দুটো শহুরে পাখি বা একটা 'না' প্রেমের গল্প
এটি একটি প্রেমের গল্প। দুজন লোক সুযোগে মিলিত হয় এবং প্রেমে পড়ে। তারা একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছে কিন্তু তারা আলাদা না হওয়া পর্যন্ত তা বুঝতে পারে না। এই গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেবে যে এটি আমাদের তৈরি স্মৃতি যা আমাদের চিরকাল ধরে রাখে।

১.তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল বড় অদ্ভুত ভাবে। বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের ছাদে বসে সিঙ্গারা খাচ্ছিলাম। বিকেল বেলা। পুরো ছাদটাই লোকে সমাগম ছিল। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। আমার টেবিলে দু'টো চেয়ার। বাকিগুলো এদিক-ওদিক টেনে নিয়েছে।
একটা ছেলে এককাপ কফি আর অন্যহাতে ফান্টা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর সহজ ভঙ্গিতে বলল, "এখানে বসতে পারি? কোথাও চেয়ার পাচ্ছি না।" আমি তাকালাম। ভদ্রস্থ চেহারা। মাথার চুল ছোট করে ছাটা। মুখে হালকা দাঁড়ি গোঁফ। শ্যামলা ছিপছিপে শরীর।
প্লেটে সিঙ্গারাটা রেখে হাত ঝেড়ে অন্য চেয়ারটা থেকে আমার ব্যাগটা সরাতে সরাতে বললাম, "জ্বি বসুন।" সে ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলো। তারপর অনেকটা আকাশের দিকে স্থির তাকিয়ে কফি খেতে লাগলো। আমার ততক্ষনে খাওয়া প্রায় শেষ।
শেষ গ্রাস মুখে তুলে চিবুতে চিবুতে টিস্যুতে হাত মুছে উঠে দাঁড়ালাম। ছেলেটা তখন হাত থেকে কাপটা নামিয়ে রেখে আমার দিকে চেয়ে খানিক হাসলো। কটমটে শুকনো একটা হাসি ফেরত দিয়ে হনহনিয়ে নেমে এলাম আমি। চলে যেতে যেতে আড়চোখে দেখলাম ছেলেটা হাসি হাসি মুখে ফান্টার বোতল খুলছে।
তারপরে আর কিছু হওয়ার ছিল না। আমার সাদামাটা সহজ সরল জীবনে চা-ফান্টা একসাথে খাওয়া মানুষ দেখাই বিশাল রোমাঞ্চকর ব্যাপার! এ তো আর নাটক-সিনেমা নয়। গল্পও নয়।
রিকশা ধরে বাড়ি চলে এসেছিলাম। দিনকাল নিত্যকার মতো চলছিল। কলেজ, কোচিং, বই পড়া কর্মসূচি, বন্ধুত্ব, ব্যস্ততা, অবসর– বেশ ভালোই। তার কথা ভুলেই গেছিলাম। মনে থাকার কথাও অবশ্য নয়।
প্রায় দু'বছর পর ছেলেটার সাথে আবার দেখা হলো। আর কোনদিন দেখা হবে তা ভাবি নি কখনো, চিনতে পারব সে তো দূরের কথা। ভার্সিটির ক্যান্টিনে গিজগিজ করছিল লোকজনে। একদম কোণায় নোংরা দেওয়ালের ধারে একটা ফাঁকা টেবিল দেখে দ্রুত হেঁটে গিয়ে দখল করলাম। দু'টো চেয়ার। অন্যটাতে ব্যাগটা রেখে কেবল সিঙ্গারায় কামড় বসিয়েছি – "এখানে একটু বসতে পারি?" চমৎকার নমনীয় কন্ঠস্বর।
তাকাতেই অপ্রস্তুতের মতো হাসলো। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলাম বসার কোন জায়গা আদৌ ফাঁকা নেই। এরকম সময়ে ব্যাগ রেখে একটা চেয়ার আটকে রাখা অভদ্রতাই বটে। "জ্বি বসুন" বলে ব্যাগটা সরাতে সরাতে আমি অনেকটা ঝটকা মেরে ছেলেটার দিকে ফিরে তাকালাম।
বগলে একটা বই। কাঁধে ব্যাগ। লম্বা, শ্যামলা-ছিপছিপে শরীর। মুখে হালকা দাড়ি-গোঁফ। একহাতে চায়ের কাপ অন্যহাতে একটা ফান্টার বোতল।
২. "ধন্যবাদ!" তারপর হাতের সমুদয় সম্পত্তি টেবিলে রেখে বসলো। বইটার নাম চারুমতি। কাপটা হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকাতেই হেসে ফেললাম। "চা-ফান্টা কেউ একসাথে খায় নাকি?" না, বলতে পারলাম না। তার আগেই সে বলে উঠলো, "ভালো আছেন?" খানিক থতমত খেয়ে "জ্বি ভালো" বলতে বলতে তাকে চিনে ফেললাম।
"আপনার সাথে বোধহয় আগে একবার সাক্ষাত হয়েছে– চা-ফান্টা একসাথে খাচ্ছি.." সে হেসে মাথা নাড়লো। "এখানে কী করে?" "এখানেই তো পড়ি।" জবাব দিলাম আমি। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে সোৎসাহে জিজ্ঞেস করল ছেলেটা, "তাই নাকি? কোন ডিপার্টেমেন্ট?" "সাইকোলজি। ফার্স্ট ইয়ার।" "আমি বাংলা। প্রথম বর্ষেই।" এভাবেই আলাপ হলো।
৩. সাদাফ বই পড়তে ভালোবাসে। আমিও।
আমি চা খাই প্রচুর। সেও।
সে সহজ কথার মানুষ। আমার যেমন পছন্দ।
