জীবনানন্দ দাশ: আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ এর গল্প জানুন
বাংলা সাহিত্যের আকাশে জ্বলজ্বল করা নক্ষত্রের নাম জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় প্রাণ পেয়েছে বাংলার রূপবৈচিত্র আর জীবনবোধ। আজকের লেখাটি শুদ্ধতম এই কবিকে নিয়েই।

জীবনানন্দ দাশ আর কবিতা যেন সমার্থক শব্দ। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন প্রবাদপ্রতিম মানুষ। ছিলেন অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক ও লেখক।
বাংলা কাব্যে আধুনিকতার চর্চায় তিনি ছিলেন অনন্য। পরাবাস্তবতার কবিতা লেখা এই কবি কিন্তু জীবদ্দশায় ততটা সমাদৃত হননি, যতটা মৃত্যুর পরে জনপ্রিয় হয়েছেন।
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বরিশাল সে সময় ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তবে তাঁর পূর্বপুরুষেরা ঢাকার বিক্রমপুরের নিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশও একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। তার লেখা 'আদর্শ ছেলে' কবিতাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
পিতামাতার বড় সন্তান জীবনানন্দের ডাকনাম ছিল মিলু। মায়ের কাছেই তাঁর বাল্যশিক্ষার হাতেখড়ি হয়। ছোটবেলায় তাঁর পদবি ছিল দাশগুপ্ত।
তবে ত্রিশের দশকে তিনি গুপ্ত বাদ দিয়ে শুধু দাশ লিখতে শুরু করেন। ১৯০৮ সালে ৮ বছর বয়সের মিলু ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে ভর্তি হন পঞ্চম শ্রেণিতে।
১৯১৫ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ব্রজমোহন কলেজ থেকেই পাশ করেন ইন্টারমিডিয়েট।
জীবনানন্দ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে ইংরেজিতে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ঐ বছরই 'বর্ষ আবাহন' নামে তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২১ সালে তিনি ইংরেজিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও তা শেষ করেননি। ১৯২২ সালে কলকাতা সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
তরুণ বয়সেই জীবনানন্দের কবি প্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। ১৯২৫ সালে বঙ্গবাণী পত্রিকায় তাঁর 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি বিখ্যাত পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হতে থাকে।
জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক' ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর কয়েকমাস পরেই সিটি কলেজের চাকরি হারান। এটি বহুকাল তাঁর মনোকষ্টের কারণ ছিল।
অপরদিকে এ সময় তাঁর কবিতাও প্রবল সমালোচনার মুখোমুখি হয়। কলকাতায় কাজ ছিল না বলে কবি বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। তবে মাত্র দু'মাসের মাথায় তিনি কলকাতায় ফিরে এসে প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং এ ওঠেন।
জীবনানন্দ দাশের চাকরি না থাকায় এ সময়গুলো প্রবল অর্থকষ্টে কাটান। এমনকি গৃহশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন।
১৯৩০ সালে তিনি লাবণ্য দেবীকে বিয়ে করেন। তারপর প্রায় ৫ বছর জীবনানন্দ কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু পিতা জীবিত ছিলেন এবং স্ত্রী ছিলেন বরিশালে, তাই তাঁর ব্যক্তিগত দুর্দশার আঁচ সে সময় পরিবারের গায়ে লাগেনি।
জীবনানন্দ ১৯৩৫ সালে ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেন 'কবিতা' নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন।
এই পত্রিকায় জীবনানন্দের কবিতা ছাপা হতো। এখানেই প্রকাশিত হয় 'বনলতা সেন' কবিতাটি। ১৮ লাইনের এই কবিতাটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতাগুলোর একটি।
চাকরির প্রয়োজনে বরিশালে থাকতে হলেও কলকাতার জীবন কবিকে আকৃষ্ট করতো। সুযোগ পেলেই তিনি চলে যেতেন কলকাতায়।
১৯৪৭ সালে কবি সপরিবারে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। এখানে তিনি আরো কয়েকটি চাকরি করলেও তার স্থায়িত্ব ছিল খুবই কম। অপরদিকে সাহিত্যিক সমাজে তিনি নিজের অবস্থান তৈরি করেছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের ঝরা পালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, রূপসী বাংলা, বেলা অবেলা কালবেলা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ জনপ্রিয়তা পায়।
মাল্যবান ও সতীর্থ নামে দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয় 'কবিতার কথা' প্রবন্ধ গ্রন্থটি।
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য আর নিসর্গ জীবনানন্দের কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাই তিনি হয়ে উঠেছেন 'রূপসী বাংলার কবি।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা পড়ে তাঁকে বলেছেন 'চিত্ররূপময়তার কবি।' বুদ্ধদেব বসু তাঁকে বলেছেন 'নির্জনতম কবি।'
আর অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে তিনি ছিলেন 'শুদ্ধতম কবি।' রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে তাঁকেই প্রধান কবি মনে করেন অনেকে।
১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় মৃত্যু বরণ করেন অভিমানী এই কবি। তাঁর মৃত্যুর কারণ ছিল ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হওয়া।
অথচ কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার আর কোনো ঘটনাই জানা যায় না। কি জানি কোন অভিমানে মাত্র ৫৫ বছর বয়সেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন মরণের ওপারে।
জীবদ্দশায় ততটা সমাদৃত না হলেও তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁকে বলা হতো জনবিচ্ছিন্ন কবি। অথচ তাঁর কবিতাই এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তাঁর কবিতায়ই জীবন খুঁজে পাই আমরা সবাই।
আরও পড়ুনঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক