ঘোর লেগেছিলো সেদিন
গল্পটা একজন আবেগপ্রবণ মানুষের ঘোর লাগা একটি দিনের গল্প। মানুষটি সেদিন একটি ফুলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেই ফুলটিকে নিয়ে তার ভাবনা, কল্পনা এবং সপ্নে তাকে কাছে পাওয়ার আকুলতা নিয়েই এই গল্প।

দিন -টি ছিলো বসন্তের মাঝামাঝি একটি দিন। বাংলাদেশের প্রকৃতির যে ছয়টি রুপ রয়েছে তার মধ্যে বসন্ত রফিকের কাছে বিশেষ প্রিয়। তাই কর্মব্যাস্ত জীবনের বেশিরভাগ ছুটিরদিন গুলো বাসায় বই পরে বা গান শুনে কাটিয়ে দিলেও বসন্ত ঋতুতে যে কয়টি ছুটির দিন থাকে তার প্রায় সব-কটি দিনেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ঘুরে বেরায় রফিক।
রফিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। চাকুরির সুবাদেই তাকে চট্টগ্রাম শহরে বদলি হতে হয়। রফিকের কাছে চট্টগ্রাম শহরে বদলি হওয়াটাকে তার সৌভাগ্য বলেই মনে হয়। কারণ চট্টগ্রাম শহর বাংলাদেশের একটি প্রধান পর্যটক আকর্ষণ শহর। এই শহরের সবুজ পাহাড়,বন,বিশাল বালুকাময় সৈকত সর্বদাই তাকে আকর্ষণ করে।
রফিক যেখানটিতে থাকে তার খুব কাছেই বাটালী পাহাড় ৷ সেদিন বিকেলে সেই বাটালী পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বেরোয় রফিক। ইতোপূর্বে রফিক একা কখনো ঘুরতে বেরোয়নি। সাথে বন্ধুবান্ধব কেউ না কেউ থাকে তবে আজকে সে একাই। সাথে বন্ধুবান্ধব থাকলে ঘুরে-বেড়ানোর আনন্দটা অনেক বেশি হয়। তবে একা,একা ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেও কিছু মজা আছে। নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা যায় এতে, তাছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও ভালোভাবে অনুভব করা যায় এবং চারপাশটাকে ও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয়।
পাহাড়ে উঠার রাস্তাটা অনেকটা সর্পিল আকৃতির। মনে হয় যেন বিশাল একটা অজগর সাপ পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে আঁকিয়েবাকিয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। তবে সহজ করে ভাবতে গেলে অনেকটা জিলাপির প্যাচ এর মতো। তাই স্থানীয় মানুষদের কাছে এই পাহাড় জিলাপির পাহাড় নামেই বেশি পরিচিত।
রাস্তাটা দিয়ে হাটতে, হাটতে রফিক ভাবে প্রকৃতি কতইনা বৈচিত্রময় সৌন্দর্যেে ভরা। এইযে সে পাহাড়টিতে উঠছে এই পাহাড় কত সুন্দর,পাহাড়ের চারিদিকে নানান রকমের বৃক্ষেরা সুন্দর, বৃক্ষের ডালে ডালে হরেকরকম পাখিরা সুন্দর,আবার এই সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ফুলের মতো অনেক সুন্দরী,সুন্দরী রমণীরাও এখানে এসেছে। রফিকের মনে হলো বসন্তের এই পরন্ত বিকেলে সুন্দরের পসরা সাজানো কোন এক মেলার ভিতর দিয়ে যেন হাটছে সে। এই মুহুর্তে একটি গান একটু অন্যরকম করে গাইতে ইচ্ছে করছে রফিকের -
হাজার হাজার সুন্দর দিয়ে মিলাইছ মেলা....খোদা তোমার দুনিয়ায় সব সুন্দরের মেলা.....
