পম্পেই নগরী ধ্বংসপ্রাপ্ত ইতিহাসের সাক্ষী
ইতালির নেপল উপসাগরের উপত্যকায় গড়ে ওঠা পম্পেই নগরী এক সময় ছিল ঐতিহ্য অার সৌন্দর্যের প্রতীক। কিন্তু হঠাৎ করেই কালের অতলে হারিয়ে যায় এই শহর।সেসব নিয়েই অাজকের লেখা।

ইতালির এক ছোট শহর,এর নাম পম্পেই। পম্পেই নগরী যা ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে ধ্বংস হয়ে গিয়ে ছিল। ভাবতেই অবাক লাগে। একটি নগরী ধ্বংস হয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে!চোখের পলক ফেলারও সুযোগ পায়নি একটি মানুষ ও।
জীবন্ত মোমিতে পরিণত হয় অনাচার আর পাপাচারের প্রতীক মানুষগুলো। আজকে আপনাদের জানাব পম্পেই শহরের কথা। আশা করি ভালো লাগবে আপনাদের।
ইতালির নেপল উপসাগরের উপত্যকায় অবস্থিত ছিল এই পম্পেই নগরী। এই শহরের গোড়াপত্তন হয় প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৬-৭ শতাব্দীর দিকে মধ্য ইতালির তৎকালীন রাজা ওসকানের দ্বারা। ভেজিভিয়াস পাহাড়ের পাদদেশে নেপল উপসাগরের উপত্যকায় শহরটি গড়ে ওঠে।
শহরের একপাশে হারুকুলেনিয়াম শহর এবং অন্য পাশে স্ট্যাবি শহর অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিপুল সমাহার ছিল এই শহরে। গ্রিক বাণিজ্যিকরা সে সময় পম্পেই শহরকে ব্যবহার করতো বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবে।
ইউরোপের বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধের মাধ্যমে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০ এর দিকে এই শহরটি রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারা অধিকৃত হয় এবং সেখানে গড়ে ওঠে রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম বাণিজ্য বন্দর। বাণিজ্যিক টুরিস্টদের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছিল অত্যাধুনিক দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা প্রাসাদ,বাজার ইত্যাদি।
অভাব অনটন বলতে কিছু ছিল না পম্পেইবাসীর। শহরটি ধীরে ধীরে প্রাচীনকালের আধুনিক সভ্যতার সকল ধরনের চিত্তরঞ্জনের জন্য প্রাণবন্ত একটি শহরে পরিণত হয়। তৎকালীন অভিজাত মানুষগুলোর আমোদপ্রমোদের কেন্দ্রস্থল ছিল এই নগরী।
রোমের সব সম্পদশালী মানুষের অবসর কাটানোর শহর ছিল এই পম্পেই। কিন্তু প্রকৃতির এত সম্পদ পাওয়ার পরও ধীরে ধীরে প্রকৃতির নিদর্শনকে অস্বীকার করে পাপাচারে লিপ্ত হতে থাকে পম্পেইবাসী।
'গ্লাডিটোরিয়ার কমব্যাট' নামক একটি খেলা এবং নৈতিক অবক্ষয়ে দিনের পর দিন অভ্যস্ত হতে থাকে পম্পেইবাসী। গ্লাডিটোরিয়াল কমব্যাট হচ্ছে কোন স্টেডিয়ামের মাঠে কিছু পুরুষ মানুষের আমৃত্যু এক ধরনের সশস্ত্র যুদ্ধ যা স্টেডিয়ামের দর্শকদের বিনোদনের জন্য পরিচালিত হতো।
যোদ্ধারা যুদ্ধ করতো যতক্ষণ না একজন যোদ্ধার দ্বারা অপর যোদ্ধার রক্তাক্ত মৃত্যু না হয়। আর এই মৃত্যুকে উপভোগ করতো সে সময়ের রোমান এলিট শ্রেণীর দর্শকরা।
ধীরে ধীরে খ্রিষ্টান ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে থাকে তারা। সকল ধর্মযাজক নগরী ছেড়ে চলে যায়। ধর্মীয় মানসিকতায় সামাজিক বা ধর্মীয় কনফ্রন্টেশন বা ব্যকল্যাশের ভয়ে ইউরোপের কনজারভেটিভ ধর্মীয় সম্প্রদায় সাধারণত পম্পেই শহর পরিভ্রমণে বিরত থাকতো।
