নোবেল বিজয়ী নাদিয়া মুরাদ : যৌনদাসী থেকে আজ হাজারো মানুষের মুক্তির প্রতীক

আজ এমন এক নারীর সম্পর্কে বলবো যে হাজারো মানুষের মুক্তির প্রতীক। চলুন জেনে আসি তার সাথে ঘটে যাওয়া বর্বরতার ইতিহাস। যা আপনাকে চমকে দিবে। তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকুন।

নোবেল বিজয়ী নাদিয়া মুরাদ : যৌনদাসী থেকে আজ হাজারো মানুষের মুক্তির প্রতীক
ফটো গ্রহণ করা হয়েছে sahityabarta.com থেকে

নাদিয়া মুরাদ, একজন বিশ্বনন্দিত নোবেলজয়ী নারীর নাম। নোবেল জয় করে গোটা বিশ্বকে বিস্মিত করেছেন ইরাকের এই ইয়াজিদি মানবাধিকারকর্মী।


বাস্তবতার কঠিন নির্যাতনের জাল থেকে বেরিয়ে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এ পুরস্কারটি অর্জন করলেন তিনি, তা নিয়ে অবাক পুরো বিশ্ব।


নাদিয়া মুরাদ ইরাকের সিনযার এর কোযো গ্রামের জাতিগত ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইয়াজিদি কৃষক পরিবারে ১৯৯৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন।


১৯ বছর বয়সে নাদিয়া মুরাদ একজন ছাত্রী ছিলেন। যখন ইসলামিক স্টেট যোদ্ধারা গ্রামের ইয়াজিদী সম্প্রদায়ের ৬০০ জনকে হত্যা করেছিল নাদিয়ার ছয় ভাই ও সৎ ভাই সহ এবং কমবয়সী মেয়েদের দাসী হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যায়।


সেই বছর, ইরাকের ইসলামিক স্টেটের কারাগারে ৬,৭০০ বন্দী ইয়াজিদি নারীর মধ্যে মুরাদ ছিলেন একজন।


ইরাকের সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন পৃথিবী নির্মমতম জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের অর্থাৎ আইএস এর বর্বরতা। শিকার হয়েছেন অবর্ণনীয় নির্যাতনের। পার করেছেন ইতিহাসের নিকৃষ্টতম কিছু সময়।


২৫ বছর বয়সে নোবেল পাওয়া এই ইরাকি নারীর পথটি মোটেও সহজ ছিল না। সত্যি বলতে আমরা যারা সামান্য ধাক্কায় ছিটকে গিয়ে আর কখনো ঘুরে দাড়াই না, সেই সকল নারীদের অনুপ্রেরণা এই নাদিয়া মুরাদ।


আইএস জঙ্গিরা পুরুষদের হত্যা করে, শিশুদের জঙ্গি বানানোর উদ্দেশ্য বন্দী করে এবং নারীদের জোরপূর্বক শ্রম ও যৌনদাসী হতে বাধ্য করে। আইএসের একটি পক্ষের কাছে যৌনদাসী হিসেবে মুরাদকে বিক্রি করে দেয় আরেকটি পক্ষ।


এরপর সিরিয়ান, ইরাকি, তিউনিসিয়ান ও ইউরোপিয়ান আইএস জঙ্গিদের নিষ্ঠুর লালসার শিকার হতে হয় তাকে। যন্ত্রণায় কেটেছে তার প্রতিটি মুহূর্ত।


২০১৫ সালে তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে তুলে ধরেছিলেন নিজের এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। আইএসের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় তার তিন মাসের মাসের অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ংকরের চেয়েও বেশি কিছু।


আইএস তাকে স্বঘোষিত খেলাফতের রাজধানী মসুলে নিয়ে যায়। সেখানে তিনটি মাস তিনি বারবার গণধর্ষিত, নির্যাতিত এবং প্রহৃত হন।


জাতিসংঘে তিনি বলেছিলেন, "আমাদের যখন বন্দি করা হলো, তখন ওদের যৌন নির্যাতনের বিষয়ে শোনা কথাগুলো স্মরণ করে মনে-প্রাণে চাইছিলাম যে, এমন পাশবিক লালসার শিকার হওয়ার আগে যেনো আমাদের মেরে ফেলা হয়"।


কিন্তু, ওরা আমাদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দিলো তাদেরই আরেকটি পক্ষের কাছে। এরপর কী যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে! প্রতিটা মুহূর্তে মনে হয়েছে, "আমাদের মেরে ফেলা হয় না কেনো, কেনো আমাদের এভাবে তিলে তিলে নির্যাতন করা হচ্ছে?"


