নেলসন ম্যান্ডেলাঃ যিনি জীবন্ত কিংবদন্তীর রাষ্ট্রনায়ক
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় রাষ্ট্রনায়কদের একজন ছিলেন যিনি। যিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বহু বর্ণ ভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আজ এমনই একজন মানুষ সম্পর্কে বলবো আপনাদের।

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, প্রখর রসবোধ, তিক্ততা ভুলে বৈরি প্রতিপক্ষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মত উদারতা এবং তাঁর বর্ণাঢ্য ও নাটকীয় জীবন কাহিনী তার। এসব মিলিয়ে যিনি ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী। তিনি হলেন কিংবদন্তীর রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা।
বর্ণবাদের অবসানের পর ১৯৯৪ সালের ১০ই মে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এর মাত্র এক দশক আগেও সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকায় এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ছিল এক অকল্পনীয় ঘটনা।
এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও তিনি ভূমিকা রাখেন।
এই কিংবদন্তীর রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার এম্ভেজে গ্রামে। ম্যান্ডেলার বাবার নাম গাডলা হেনরি এমফাকানিসিওয়া। তিনি ছিলেন থেম্বু গোত্রের প্রধান। এই গোত্র খোসা ভাষায় কথা বলে। ম্যান্ডেলার মা নোসেকেনি ফ্যানি ছিলেন তাঁর স্বামীর তৃতীয় স্ত্রী। তখন ম্যান্ডেলাকে সবাই চিনতেন তাঁর গোত্র নামেই, রোহিলালা।
পিতৃবিয়োগের পর, জঙ্গিনাতাবা ডালিন্ডিয়েবো নামে উচ্চপদস্থ থেম্বু রিজেন্ট দত্তক নেন ম্যান্ডেলাকে। উদ্দেশ্য, থেম্বু ট্রাইবের পরের নেতা হিসেবে ম্যান্ডেলাকে গড়ে পিঠে নেওয়া।
নেলসন ম্যান্ডেলার পরিবারে তিনিই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করেন। ম্যান্ডেলা প্রাইমারি স্কুল শেষ করেন আঞ্চলিক এক কনভেন্ট থেকে।
সেখানে একজন শিক্ষক তাঁকে নেলসন নাম দেন। তখন আফ্রিকার ছাত্রদের ইংলিশ নাম দেবার একটা চল ছিল। ম্যান্ডেলা মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য মেথডিস্ট প্রতিষ্ঠান, ক্লার্কবারি বোর্ডিং আর হিল্ডটাউনে কাটান।
নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৩৯ সালে ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানেই দেখা হয় বন্ধু এবং ভবিষ্যতের বাণিজ্য সহযোগী অলিভার টেম্বোর সঙ্গে। দুজনকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ভঙ্গের অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় ।
পরে আইনের পড়াশোনা শেষ করে আইনজীবী হিসেবে জীবন শুরু করেন। এরই মধ্যে আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৪৩ সালে যোগ দেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে।
নেলসন ম্যান্ডেলা ধীরে ধীরে এএনসি (আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস)এর সাথে শক্তভাবে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৪ সালে ইয়ুথ লীগ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬২ সালে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেফতার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ড দেয়। দীর্ঘ ২৭ বছর কুখ্যাত রবেন দ্বীপের কারাগারে বন্দি থাকতে হয় ম্যান্ডেলাকে। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্ত হন ম্যান্ডেলা।
কারাগার থেকে বের হয়ে নিজ দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। ম্যান্ডেলা এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারবে। পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকাকে পেছনে ফেলে নতুন আফ্রিকা গড়ার কাজটা সহজ ছিল না।
কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা অতীতের তিক্ততার প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে তার সাবেক কৃষ্ণাঙ্গ নিপীড়কদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন। শুরু হলো এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার পথ চলা। এর ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের অবসান ঘটে। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি হন তিনি। ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন । তার আগে ১৯৯৩ সালে এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান তিনি।
তার অসীম সাহস, দক্ষ নেতৃত্ব ও নিঃস্বার্থ নীতির জন্য সারা বিশ্বের মানুষ তার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। শান্তির স্বপক্ষে কাজ করা এবং আফ্রিকার নবজাগরণে ভূমিকা রাখার জন্য গত চার দশকে তিনি ২৫০টিরও অধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট সদস্যদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে বিশ্ববরেণ্য এই মহান নেতাকে মর্যাদাপূর্ণ কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়।
অবসরে যাওয়ার পরও নেলসন ম্যান্ডেলার ব্যস্ততা থামেনি। স্বাধীনতা এবং বিশ্ব শান্তির এক আইকন বা প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তিনি, সুতরাং তাঁর ডাক পড়তে থাকে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে।
তাঁর এক ছেলে মারা গিয়েছিলেন এইডসে। এ ঘটনার পর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডস প্রতিরোধ এবং এর চিকিৎসা নিয়ে সোচ্চার হন।
বাকী জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি দারিদ্র দূরীকরণ এবং এইডস নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রচারণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
নেলসন ম্যান্ডেলাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাকে কিভাবে মনে রাখলে খুশী হবেন তিনি?
তাঁর উত্তর ছিল, “আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। আমি চাই এটুকুই বলা হোক আমার সম্পর্কে।”
২০১৩ সালের ৮ জুন তিনি ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তী ছয় সপ্তাহ তিনি হাসপাতালেই কাটান।
২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ম্যান্ডেলাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর নিজের বাড়িতে শান্তিপূর্ণভাবেই চিরনিদ্রায় চলে যান এই কিংবদন্তী নেতা।
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা আজ এই পর্যন্তই! আবারও নতুন কোনো কিছু নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সবসময় শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।