খ্রিস্টাব্দ ৭৯ সালের ২৪ আগস্ট দুপুরবেলা ইতালির পম্পেই শহরের অধিবাসীরা কেউ কেউ বিশ্রামে ব্যস্ত ছিল কেউ কেউ আনন্দ উদ্দীপনায় নিজেদের মত্ত রেখেছিল। ঠিক সেই সময় হঠাৎ শহরের অধিবাসীদের ওপর প্রকৃতির নির্মম দুর্যোগ নেমে আসে। শহরের পাশে অবস্থিত ভিসুভিয়াস পর্বতে কোন প্রকার পূর্ব সঙ্কেত ছাড়াই এক বিরাট ক্যাটাস্ট্রোফিক অগ্নুৎপাত ঘটে ঐ সময়।
সাধারণত কোন অঞ্চলে অগ্নুৎপাত হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ঐ অঞ্চলের পশুপাখির আচরণের মধ্যে একধরনের পূর্বসঙ্কেত লক্ষ্য করা যায়। পম্পেই শহরের বেলায় তার কিছুই পাওয়া যায় নি বলে ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন।
ফলে পম্পেই শহরসহ শহরের ২০ হাজার অধিবাসী দিনে দুপুরে মাত্র অল্প কয়েকঘন্টার মধ্যে প্রায় ২০ ফুট আগ্নেয় লাভা ছাইভস্মের নিচে বিলীন হয়ে যায়। তারপর থেকে প্রকৃতির অভিশপ্ত এবং পাপিষ্ঠ শহর হিসেবে এই শহর প্রায় ১৭০০ বছর ধরে আধুনিক মানবসভ্যতার অগোচরে থেকে যায়, কেউ কখনও সেখানে ভুল করেও প্রবেশ করেনি।
কিছু অ্যামেচার আর্কিওলজিস্ট অলৌকিকভাবে খ্রিষ্টাব্দ ১৭৪৯ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া পম্পেই। তারপর থেকে সেখানে উৎসাহী মানুষের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে। ইতিমধ্যে প্রায় দুই হাজার বছর সময়ে শহরটি কয়েকহাজার ফুট মাটির নিচে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এখনও সেই মাটিআর ছাইভস্মের নিচ থেকে প্রাণীসহ মানুষের মৃতদেহ অবিকল ফ্রোজেন অবস্থায় সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে।
মৃত্যুর সময় যে যেভাবে অবস্থান করছিল তাকে সেভাবেই পাওয়া যাচ্ছে। যেমন কাউকে পাওয়া গেছে বাড়ির মধ্যে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় পরিবারের সকল সদস্যকে সমবেত অবস্থায়। বাড়ির কুকুরটার মৃতদেহ উঠানে যেভাবে থাকার কথা সেভাবেই আছে।
এই অগ্নুৎপাতের ঠিক ১৭ বছর আগে ৬২ খ্রিস্টাব্দে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল যা কাম্পানিয়া অঞ্চলের পম্পেই,হেরকুলেনিয়াম,আপ্লেন্টেস এবং আশেপাশের শহরে আঘাত করেছিল। এটি ছিল আসলে প্রাকৃতিক সতর্কবার্তা,তখন কেউ বুঝতে পারেনি তাদের শহরের পাশেই দাড়িয়ে আছে তাদেন ধ্বংসের উৎস। তবে ওই ভূমিকম্পে পম্পেই নগরীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
কিন্তু সেই সাথে শহরের পূর্ণনির্মানের কাজ শুরু হয়েছিল। সেই পূর্ণনির্মানের কাজ ১৭ বছর পর যখন প্রায় শেষ তখন শহরের বাসিন্দারা ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনার শিকার হয় এবং ঐ শহরের সময়কে চিরদিনের জন্য স্থির করে দেয়।
পম্পেই এই ঘটনার পর প্রাণীও মানুষের মৃতদেহ দিয়ে ইতালির সরকার নতুন করে তাদের ঐতিহাসিক জাদুঘর সাজাচ্ছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। এখন এই স্থানে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন ট্যুরিস্ট ভ্রমণ করেন।
মহান রবের শাস্তির ভয়াবহতা সম্পর্কে জানা যায় এই পম্পেইবাসীর ওপর আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে। জীবন্ত কবর দিয়ে দিলেন পুরো শহরকে আর রেখে দিলেন নিদর্শন যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য।