগড় নাম থেকেই বোঝা যায় পাঁচটি গড় নিয়ে এ জেলা গঠিত। এই পাঁচটি গড়ের মধ্যে মিরগড় অন্যতম। পঞ্চগড় সদর উপজেলা হতে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ধাক্কামারা ইউনিয়নে এ গড় অবস্থিত।


তবে এ গড়ের অধিকাংশই ভারতের মধ্যে চলে গেছে।


৯। বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর

জিরো পয়েন্ট বলতেই বোঝা যায় শূন্য যেখান থেকে মূলত কিলোমিটার মাপ শুরু হয়। এটাই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত যা জিরো পয়েন্ট নামে পরিচিত। এখানে প্রচুর ভ্রমণ পিপাসু লোকদের ভীড় লেগেই থাকে।


বাংলাবান্দা স্থল বন্দরও এখানে অবস্থিত। এই স্থল বন্দর ১০ একর জায়গা জুড়ে। এখানে ভ্রমনে গেলে দেখা যাবে নযনাভিরাম দৃশ্য কেননা একদিকে মহানন্দা নদী, নদীর বৃক্ষরাজিসহ তীর এবং অপর দিকে ভারতের অংশ এবং দূরে কাঞ্চন জঙগা।


এ স্থল বন্দর দিয়েই নেপাল, ভূটান, গ্যাংটক, শিলিগুড়ি এবং দার্জিলিংসহ বহু স্থানে যাওয়া যায়।


১০। বার আউলিয়ার মাজার

জেলার আটোয়ারী উপজেলা হতে ৯ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে মির্জাপুর ইউনিয়নে আউলিয়ার মাঝার অবস্থিত। এখানেই বার আওলিয়ারা আস্তানা গড়ে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।


সময়ের বিবর্তনে এখানেই অলীদের সমাহিত করা হয়। আর গড়ে ওঠে বার আওলিয়ার মাজার শরীফ।


১১। সমতল ভূমিতে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত চা বাগান

পঞ্চগড় জেলার চা বাগান আরেক দেখার মত দৃশ্য। অনেকেই হয়তো জানেন যে, চা শুধু মাত্র পাহাড়ী এলাকা বা এদেশে সিলেট বা শ্রীমঙ্গল উপযুক্ত স্থান।


কিন্তু সমতল ভূমিতেও যে চা উৎপাদিত হয় এবং নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায় তা প্রমাণ করে পঞ্চগড় জেলার চা বাগান। চা বাগান মূলত তেঁতুলিয়া উপজেলায়।


পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার পুরোটা জুড়েই চা বাগান। তবে বৈচিত্র্য যা দেখা যাবে তা হলো সমতল ভুমিতে চা বাগান।


১২। কাঞ্চনজঙ্গা দর্শন

পঞ্চগড় যাবেন আর কাঞ্চন জঙগা দেখবেন না তাকি হতে পারে? পঞ্চগড় দেশের সর্বোত্তরের জেলা যেখান থেকে কাঞ্চন জঙগা দেখা যায়।


তবে সময়টি অক্টোবর থেকে নভেম্বররের মাঝামাঝি হলে ভাল। এ সময় আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং কুয়াশাও থাকে না। তেঁতুলিয়ার প্রায় সব জায়গা থেকেেই কাঞ্চন জঙগা দেখা যায় তবে ডাকবাংলো ও ভিতরগড় থেকে খুবই ষ্পষ্ট দেখা যায়।


দেশের পর্যটন স্থানগুলো পরিদর্শন কররে আমাদের নিজ অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। তাই চলুন একটু একটু করে ৬৪ জেলা ঘুরে আসি যার শুরু পঞ্চগড় জেলা দিয়ে।