জানালার ওপাশেঃ রহস্যে ঘেরা একটি গল্প
চায়ের কেটলির চারপাশে সুক্ষ্ম ধোঁয়া উড়ছে। অসাধারণ চায়ের গন্ধ বেরিয়েছে। দীপু রান্না ঘরের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। তবে আবহাওয়া বার্তা বলছে অন্য কথা আজ সারাদিন রোদ থাকবে।

আরে আরে সব পরে গেলো!
আরে দাঁড়াও আসছি।
এসব বলতে বলতে দীপু চায়ের কেটলির দিকে এগিয়ে গেলো। কিছুটা চা পরে গিয়েছে।
এখন আবার কে এলো!
খুব বিরক্ত ভরে দরজার দিকে আড় চোখে তাকালো দীপু কোনো সাড়া শব্দ নেই। দরজা খুলে দেখে একটা শুকনো পাতার সাথে কয়েকটা পিঁপড়ে খুব যুদ্ধ করছে। মনে হয় তারা এটাকে তাদের ঘরে নিয়ে যেতে চায়। দীপু ঘরে ফিরে গিয়ে চা আর দুটো বাটার টোস্ট নিয়ে নাস্তা করতে বসে পরলো। নাস্তা শেষ করে টেবিলটা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো সে। একা মানুষ কোনো কাজ ফেলে রাখা মানে ক্ষানিকক্ষণ পরে সেটা তাকেই করতে হবে একগাদা বিরক্ত নিয়ে।
দীপু একজন মনস্তাত্ত্বিক। সে প্রতিদিন সকালে তার নাস্তা শেষ করে তার মোটা মোটা বই গুলো নিয়ে বসে পরে। কিন্তু কিছু দিন থেকে দীপুর মনটা কেমন যেনো উদাসীন হয়ে রয়েছে। তার জানালা দিয়ে দেখা যায় একটা বিশাল জঙ্গল ওর ওখানে যেতে মন চায়। ও জানালা খুলে ঐ দিকে তাকেলেই ওর কেনো জানি মনে হয় ওখানে কোনো রহস্য আছে।
ওমা আবহাওয়া বার্তা তো আজ পুরোই ভুল ঝুম ধরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আকাশ কালো হয়ে গিয়েছে। দীপুর আবার জুম বৃষ্টিতে খিচুড়ি খেতে বা এক দুপুর ঘুমোতে ইচ্ছে করে নাহ। ওর ঝুম বৃষ্টি দেখলে কবিতা আবৃত্তি শুনতে ভালো লাগে। আজ বৃষ্টিটা অন্যরকম ওর মন ওই জঙ্গলে যেতে চাচ্ছে।
আরে আরে এসব কি পানি রান্না ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পরেছে। সে চা বানাতে গিয়ে জানালা খুলেছিলো কিন্তু বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছে।
এই বিশ্রী অবস্থা এখন ঠিক করতে পারবো না দীপু বিরক্তি নিয়ে বললো । যেমন ভাবনা তেমন কাজ সে তার শোবার ঘরে যেয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পরলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আকাশ আরো কালো করেছে। দীপু জঙ্গলের ভিতরে হাঁটছে। বাহির থেকে যতোটা এলোমেলো লাগে জঙ্গলের ভিতরটা ততোটা এলোমেলো না। মনে হচ্ছে দীপু আসবে বলে কেউ সাজিয়ে রেখেছে। গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়ার পর দীপু দেখলো
একটা ছোট্ট কুয়ো আর তার পাশে অনেক গাছ । দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে গাছগুলো খুব যত্নে ওই কুয়োটাকে ঘিরে রেখেছে।
দীপু আরো একটু সামনে এগলো। আস্তে আস্তে কুয়োর কাছে গেলো। কুয়োটা অনেক বেশি পুরনো না। এই চার অথবা পাঁচ বছরের পুরনো হবে। দীপু কুয়োর ভিতরে তাকাতেই দেখে অনেকগুলো ছোট ছোট বাক্স। তাকে এটা অনেক বেশি অবাক করলো শুধু অবাক না এখন তার একটু ভয়ও লাগছে। সে মনে মনে ভাবছে এই জঙ্গলে সত্যি কিছু আছে। হঠাৎ সে পিছনে ফিরে দেখে তার পিছনে তার মতোই দেখতে একজন দাঁড়িয়ে আছে!
দীপু এখন সম্পূর্ণ নির্বাক এটা কিভাবে সম্ভব।
কিছু সময়ের জন্য দীপু একদম চুপ ছিলো তার মত অবিকল মানুষটাও চুপ করে ছিলো। কিছুক্ষণ পর দীপু জিজ্ঞেস করলো এই কুয়োটা কিসের আর তার ভিতরে বিভিন্ন আকারের বাক্স কেনো?