তার রবি ঠাকুর প্রিয়। আমার শরৎচন্দ্র।
আমি ঘুরতে ভালোবাসি। সেও ভ্রমণ প্রিয়।
দু'জনেই সাইকেল চালাতে ভালোবাসি।
আমরা দু'জনেই বাইরে শান্ত খুব। ভেতরে প্রচন্ড ঝড়।
তারপর রোজই দেখা হয়। লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, হলিডে রাইড, ট্যুর, মাঠে-ঘাটে, আড্ডায়।
আমাদের বিশেষ কোন বন্ধুত্বও যেন নেই। ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা দূরে থাক দরকার ছাড়া অতো মেসেজও নয়। তবু কোথায় যেন একটা টান। আমরা দু'জনেই টের পেতাম। আবার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতাম সাথে সাথেই।
মাঝে মাঝে একা সময় কাটানোর সুযোগ হতো আমাদের। সেদিনটা খুব কেমন যেন হতো। সাদাফ ভীষণ হাসতো। ওর চোখদু'টো আনন্দে চকচক করতো। অনেক কথা বলতো- ছোট ছোট স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, দৈনিকের নানা ঘটনা। আমিও বলতাম। সেদিন শহরময় নিশ্চিন্তে পাশাপাশি হেঁটে বেড়াতাম। রাস্তার পাশে ফ্রাইড রাইস খেতাম। গাছের নিচে অপরিচিত'র মতো চুপচাপ বসে থাকতাম একসাথে।
শ'কাপ চা-কফি খেতাম। বুক ক্যাফেতে মুখোমুখি বসে বইয়ের ভাঁজে হাত রেখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কখন যে ঘন্টা পেরিয়ে যেত। অথচ ভাবটা এমন যে সামনে বসে আছো তাই খানিক তাকিয়েছি। এখনই বইটা পড়তে শুরু করব! ফেরার সময় কেবল দু'টি কথা- "চলি। সাবধানে যেও।" "হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমিও।"
৪. এমনি করে দিন পেরিয়ে একদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলো শেষ হয়ে গেলো। সমাবর্তনের দিন ফ্যাকাশে মুখ করে সাদাফ আমাকে বলল, "ভালো থেকো। আমাকে মনে রেখো।" আমার মতো ওর গলায়ও কি একটা মার্বেল আটকে ছিল? ও কি চাইতো আমি কিছু বলি? বলেই দেখতে পারতাম একবার। কিন্তু পারিনি। শুকনো গলায় মুচকি হেসে কেবল বলেছিলাম, "তুমিও।"
এরপর সবাই যে যার মতো ছিটকে পড়লাম। ফেসবুকে দেখি এ বিয়ে করছে। ওর নতুন চাকরী। তার প্রমোশন। কিন্তু সাদাফের সাথে আমার কোন খোঁজখবরই থাকলো না। সেই পরিচয়ের সময় একদিনই কেমন আছি জিজ্ঞেস করেছিল সাদাফ। ভার্সিটি পার করে প্রায় সাড়ে তিনবছর পর একদিন সকালবেলা সে আমায় কল দিলো!
৫. আমি অফিসে অলস বসে ফাইলের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। গত তিনবছর ধরে মনের মধ্যে কী হচ্ছে আমি নিজেও জানি না। আর কাউকে তেমন নয়, যতটা ওকে আমার মনে পরে। আহা দীর্ঘশ্বাস! এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সাদাফের নাম সাথে তার হাস্সোজ্বল ছবি। সাদাফের কল পেয়ে অনেক চমকে গেছিলাম।
অবিশ্বাসের সাথে ফোন তুলে হ্যালো বলতেই কোন ভদ্রতার ধার না ঘেঁষে সাদাফ তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো, "তিরা, আমি সাদাফ। আমাকে বিয়ে করবে? একা একা চা-ফান্টা খেতে আর ভালো লাগেনা!" "আমি-" "আমি জানি তুমি বিয়ে করনি।"
"............"
"আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। সেই অনেকদিন থেকে–"
তারপরে আবার দেখা হলো। এবার আর কোন ফাঁক নেই। পরস্পরের প্রতি অনুভূতিটার এখন একটা নাম আছে। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমাদের সেই 'একলা থাকার সময়গুলোর' মতো পুরোটা দিন কাটালাম। এবার ওর হাতের মুঠোয় হাত রেখে। আমাদের চোখে বোনা স্বপ্নের জালটা মিলিয়ে দিয়েছি। এখন আর কোন অতৃপ্তি নেই।
৬. আমি আর সাদাফ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে বসে আছি। টেবিলের দু'প্রান্তে দু'জন মুখোমুখি। টেবিলে একটা প্লেটে দু'টো সিঙ্গারা, একটা চায়ের কাপ আর এক বোতল ফান্টা। তার পাশে শুয়ে আমাদের দেখছে একটা টুকটুকে লাল গোলাপ।
হঠাৎ দিপু অনেকটা চিৎকার করে সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলল,"দাদু, তোমাদের এই ছবিটাও বড় করে বাঁধাই করে আনতে বলব বাবাকে!" আমাদের একসাথে আরেকটা চমৎকার বছর চলে গেল। আজ আমাদের ৬৩ বছর বয়স। ৩৭ তম অ্যানিভার্সারি।