পঞ্চপান্ডব পরিচিতিঃ জানুন বাংলা সাহিত্যের পাঁচ খ্যাতিমান লেখক সম্পর্কে

বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হয়ে স্বাধীনচেতা লেখনীর মাধ্যমে শুরু হয় কল্লোল যুগের। এই যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পাঁচ জন প্রথিতযশা লেখক কবি যারা পঞ্চপান্ডব হিসেবে খ্যা।

পঞ্চপান্ডব পরিচিতিঃ জানুন বাংলা সাহিত্যের পাঁচ খ্যাতিমান লেখক সম্পর্কে
জানুন বাংলা সাহিত্যের পাঁচ খ্যাতিমান লেখক সম্পর্কে


বিগত শতাব্দী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রযুগ হিসেবে খ্যাত। তবে তিরিশের দশকে এমন কিছু কবি তাদের লেখনীর মাধ্যমে মানুষের মনে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যারা ছিলেন রবীন্দ্র প্রভাব বর্জিত। বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডব বলতে মূলত এমনই পাঁচজন কবিকে বোঝানো হয়ে থাকে যারা রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হয়ে সাহিত্য অঙ্গনে নিজেদের ভিন্ন ধারার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।


এনাদের মধ্যে রয়েছেন কবি অমিয় চক্রবর্তী,বুদ্ধদেব বসু,জীবনানন্দ দাশ,বিষ্ণু দেএবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। বিশ্বকবির ছত্রছায়ায় থেকে মুক্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার উন্মোচক হিসেবে পঞ্চপান্ডব জনসমাদৃত। বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য ভিন্নধর্মী এই পাঁচ জন কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও কর্মজীবন নিয়ে সাজিয়েছি আজকের আয়োজন। 


অমিয় চক্রবর্তী

পঞ্চপান্ডব এর মধ্যকার যে কবি বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছন তিনি কবি অমিয় চক্রবর্তী। কবি ১৯০১ সালের ১০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে তার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মারা যান ১২ জুন ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে। অমিয় চক্রবর্তী ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেন।


পরবর্তী জীবনে তিনি হার্ভার্ড, বেষ্টন কলেজের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান অধ্যাপনা করেছিলেন। এ সময় তিনি জর্জ বার্নার্ড শ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মতো ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসেন। ছোটবেলা থেকেই অমিয় চক্রবর্তীর সুদৃঢ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে পত্রযোগে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তার জীবনের একটি দীর্ঘ সময় তিনি শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন।


১৯২৬ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব। এসময় শান্তিনিকেতনে আগত দেশ বরন্য বিভিন্ন কবিদের অভ্যর্থনা শহর রবীন্দ্রনাথের সাথে বিশ্বভ্রমণে তিনি যেতেন। তবে একথা সত্য যে অমিয় চক্রবর্তীর প্রথম দিককার কবিতাবলী রবীন্দ্র প্রভাব লক্ষণীয় ছিল।


তার প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ 'কবিতাবলী' এবং 'উপহারে' রবীন্দ্র প্রভাব থাকলেও ১৯৩৮ সালে তিনি প্রকাশ করেন তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'খসড়া'। যার সাহায্যে তিনি অচিরেই জীবনানন্দ দাশ বিষ্ণুদেব প্রভৃতি কবিদের সাথে একযোগে স্থান করে নেন। তার কবিতায় গভীর আবেগ, মননশীলতার, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ সচেতনতা ইত্যাদি প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। 


আরও পড়ুনঃ ভারতের কয়েকটি রহস্যময় গ্রাম যা আপনি বিশ্বাস করবেন না


বুদ্ধদেব বসু

রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে যে কয়েকজন কবি রবীন্দ্র প্রভাবিত হয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু অন্যতম। সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা যেমন কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ ভ্রমণ কাহিনী সমালোচনা ইত্যাদি সহ তিনি ছিলেন একজন সফল সম্পাদক এবং নাট্যকার।


কথা সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ মারা যান। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই লেখক অবিভক্ত ভারতবর্ষের কুমিল্লা তে জন্মগ্রহণ করেন যদিও তিনি ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি' 'মায়া' 'মর্মবাণী' 'সাড়া' 'অভিনয়' 'অভিনয় নয়" ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলী।


জীবনানন্দ দাশ

বিগত শতাব্দীর বিষ এবং ত্রিশের দশকে আধুনিক বাংলা কবিতার চেয়ে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল জীবনানন্দ দাশ তার অন্যতম নেতৃত্বদানকারী কবি। রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ-ভারতের বরিশাল অঞ্চলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।


বাংলা সাহিত্যের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পাস করেন এবং পরবর্তীতে অধ্যাপনাকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেন। তার জন্ম শতবার্ষিকী পালনের সময় জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান কারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ এর মধ্যে রয়েছে 'সাতটি তারার তিমির' 'বনলতা সেন' এবং 'রুপশি বাংলা'।


যদিও প্রথম দিকে তাঁর রচনায় নজরুল ইসলামের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল কিন্তু অতিসত্বর তিনি তা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের স্বতন্ত্র ধারা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার কবি হিসেবে সমাদৃত। আধুনিক ধারার এই কবি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ট্রাম দুর্ঘটনায় নিহত হন। 


আরও পড়ুনঃ এই ৪ টি রহস্যের দরজা যা কখনোই খোলা উচিত নয়


বিষ্ণু দে

রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হয়ে আধুনিক কাব্যধারা প্রতিষ্ঠার জন্য যে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল বিষ্ণু দে ছিল তার অন্যতম অনুসারী। তিনি ১৯০৯ সালের ১৮ জুলাইজন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮২ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।


দেশবিভাগের সময় তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করছেন এবং পরবর্তীতে মাওলানা আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। ব্যতিক্রমী এই লেখক ১৯৭১ সালে তাঁর স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ এর জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার শহর নেহেরু সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছিলেন।


খ্যাতিমান এই কোভিদ লেখনীতে মানুষ এবং তাদের সমকালীন রাজনীতি উঠে এসেছে। বামপন্থী আদর্শে উজ্জীবিত এই লেখককে রচনায় দুইটি বিশ্বযুদ্ধ সহ তেভাগা আন্দোলনের মতো বিভিন্ন আন্দোলনের স্পষ্টত প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। 


সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

বাংলা সাহিত্যের পঞ্চপান্ডরের শেষ পান্ডব হিসেবে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন। তিনি তৎকালীন আধুনিক বাংলা কাব্য আন্দোলন তথা কল্লোল যুগের এক অন্যতম লেখক । তিনি ১৯০১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন এবং১৯৬০ সালের ২৫ জুন মৃত্যুবরণ করেন।


তার উল্লেখযোগ্য কিছু সাহিত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে উত্তর ফাল্গুনী, দশমী, প্রতিদিন। বাংলা সাহিত্যে তিনি ধ্রুপদী রীতি প্রণয়নের জন্য বিখ্যাত।