হঠাৎই একটি ফুলের দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি আঁটকে যায় রফিকের। পথের পাশেই সবুজের ফাঁকে ফুটে উঠা নীলচে রঙের একটি বুনো ফুল। রফিকের মনে হচ্ছিল যেন রুপকথার কোন এক রাজ্যের সবুজ গালিচায় বসে থাকা নব যৌবনা রূপসী এক রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
জীবনে ফুল এর আগেও অনেক দেখেছে রফিক। জানা অজানা নানান রঙের ফুল। কিন্তু এইভাবে দৃষ্টি আঁটকে যায়নি কখোনও। যতই দেখছে ততই যেনো দেখা'র ইচ্ছেটা বারছে। রফিকের ইচ্ছে হলো ফুলটিকে তার সাথে করে নিয়ে যেতে, তার ঘরে নিয়ে সাজিয়ে রাখতে, তারপর তাকে সে মন ভরে দেখতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবে গাছ থেকে ছিড়ে নিলে তো ফুল ব্যাথা পাবে। যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আছে তাকে কীভাবে ব্যাথা দিবে সে।
এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসছে। পাহাড়টিতে আরও যারা রফিকের মতো ঘুরতে এসেছিলো তারা সকলেই যার,যার আপন নিবাসে ফিরতে শুরু করেছে। রফিককেও তাদের দলে যোগ দিতে হবে। যদিও এই মুহুর্তে তার ফুলের মায়া ছেরে যেতে ইচ্ছে করছেনা তবুঅ যেতে হবে।
রফিক ঘরে ফিরার উদ্দেশ্য হাটতে শুরু করেছে। হাটতে হাটতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো পাখিগুলোও দিন শেষে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। এই মুহুর্তে পাখি আর মানুষগুলোর উদ্দেশ্য একই, ঘরে ফেরা। শুধুমাত্র দলটাই ভিন্ন। একটা পাখিদের দল অন্যটা মানুষের। মানুষের মধ্যে কেউ হাটছে নিশ্চুপভাবে কেউবা আবার মনের সুখে গান করতে করতে। পাখি গুলোও ঠিক যেন তাই। কোনো কোনো টি নিঃশব্দে উড়ছে কোনো কোনোটি আবার মধুর কন্ঠে গান করছে। এই পাহাড়ের গাছে, গাছেও অনেক পাখির বাসা আছে সেখানেও ফিরেছে অনেক পাখি তাদের কিচিরমিচির শব্দও কানে আসছে। রফিক ভাবে এই মুহুর্তে সে যদি পাখি হতো তাহলে কতইনা ভালো হতো। সেই ফুলের আশেপাশের কোনো এক গাছে বাসা বাধতো সে তারপর সেই ফুলের সাথে ভাব করতো।
পাহাড় থেকে নেমে এসেছে রফিক। এখন আর পাখিদের কিচিরমিচির শুনা যাচ্ছেনা এখন কানে আসছে রাস্তা দিয়ে চলাচল করা গাড়ির আওয়াজ। একটা জগৎ থেকে যেন অন্য একটা জগতে এসেছে সে। তবে ফুলটি এখনো তার চোখের মধ্যে ভাসছে। রফিক শুনেছে চোখ নাকি মনের কথা বলে তাহলে কি--- ফুলটি আমার মনের ভিতর গেথে গেলো ? আমি কি ফুলটির প্রেমে পড়ে গেলাম ? মাথার ব্যাক ব্রাশ করা চুলের উপর হাত বুলাতে বুলাতে এইসব এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে বাসার দিকে যাচ্ছে রফিক।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ গরম কফি আর বুদ্ধদেব গুহ এর একটি বই নিয়ে কিছুক্ষণ বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকার জন্য বসেছে রফিক। কিন্তু বেশিক্ষণ ডুবে থাকা গেলোনা। মনমাঝি সেই ফুলটি নিয়ে বারবার ভেলা ভাসাতে চাইছে।
রাতের খাবার শেষ করে সেদিন রাতে একটু তারাতারিই ঘুমোতে গেলো রফিক। ভেবেছিল রাতে বোধহয় সহজে ঘুম আসবেনা কিন্তু হলো ঠিক তার উল্টো। অন্যান্য দিনের তুলনায় সে রাতে ঘুম আরো বেশি পাচ্ছিল রফিকের। রাজ্যের সমস্ত ঘুম যেন তার চোখে। ঘুমিয়ে পরলো সে।
ঘুমের মধ্যে সপ্নের দেশে চলে গেলো রফিক। সেখানেও হাজির হলো সেই ফুল। সপ্নেও বাস্তবের মতো অপলক দৃষ্টিতে ফুলটির দিকে চেয়ে আছে রফিক।
হঠাৎই ফুলঃ রফিককে জিজ্ঞেস করলো কি দেখছো অমন করে ?
