জাতীয়তাবাদ কি? জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব সম্পর্কে জানুন
বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, জাতীয়তাবাদ হল এমন এক সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি যা পরস্পরকে ভালােবাসতে শেখায়। Nationalism is a sentiment of similarity and solidarity -Bertrand Russell

জাতীয়তাবাদ একটি আধুনিক ধারণা। ১৮ শতকে এর উদ্ভব ঘটে। ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক জাতীয়তাবাদের জনক বলা হয়।
একটি অবিভক্ত ইতালি রাষ্ট্রের ধারণা তিনিই প্রথম দেন। তবে ইংরেজরা জাতীয়তাবাদ বা জাতি সত্তার পথিকৃৎ। নেপোলিয়ানের বীরত্ব ও রাজ্য বিস্তার তাদের জাতি সত্তা জাগরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
এখন প্রশ্ন হলো জাতীয়তাবাদ কি?
জাতীয়তাবাদ একটি আর্থ-সামজিক ও রাজনৈতিক ধারণা। যেখানে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির লোকের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়। যা তাদেরকে বাইরের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করে সার্বভৌমত্ব অর্জনে, আত্ম নিয়ন্ত্রণে ও আত্ম পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করে।
জাতীয়তাবাদ হল কতকগুলো বিষয় সম্পর্কে জন সমষ্টির একাত্মবোধের প্রকাশ। জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার ফলশ্রুতি।
একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসমষ্টির মানসিক, অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার ফল। অর্থাৎ, জাতীয়তাবাদ হল এমন এক মতাদর্শ যা জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবিকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে।
কোনাে জনসমাজের মধ্যে বংশ, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি নানা কারণে যখন গভীর একাত্মবােধের সৃষ্টি হয় এবং এই একাত্মবােধের জন্য জনসমাজের প্রত্যেকে যখন নিজেকে সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায়, মান-অপমানের সমান অংশীদার বলে মনে করে তখন জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়।
দেশপ্রেম এই জাতীয়তাবােধের সঙ্গে মিলিত হয়ে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে। বার্নসের মতে, ইউরােপের নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদের ধারণার উৎপত্তি ঘটে।
বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, জাতীয়তাবাদ হল এমন এক সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি যা পরস্পরকে ভালােবাসতে শেখায়। ("Nationalism is a sentiment of similarity and solidarity")
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লয়েড জাতীয়তাবাদকে আধুনিক বিশ্বের ধর্ম বলে বর্ণনা করেছেন। লেনিন নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে শােষিত ও নির্যাতিত জাতির গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে জাতীয়তাবাদকে দেখেছে।
পৃথিবীর সকল জাতীয়তাবাদে দুটি বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন;
১. নিজেদের মধ্যে গভীর ঐক্যবোধ এবং
২. অন্যদের থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যবোধ
একটি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা কয়েকটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে জাগ্রত হয়। এগুলো হল-
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত, ভাষা, বর্ণ-গোত্র, ধর্ম, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, একই পূর্বপুরুষ হতে আগমন, একই অর্থনৈতিক স্বার্থ, রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষা, বীরত্বগাঁথা সম্বলিত ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ইত্যাদি।
জাতীয়তাবাদের বিকাশ
১৮ শতকে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। নেপোলিয়ানের রাজ্য বিস্তার এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ১৯ শতকে রাজনৈতিক ও সামজিক অঙ্গণে এটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদের উত্থান একটি।
১৯ শতকে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, সার্বিয়া, পোল্যান্ডে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি অন্যতম কারণ হল জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ইহুদী জাতীবাদের দ্বন্দ্ব।
জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন ধরনের হয়। যেমন:
১. নাগরিক জাতীয়তাবাদ(Civic Nationalism): নাগরিক জাতীয়তাবাদে সকল নাগরিক একই গোষ্ঠীভূক্ত না হয়েও রাজনৈতিক ভাবে একাত্মতা প্রকাশ করে। যেমন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ।
২. নৃতাত্ত্বিক জাতিয়তাবাদ(Ethnic Nationalism): একই গোত্র বা বর্ণের মানুষের জাতীয়তাবাদ। যেমন কুর্দি জাতীয়তাবাদ।
৩. ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ(Religious nationalism): ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুই রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হয় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ থেকে। ইসরাইলের ইহুদী জাতীয়তাবাদ ও এর একটি উদাহরণ।
৪. ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ(Territorial nationalism): একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মানুষ যারা কোন এক সুত্রে(ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ভাষা, ইত্যাদি) একাতাবদ্ধ হয়।
৫. উপনিবেশ বিরোধী জাতীয়তাবাদ(Anti-colonial nationalism): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকায় এ ধরনের জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। ফলে ইউরোপের উপনিবেশ গুলো ভেঙ্গে যায়।
৬. জাতিগত জাতীয়তাবাদ( Racial nationalism): শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাজ্ঞ ইত্যাদি হল জাতিগত জাতীয়তাবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জাতীয়তাবাদের সপক্ষে যুক্তি
১. জাতীয়তাবাদ জাতীকে ঐক্যবদ্ধ করে। তাদের আত্ম নিয়ন্ত্রণ ও আত্ম পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করে। ফলে গণতন্ত্রের উন্নয়ন ঘটে।
২. জাতী ঐক্যবদ্ধ হয়ে সে অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদকে সুষ্টুভাবে ব্যবহার করতে পারে। নিজেদের উন্নয়ন ঘটিয়ে বিশ্ব মানবের জন্য ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে।
৩. জাতীয়তাবাদ নিজের ক্ষুদ্র সার্থকে বৃহত্তর স্বার্থে বলি দিতে শেখায়। ফলে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম বৃদ্ধি পায়।
৪. এক জাতী একটি সাধারণ শাসকের দ্বারা শাসিত হয় বলে, নিজেদের মধ্যে বিভেদ হয় না। ফলে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. একটি জাতীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বীরত্বগাঁথা তাদেরকে মহান করে।
৬. জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে একটি বড় শক্ত।
জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তি
১. এক জাতীয়তাবাদের মানুষ অন্য জাতীয়তাবাদের মানুষকে ঘৃণা করে।
২. উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বে বার বার যুদ্ধ সৃষ্টি করে।
৩. জাতীয়তাবাদ মানুষের মনে হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। বিকৃত জাতীয়তাবাদ একটি ক্ষতিকারক বিষয়।
৪. জাতীয়তাবাদ ভৌগোলিক সীমারেখাকে সীমিত করে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মিশ্রণ রোধ করে দেয়। ও অন্যদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদের সৃষ্টি হয়।
৫. ভিন্ন মতাদর্শের প্রতি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে।
৬. বিকৃত জাতীয়তাবাদ থেকে সৃষ্টি হয় সাম্রাজ্যবাদের। যেমনটি দেখাগিয়েছিল হিটলারের মাঝে। আদর্শ জাতীয়তাবাদের মূল কথা, "নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও।” আদর্শ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক।
অপরদিকে, আদর্শ বা প্রকৃত জাতীয়তাবাদ কখনাে কখনাে আদর্শভ্রষ্ট হয়ে সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদে পরিণত হলে তা বিকৃত জাতীয়তাবাদে রূপ নেয়।
আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। মনে রাখবেন শুভ প্রভাত নতুন নতুন তথ্য নিয়ে আলোচনা করে শুধু আপনাদেরই জন্য। ধন্যবাদ।
আরও পড়ুনঃ প্রফেশনালিজম কি? কীভাবে প্রফেশনালিজম অর্জন করা যায় সেই সম্পর্কে জানুন