সে কোনো উত্তর পেলো নাহ।
একটু পর ওর অবিকল দেখতে মানুষটা বললো আমাকে অনুসরণ করে সামনে এগোতে থাকেন। দীপু কোনো কথা না বলে সেটাই করলো।
কিছু দূর যাওয়ার পর দীপু দেখলো কয়েকটা ভাঙ্গা ছোট ছোট দেয়ালের মতো। ঠিক দেয়াল না। খুব অল্প পরিসর জায়গাকে ঘিরে রেখেছে। দীপুর মতো অবিকল দেখতে লোকটা ওখানে গিয়ে বসলো। দীপু দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা তাকে কিছুই বলছে না। তারপর দীপু নিজেই সে জায়গায় গিয়ে বসলো।
লোকটি দীপুকে বললো। এখন চোখ বন্ধ করেন তাহলে আপনি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। দীপু প্রথমে ইতস্তত বোধ করলো। তারপর সে তার চোখ বন্ধ করলো।
দীপুর মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে সে একটা বদ্ধ জায়গায় চলে গিয়েছে। সে চোখ খোলার সাহস পাচ্ছে নাহ। কারণ সে অপ্রত্যাশিত কিছু দেখতে মোটেই প্রস্তুত নয়। কিন্তু তার দেখতেও ইচ্ছে করছে সে কোথায়। সে এটা অনুভব করছে তার সাথে এখন কেউ নেই। যেখানে দীপু আছে সেখানে একটা প্রাণীই আছে আর সেটা হচ্ছে সে নিজে।
নাহ চোখটা খোলা উচিত যে জিনিস তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটাকে দেখতে হবে। কারণ হয়তো এটা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প কিছু নেই।
দীপু চোখ খোলার পর নিজের চারপাশে বিশাল এক প্রাচীর আবিষ্কার করলো। খুব ক্ষীণ আলো যেটা অতি সামান্য। দীপু চারপাশে ভালো করে দেখলো এবং সে খুব ভালো করে বুঝতে পারলো সে এখন সেই কুয়োর ভিতরে। কিন্তু কি অদ্ভুত বিষয় দীপু যখন প্রথম কুয়োটা দেখেছিলো সেখানে অনেকগুলো বাক্স ছিলো। কিন্তু এখন মাত্র একটা বাক্স।
অনেকটা সময় দীপু চুপ করে বসেছিল। কারণ সে অনুভব করছে তার মস্তিষ্ক জমাট বেঁধে আছে। সে কিছুই ভাবতে পাচ্ছে না। সহজ ভাবে বলতে গেলে সে অনুভব করছে তার মস্তিষ্কের সকল প্রকার ইনপুট এবং আউটপুট সিস্টেম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার মানে সে এখন মস্তিষ্কের দিক থেকে একদম অচল। কিন্তু তাকে এখন এটা বুঝতে হবে সে ভয় পাচ্ছে কি না যদি তাই হয়ে থাকে। তাহলে সে যদি নিজেকে এটা বুঝাতে সক্ষম হয় ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। তাহলে তার মস্তিষ্কের জমাট খুলতে শুরু করবে। আর যদি পরিবেশটাই এমন হয় এখানে যতোক্ষণ থাকবে তার মস্তিষ্ক জমাট বেধেই থাকবে। তাহলে এর মানে এই দাড়াচ্ছে এখান থেকে যদি সে ফিরে যেতে পারে। তার কিছুই মনে থাকবে নাহ। কারণ মানুষ চোখে যা দেখে সেটা মস্তিষ্কে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু সে যেমনটা অনুভব করছে তার মস্তিষ্ক পুরোপুরি অচল।
দীপু আর দেরি নাহ করে বাক্সটা খুললো। সে একটা কাগজ পেলো। মাত্র দুটো লাইন লেখা।
লাইন গুলো ছিলো এমন " মেয়েটি বাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো তারপর সে কোথায় দীপু?" এই একটি লাইন দু'বার লেখা। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে দীপুর নাম লিখা। আসলেই বিষয়টি অপ্রত্যাশিত।
কিন্তু কোন মেয়ে কোন বাস দীপু এসব ভাবতে শুরু করলো। কিন্তু তার মস্তিষ্ক বর্তমানে কোনো কিছু নিতে মোটেই প্রস্তুত নয়। তাহলে সে কি এই কাগজটা তার পকেটে নিয়ে নিবে না কি? এতো সব ভেবে কি হবে! এখন মূলত যেটা ভাবতে হবে সেটা হচ্ছে এই বদ্ধ দেয়াল থেকে সে কিভাবে মুক্তি পাবে।
ঘামতে শুরু করলো সে। একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ।
ধুপ ধুপ শব্দ।
দীপুর এখন মনে হচ্ছে তার চোখ দুটো বন্ধ এবং তার শরীর স্থির হয়ে আছে।
আবারো একি শব্দ দীপু চোখ খুলে দেখে সে তার শোবার ঘরে তার বিছানার উপর শুয়ে আছে। তার মানে ওটা কি স্বপ্ন ছিলো! দীপু তারাতাড়ি তার পকেটে হাত দিলো কাগজটা সে কি এনেছে। অদ্ভুত বিষয় কাজটা তার পকেটে। কিন্তু তার স্বপ্নে দেখা লাইনটা আর এই লাইনটায় ছোট একটু অমিল রয়েছে। সেটা হলো স্বপ্নে দেখা লেখাতে তার নাম লেখা ছিলো। কিন্তু এখন আর সেটা লেখা নেই!