রফিকঃ- কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো তারপর তোতলাতে তোতলাতে বল্লো তো..তো..তোমাকে।
ফুলঃ- কেন ফুল আর দেখোনি বুঝি ?
রফিকঃ- হ্যাঁ দেখেছি, তবে তুমি আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ফুল।
ফুলঃ- একটুখানি হেসে তাই ভুঝি..?
রফিকঃ- হ্যাঁ সত্ত্যিই তাই, তোমাকে দেখার পর আমি নিজেকে তোমার মাঝে হারিয়ে ফেলেছি।
ফুলঃ- আবারো খানিক হেসে ও..মা.তাই...তাহলে এখন কী হবে..।
রফিকঃ- কি হবে তা তো জানিনা, তবে শুধু এটা জানি যে তোমাকে আমার চাই।
ফুলঃ- আমাকে তোমার চাই মানে ?
রফিকঃ-আমি তোমাকে আমার সঙ্গে নিতে চাই, খুব কাছ থেকে তোমার সুবাস নিতে চাই, যাবে তুমি আমার সঙ্গে ?
ফুলঃ- না।
রফিকঃ- না কেন।
ফুলঃ- তুমি এখন ঘোর এর মধ্যে আছো, যখন তোমার ঘোর কেটে যাবে তখন ? তখন তো তুমি আমায় ছুড়ে ফেলবে।
রফিকঃ- তোমাকে দেখার পর যে ঘোর আমার লেগেছে তা বোধহয় আর কাটবে না এই জীবনে, কথা দিচ্ছি অনেক যত্নে রাখবো তোমায় কখোনও ছুড়ে ফেলব না।
ফুলঃ- হুম...তা না হয় বুঝলাম কিন্তু আমি কী আর সারাজীবন সতেজ থাকব যে তুমি আমায় যত্নে রাখবে ? একটা সময় আমি শুকিয়ে যাবো, আমার সুবাস ফুড়িয়ে যাবে, তখন তুমি কী করবে ?
রফিকঃ- তোমার শুকিয়ে যাওয়া পাপড়ি গুলো রেখে দিব আমার জীবন ডায়েরির ভাঝে,ভাঝে। তারপর দিনের সকল ব্যাস্ততা শেষে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন আমি ডায়েরি টা নিয়ে বসবো। সেখানে শুধু তোমার আর আমার কথা লিখবো। আর ডায়েরির ভাঝে থাকা তোমার পাপড়ি গুলোর উপর হাত বুলিয়ে আদর করব, মাঝে মাঝে আলতো করে চুমু খাবো। একটা সময়ে তন্দ্রা এসে যখন ভর করবে আমার দু চোখে তখন ডায়েরি টা আমার বুকের মাঝে রেখে ঘুমিয়ে পরবো। কখনও হাড়িয়ে যেতে দেবোনা তোমায় ।
ফুলঃ- হুম... তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তুমি একটা আস্ত পাগল।
রফিকঃ- হ্যাঁ তোমাকে দেখার পর হয়ত আমি পাগল -ই হয়ে গেছি। এখন বলো তুমি যাবে কী এই পাগলের সাথে।
ফুলঃ-জানি না, তবে তুমি চাইলে তো আমাকে গাছ থেকে ছিড়ে নিতে পার ?