নাদিয়া সেই বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, "তিন হাজারেরও বেশি নারী আইএসের হাতে যৌনদাসী হিসেবে বন্দি রয়েছে। আইএস এই হতভাগ্যদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে! ইচ্ছেমতো জায়গায় বিক্রি করছে নারীদের"।


সহিংসতায় হতভম্ব, মুরাদ পালানোর জন্য চেষ্টা শুরু করেন এবং মসুল থেকে একটি মুসলিম পরিবারের সহায়তায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। তিন মাস পর নভেম্বর মাসে অনেক কষ্ট সংগ্রাম এবং কৌশল করে পালিয়ে আসেন তিনি।


এসময় তিনি মিথ্যা পরিচয়পত্র নিয়ে ক্যাম্পের অন্যান্য বিচ্ছিন্ন ইয়াজিদিদের সাথে মিশে গিয়ে ইরাকি কুর্দিস্তানের দীর্ঘপথ অতিক্রম করেন। এখানেই তিনি জানতে পারেন যে, তার মা সহ ছয় ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে।


পালিয়ে এসেই তিনি ক্ষ্যান্ত হননি। বরং যোগ দেন আইএসের হাতে বন্দি ইয়াজিদি নারীদের মুক্তির সংগ্রামে। রুখে দাঁড়ান নারী পাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পরিণত হন ইয়াজিদিদের মুক্তির প্রতীকে।


জিহাদি জঙ্গিরা নারী ও বন্দীদের দাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য ক্রীতদাস বাজার গড়ে তুলেছিল এবং একই সাথে ইয়াজিদি নারীদের ধর্ম ত্যাগ করার জন্য বাধ্য করেছিল।


উল্লেখ্য, জিহাদিদের তথাকথিত পৌত্তলিক ইসলামিক ধ্যান ধারণায় ইয়াজিদিদের কাফির বলে গণ্য করা হয়। কুর্দি ভাষাভাষী এই সম্প্রদায়টি একটি প্রাচীন ধর্মকে অনুসরণ করে এবং একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করে যা তারা একটি প্রতীকী ময়ূরের মাধ্যমে উপস্থাপন করে থাকে।


যৌন নিপীড়িত-নির্যাতিত এই নাদিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে কাজ শুরু করেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়সহ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের শরণার্থীদের আইনজীবী হিসেবে।


মানবাধিকার আদায়ে এই ভূমিকার জন্য তাকে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে সম্মানজনক শাখারভ পুরস্কারেও ভূষিত করা হয়।


পরে ইয়াজিদিদের মিত্র একটি সংগঠনের মাধ্যমে তিনি জার্মানিতে তার বোনের কাছের চলে যান। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।


তারপর থেকেই তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। এরপর থেকেই তিনি তার সাথে ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং অত্যাচারিত গণমানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তার যুদ্ধ শুরু করেন। এখনও তিনি নিখোঁজ ও নির্যাতিত ইয়াজিদিদের জন্য তার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।


এছাড়া ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধেও তিনি কঠিন ভূমিকা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। যা তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করলো।


৫ অক্টোবর ওসলোতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দু’জনের নাম ঘোষণা করে নরওয়েজিয়ান কমিটি। তার একজন হলেন নাদিয়া মুরাদ।


কি বিস্মিত হননি এই ইরাকি নারীর ভয়ংকর নির্যাতনের বর্ণনা শুনে? এই সকল মানুষগুলোই আমাদের প্রেরণা। যারা আমাদের শেখায় যুদ্ধ যত কঠিনই হোক না কেন, লড়াই করতে হবে শেষ পর্যন্ত!


প্রিয় পাঠক বন্ধুরা আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে।  সেই পর্যন্ত আপনাদের মঙ্গল কামনায় আজ এখানেই বিদায় নিচ্ছি। ধন্যবাদ সবাইকে।


আরও পড়ুনঃ মেহেদী হাসান খানঃ বাংলা অভ্র কী বোর্ড এর জনক সম্পর্কে জানুন