এটা কিভাবে সম্ভব!
আচ্ছা আগে এই স্বপ্নের ঘোর থেকে বের হতে হবে তাকে। তাই সে তার শার্ট বদলে একটা সিগারেট হাতে নিয়ে সোজা ছাদে চলে গেলো। এখন সে একটু নিশ্বাস নিতে পাচ্ছে। তার মস্তিষ্কও কাজ করা শুরু করেছে। তার মানে এখন সে ভাবতে পারবে।
দীপু যে বাড়িতে ভাড়া থাকে সে বাড়ির ছাদ থেকে জঙ্গলটা অনেকটাই দেখা যায়। সে এক দৃষ্টিতে ওই দিকেই তাকিয়ে থাকলো।
আচ্ছা না হয় ওটা স্বপ্নই ছিলো। কিন্তু এই কাগজটা এটা তো বাস্তব এই মুহূর্তে তার হাতে। সে বিরবির করে বললো তাহলে আমি কি বাস্তবতার স্বপ্নে ছিলাম না কি অবচেতন মনে যে জগৎ আছে সেই জগতে ছিলাম। আচ্ছা যখানেই থাকি এখন বড় সত্যি হচ্ছে এই এক টুকরো কাগজ।
হঠাৎ দীপু চমকে উঠলো। তার মনে পরে গেলো এই কাগজটা তার এক সহকর্মী তাকে দিয়েছিলো। আর বলে গিয়েছিল এই গল্পটা আর একদিন বলবো।
তারপর দীপু নিজের কিছু কাজে শহরের বাহিরে চলে যায়। প্রায় সাত দিন পর বাড়ি ফিরে। তার মানে এই কাগজটা তার কাছে প্রায় অর্ধমাস থেকে আছে। তার যতোদূর মনে পরে তাকে তার সহকর্মী এটাই বলেছিলো মেয়েটা মানুষিক ভাবে অসুস্থ ছিলো। সবাই মনে করে বাস দুর্ঘটনায় মেয়েটা মারা যায়। আসলে দুর্ঘটনার দু'দিন পরে মারা যায়। কিন্তু তার আত্মীয়রা বলে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছিল তারা আশাবাদী ছিলো সে বেঁচে ফিরবে।
কিন্তু কি হলো যে সে আর ফিরলো না। আর এমন কি গল্প আছে যে সেটা আমাকে ঐ দিন বলা হলো না।
আজকের আবহাওয়া বার্তার মতো মেয়েটার মৃত্যু। ডাক্তারের রিপোর্ট বললো সে বেঁচে ফিরবে কিন্তু সে ফিরলো না। অবশ্যই এটা কোনো সাধারণ হিসেব না।
দীপু আধ খাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিলো। খুব দ্রুত নিচে নেমে তার ডায়রি, কলম আর কাগটা নিয়ে বের হয়ে গেলো।
বৃষ্টি এখনো থামেনি। দীপু তার ডায়রির মাঝে সেই কাগজটা রাখলো তারপর ছিপছিপ বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে শুরু করলো। সে যতো পা এগোচ্ছে মনে হচ্ছে সে একটা রহস্য ভেদ করে এগোচ্ছে।
সে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো স্বপ্নে দেখা তার মতো অবিকল দেখতে মানুষটি আর কেউ নয় তার অবচেতন মন। হয়তো সেই মেয়েটি আর আমার অবচেতন মন চাচ্ছে আমি এই রহস্যের অনেকটা কাছে যাই।
তবে তাই হোক!
দীপু মুচকি হেসে বলে উঠলো ' মন তুই তো ভবোঘুরে তোর চলার পথ অসীম । '