রফিকঃ- হ্যাঁ তা পারি, কিন্তু তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা বলেই তা করবোনা।
ফুলঃ- একটু ভাব নিয়ে - হুম.....।
রফিকঃ- কিছুটা অভিমানী কন্ঠে - হুম কী ?
ফুলঃ- ভাবছি... আমার জন্য যার এতো দরদ তাকে তো একবার পরীক্ষা করে দেখতে হয়, সে কী সত্যিই আমার দরদী বন্ধু, নাকি আমাকে পটানোর জন্য এইসব বলছে।
রফিকঃ- কী পরীক্ষা নেবে ?
ফুলঃ- বেশি কঠিন কিছু নয় আবার খুব একটা সহজ-অ নয়, কেন ভয় পেয়ে গেলে নাকি ?
রফিকঃ-মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার কাছে ভয় বলে কিছু থাকেনা। তুমি কি পরীক্ষা নিতে চাও তাই বলো।
ফুলঃ- এতোক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে যে ভাবে আমাকে দেখছিলে ঠিক একইভাবে এখানে দাড়িয়ে থাকবে। ততোক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে থাকবে -যতোক্ষণ না আমার মনে হবে যে তোমার প্রতিটি কথাই সত্ত্ব ছিলো। কী পারবে ?
রফিকঃ-এ-তো আমার সৌভাগ্য ফুলকুমারী। তোমাকে দেখে দেখে তো আমি হাসিমুখে মরতেও পারব। কিন্তু.. আমি বুঝবো কীভাবে যে তুমি আমার কথাগুলো বিশ্বাস করেছো ?
ফুলঃ- যখন আমি তোমাকে পুরোপুরিভাবে বিশ্বাস করতে পারবো, তখন বিধাতার কাছে পার্থনা করে আমি তোমার জন্য এই গাছ থেকে ঝড়ে পরবো। আর তখন তুমি আমাকে সঙ্গে নিতে পারবে।
পূর্ব আকাশে আরও একটি নতুন দিনের সূর্য উদিত হয়েছে বেশ কিছুক্ষন আগেই। রফিকের ঘরের জানালা দিয়ে সেই সূর্যের আলো এসে পরছে রফিকের চোখেমুখে।
ঘুম ভেঙ্গেছে রফিকের। বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে জানালার গ্রীলে ধরে, কপাল টা গ্রীলের সাথে ঠেকিয়ে বাহিরে তাকিয়ে -ফুলটিকে নিয়ে দেখা সপ্নের কথাগুলো কল্পনা করছে সে।
হঠাৎই বিছানার পাশে টেবিলের উপরে রাখা এলার্ম ঘড়িটা বেজে উঠল। প্রতিদিনের অফিস টাইম সেট করা এলার্ম এটি। রফিককে মনে করিয়ে দিলো কল্পনার জগতের ঘোড়ার লাগামটা এখন টেনে ধরতে হবে তাকে। সমস্ত কল্পনা গুলোকে আপাতত মনের এক কোণে বন্দি করে রেখে ফিরতে হবে কর্মব্যস্ত জীবনে।
প্রতিটি কর্মব্যস্ত দিনের রুটিন মতো তৈরী হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো রফিক। বাসা থেকে কিছুটা পথ পায়ে হেটে পেড়িয়ে তারপর বাসে চড়তে হবে।
যে পথটা দিয়ে রফিক হাটছে সেখান থেকে বা দিকে ঘাড়টা একটু ঘুরালেই চোখে পরে পাহাড়টা। যেখানে সে দেখেছিল সেই ফুল। রফিক একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো পাহাড়টার দিকে, পরক্ষণেই বুক ভরা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে - হেটে চললো সামনের দিকে।