ডিপ্রেশনঃ আর অবহেলা না করে হন সতর্ক
সারাবিশ্বে একটি প্রসিদ্ধ রোগের নাম ডিপ্রেশন। কিন্তু আমাদের দেশে এই রোগ নিয়ে আছে নানান ভুল বোঝাবুঝি। প্রায়শই আমরা সাধারণ বিষণ্ণতা কে ডিপ্রেশন ভেবে বসি। অথচ ডিপ্রেশন একেবারেই স্বতন্ত্র আলাদা একটি রোগ। যা রোগীকে নিয়ে যাতে পারে আত্মহননের দুয়ারে.. তাই আজ আমি আলোচনা করেছি,ভয়ংকর কিন্তু নিরাময়যোগ্য এই মানসিক রোগটি নিয়ে..

সারা পৃথিবীতে ডিপ্রেশন খুবই কমন ও বহুল আক্রান্তপ্রবণ একটি রোগের নাম। ডিপ্রেশন একটি এমন অসুস্থতার নাম,যাআপনার অনুভুতি এবং চিন্তা কে খুব বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে আনন্দের বিষয় হলো,এই রোগ সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য।
ডিপ্রেশন রোগীকে দিনের অধিকাংশ সময় মানসিকভাবে কষ্ট দেয়। রোগী অধিকাংশ সময় প্রচন্ড বিষন্নতায় ভোগে, এমনকি যেগুলো করলে রোগীর মন ভাল থাকতো সেগুলো করতেও আগ্রহ থাকেনা।
ডিপ্রেশন একজনকে শারিরীক ও মানসিকভাবে এমনই পর্যদুস্থ করে তুলতে পারে,যে ঘরে ও বাইরের কাজেকর্মের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। পড়াশোনায় দূর্বল করে দিতে পারে। বাবা মা অথবা স্ত্রী -সন্তানদের সাথে সম্পর্কে অবণতি আসতে পারে। এমনকি আত্মহত্যা...
লক্ষণসমূহ-
ডিপ্রেশনে একাধিক লক্ষণ থাকতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ের ডিপ্রেশনের লক্ষণ হয় অল্প কিছু,কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে লক্ষণের সংখ্যা বাড়ে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে,নিম্নোক্ত দু একটি লক্ষণ কারো মাঝে দেখা গেলেই সে ডিপ্রেশনের ভুগছে এমনটা ভাবা ঠিক নয়,একাধিক লক্ষণ পাওয়া গেলে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে নিশ্চিত হতে হবে।
- দিনের অধিকাংশ সময় বিষন্নতা অথবা ডিপ্রেসড মানসিকতা।
- আগে যেগুলো করতে ভাল লাগত,সেগুলোও ভাল না লাগা,আগ্রহ না থাকা।
- আকস্মিক শরীরের ওজনের পরিবর্তন,ওজন খুব বেড়ে যাওয়া অথবা কমে যাওয়া।
- ঘুমাতে সমস্যা হওয়া অথবা খুব বেশি ঘুমানো
- কোন কিছু করতে এনার্জি না পাওয়া অথবা খুব দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যাওয়া।
- অকারনে উদ্দেশ্যহীন কাজ করা। যেমন অহেতুক কাগজে আকিবুকি করা,স্থির হয়ে লম্বা সময় বসে থাকা। (এগুলো এতবেশি হবে যে,অন্যের চোখে ধরা পড়বে)
- নিজেকে ব্যর্থ অথবা দোষী ভাবতে থাকা।
- চিন্তা করতে অথবা কোন জিনিস মনোযোগ দিতে কষ্ট হওয়া,সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা।
- আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসা অথবা মরে যেতে ইচ্ছা করা।
উপরোক্ত লক্ষণগুলো দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হতে হবে। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অভিজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ জরুরি কেননা অনেকসময় থাইরডের সমস্যা অথবা ব্রেইন টিউমার,কোন ভিটামিনের ঘাটতিও উপরোক্ত লক্ষণসমূহের কারণ হতে পারে । তাই বিশেষজ্ঞের নির্ণয়করণ জরুরি।
প্রত্যেক বছর প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি পনেরো জনের একজন ডিপ্রেশনে ভোগেন। প্রতি ছয়জনের একজন তাদের জীবনে কোন একসময় ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছেন। একজন মানুষের যেকোন সময়ে ডিপ্রেশন হতে পারে,তবে প্রথম আক্রান্ত হওয়াটা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সাধারণত বেশি দেখা যায়। নারীদের আক্রান্ত হওয়ার হার পুরুষদের থেকে বেশি। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে তিনভাগের একভাগ নারীরা তাদের জীবনের যেকোন এক সময় মেজর ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছেন।
ডিপ্রেশন ও মন খারাপ এক নয় !
আমাদের দেশে একটি বহুল প্রচারিত ভূল ধারণা হচ্ছে,মন খারাপেরই অপর নাম হচ্ছে ডিপ্রেশন। যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।অনেকে আবার মনে করি,এগুলো অলস বড়লোকি অভ্যাস,যা একেবারে ভুল ও দু:খজনক। ক্লিনিকাল ডিপ্রেশন শারীরিকরোগের মতই একটি সিরিয়াস রোগ,যার জন্য ডাক্তার ও চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।
কাছের কারো মারা যাওয়া,চাকরি হারিয়ে ফেলা,সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে আমরা বিষন্ন হই। যা অনেকসময়ই একটা সময় পরে কেটে যায়,অথবা আমরা সবাইই কোন না কোন কারণে বিষণ্ণ থাকি,কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষণ্ণতা ও ডিপ্রেশনের বিষণ্ণতা এক নয়। তবে,অনেকসময় সাধারণ বিষণ্ণতাও একসময়ে ডিপ্রেশনে পরিণত হতে পারে। তবে,সাধারণভাবে সাধারণ মনখারাপ ও ডিপ্রেশনের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যগুলো হলো-
- সাধারণ মন খারাপগুলো অনেকটা ঢেউয়ের মত হঠাত কখনো কখনো আসে। কখনো কখনো ইতিবাচক চিন্তার সাথেওবিষণ্ণতা যুক্ত হয়। বিপরীত দিকে মেজর ডিপ্রেশন একাধারে প্রায় টানা দুই সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে,এবং ফিরে আসে।এছাড়া ডিপ্রেশনজণিত বিষন্নতায় ইতিবাচকতা একেবারে থাকেনা বললেই চলে।
- সাধারণ বিষণ্ণতায় আত্মবিশ্বাস স্বাভাবিক থাকে। মেজর ডিপ্রেশনে নিজেকে খুবই ব্যর্থ,তুচ্ছ,নিজেকে ঘৃণা করার প্রবণতাদেখা যায়।
- সাধারণ বিষণ্ণতায় আত্মহননের চিন্তা হয়তো দুই একবার খানিক সময়ের জন্য আসতে পারে। কিন্তু ডিপ্রেশনে আত্মহননের চিন্তা,নিজের বেচে থাকতে ঘৃণা করা এবং নিজেকে প্রচন্ড ব্যর্থ মনে করা,ডিপ্রেশনের সাথে বেচে থাকার কষ্ট না নিতে পারায় বারবার ও উদ্দেশ্যমূলক ভাবে আসতে দেখা যায়।
চিকিৎসা
মানসিক অসুস্থতার মধ্যে ডিপ্রেশনের সবচে বেশি নিরাময়ের হার পাওয়া যায়। প্রায় আশি থেকে নব্বই ভাগ মানুশ চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে যায় এবং প্রায় প্রত্যেক রোগীই চিকিৎসা নেয়ার পর তার কোন না কোন লক্ষণ সমূহ থেকে উত্তরণ ঘটে।
মেডিকেশন:
অনেক সময় ডাক্তাররা ডিপ্রেশনের জন্য ঔষধ সাজেস্ট করেন,যেগুলোকে এন্টিডিপ্রেসেন্ট বলা হয়। এধরনের ঔষধ দেয়া হলে দুসপ্তাহ অথবা ক্ষেত্রবিশেষে মাসখানেক পর উন্নতি দেখা দেয়।
এধরনের ঔষধের বিশেষ কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। এছাড়াও এই ঔষধসমূহ কোন নিয়ন্ত্রক জাতীয় কিছু নয়। সুতরাং অনেকেই রয়েছেন যারা,এই ঔষধ খেলে সেগুলোর উপর সারাজীবন নির্ভর করতে হবে এই ভয় পান,সঠিকভাবে নিয়মিত চিকিৎসা নিলে এই ভয় অমূলক।
তবে মনে রাখবেন,ঔষধ সেবন থেকে শুরু করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচণ কেবলই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ীই করা উচিত।
সাইকোথেরাপি
সাইকোথেরাপি যা রোগীর সাথে কথাবার্তা এবং তার কথাগুলো কে শুনে চিন্তা ও আবেগকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার চেষ্টা করা হয়। এধরনের চিকিৎসা রোগীর নেতিবাচক চিন্তাসমূহ কে ইতিবাচকতায় পরিণত করতে খুবই সহায়তা করে।
এধরনের চিকিৎসা সাধারণত প্রাথমিক ডিপ্রেশনের জন্য খুবই সহায়ক। রোগী মন খুলে কথা বলার সাথে সাথেই খুব দ্রুতই তার সমস্যাগুলো কেটে যেতে শুরু করে।
সাধারণত এইধরনের চিকিৎসায় সফলতা পেতে কয়েক সপ্তাহ লাগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দশ থেকে পনেরো সেশনে সফলতা বেশি পাওয়া গেছে।
প্রয়োজন সচেতনতা
আমাদের দেশে ডিপ্রেশন নিয়ে এখনো অনেক ভুল ধারণা,ভীতি এবং তাচ্ছিল্য রয়েছে। অথচ ডিপ্রেশন অন্য দশটা শারীরিক রোগের মতই এক রোগ। যে এই রোগে ভুগছে,কেবল সেই বুঝতে পারবে এর যন্ত্রণা কত কষ্টদায়ক। অথচ এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য এবং সুস্থ্যতার হার অনেক বেশি।
অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে খরচ অনেকেরই নাগালের বাইরে থাকে,তাই এই বিষয়ে দায়িত্বশীলদের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া উচিত । সরকারী হাসপাতালগুলোতে মানসিক সুস্থতা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেলে সর্বস্তরের মানুষের জন্য এই চিকিৎসালাভের সুযোগ আরো বৃদ্ধি পেত।
দিনশেষ তাই এই রোগ প্রতিরোধে চাই সর্বস্তরে সামাজিক সচেতনতা,মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান ও আক্রান্তদের জন্য ভালবাসা।