প্যানিক ডিজঅর্ডার: পৃথিবীর অন্যতম জটিল মানসিক রোগ
আচ্ছা আপনি কি অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যান? আপনার কি তখন শ্বাস প্রশ্বাস খুব বেশি উঠা নামা করে? বুকে ব্যথা হয়? চলুন জেনে আসি এগুলো হার্টঅ্যাটাক নাকি প্যানিক ডিজঅর্ডারের জন্য হচ্ছে। জানতে হলে শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকুন।

প্যানিক ডিজঅর্ডার শরীরের কোনো রোগ বা সমস্যা নয়। এটি একটি মানসিক রোগ। দেখা যায়, রোগীরা সমস্যা নিয়ে বারবার বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন-ইসিজি, ইকো থেকে শুরু করে হার্টের এনজিওগ্রাম পর্যন্ত অনেকের করা হয়ে যায়।
বিভিন্ন রকমের রক্ত পরীক্ষা তো আছেই। সে সঙ্গে অনেক সময় রোগী নিজেও বিভিন্ন রকম পরীক্ষা করিয়ে নেন নিজের সমস্যাটি আবিষ্কারের জন্য।
কোনো পরীক্ষাতেই কোনো কিছু ধরা না পড়াতে অনেকে ভাবেন- ডাক্তার মনে হয় ঠিক মতো রোগটি ধরতে পারছেন না।
কিংবা পরীক্ষাগুলোর রেজাল্ট হয়তো ঠিক মতো আসছে না। অনেক ডাক্তারও রোগীকে বলে দেন, ‘আপনার কোনো রোগ নেই’।
আর এতে রোগী বা রোগীর আত্মীয়-স্বজন আরো বেশি দ্বিধার মধ্যে পড়ে যান। ভাবেন- তাহলে এমন সমস্যা হচ্ছে কেন? এমনকী অনেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পর্যন্ত চলে যান।
এটি একটি মানসিক রোগ, এ বিষয়টি বুঝতে অনেক সময় খুব দেরি হয়ে যায়। অনেকে বারবার ব্যাখ্যার পরও মানসিক রোগ হিসেবে মেনে নিতে চান না। কিংবা মানসিক ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে কুণ্ঠা বোধ করেন।
মূলত প্যানিক ডিজঅর্ডার সঠিক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়। এটি যে কোনো বয়সেই হতে পারে। তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রকাশভঙ্গিটা বুঝতে অনেক সময় দেরি হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো প্যানিক ডিজঅর্ডার কি?
প্যানিক ডিজঅর্ডার স্ট্রেসের সময় সাধারণ ভয় ও অ্যাংজাইটি রিয়েকশনের চেয়ে ভিন্ন। প্যানিক ডিজঅর্ডার একটি সিরিয়াস কন্ডিশন যা কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা সংকেত ছাড়াই হয়।
প্যানিক অ্যাটাকের সময় ঘটনা হুমকিস্বরূপ না হলেও ভয়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সময়ের ধারাবাহিকতায় প্যানিক অ্যাটাক দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ডিপ্রেশন, ড্রাগ অ্যাবিউজ ও অ্যালকোহলিজমে জড়িয়ে পড়ে।
প্যানিক অ্যাটাক হঠাৎই শুরু হয় এবং তা কমপক্ষে ১০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় থাকে।
প্যানিক ডিজঅর্ডারের কিছু লক্ষণ:
১. অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস
২. বুকে ব্যথা
৩. তীব্র আতঙ্ক
৪. মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘোরানো বা পড়ে যাচ্ছেন এমন অনুভূতি
৫. ঝাঁকুনি
৬. ঘাম
৭. পেটে ব্যথা ও বমিভাব
৮. উত্তাপ অনুভব করা
৯. নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা ও মারা যাবেন এমন অনুভূতি
প্যানিক ডিজঅর্ডার কেন হয়?
যদিও এর মূল কারণ এখনও জানা যায়নি তবে এতো বছরের গবেষণা বলে, প্যানিক ডিজঅর্ডার শরীরবৃত্তীয়, পরিবেশগত উভয় কারণের সংমিশ্রণ।
১. পরিবারে বাবা-মা কারও যদি প্যানিক ডিজঅর্ডার থেকে থাকে বা হৃদরোগ থেকে থাকে তাহলে সন্তানদেরও এটা হতে পারে। পরিবারে কারও এ রোগ থাকলে অন্যদের তুলনায় ৪-৮ গুণ বেশি হবার সম্ভাবনা থাকে।
২. মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ এলাকায় অস্বাভাবিকতা থাকলে। মস্তিষ্কের ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স এরিয়া নিয়ন্ত্রণকারী অংশে সমস্যা থাকলে প্যানিক ডিজঅর্ডার হতে পারে।
৩. জীবনে স্ট্রেসফুল কোনো মেজর ঘটনা থাকলে এটা হওয়া স্বাভাবিক।
৪. পাশাপাশি বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক নিয়ামক, যেমন- বৈবাহিক কিংবা দাম্পত্য জীবনে জটিলতা, কোনো বিষাদময় ঘটনা, আর্থিক সমস্যা, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বা গর্ভপাত, নেশাদ্রব্যের ক্রিয়া, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন প্রকার ফোবিয়া থেকে প্যানিক ডিজঅর্ডারের সূচনা ঘটতে পারে।
৫. এছাড়া হাইপারথাইরয়েডিজম, হাইপোগ্লাইসিমিয়া, মাইট্রাল ভালভ প্রলাপস ইত্যাদি রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্যানিক ডিজঅর্ডার হতে পারে।
আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া
প্যানিক অ্যাটাক যাদের হয় তারা পরবর্তী অ্যাটাক হতে পারে ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। যেসব কারণে ব্যক্তির এ অ্যাটাক হয় সেসব ঘটনা ও বস্তুকে এড়িয়ে চলতে চান, ভিড় এড়িয়ে চলেন এবং নিজেকে সবার চেয়ে আলাদা ও দূরত্বে রাখতে পছন্দ করেন। সবই হয় আশঙ্কা থেকে।
যখন কেউ প্যানিক অ্যাটাকে পড়েন তখন বিচ্ছিন্ন ভাবনা মস্তিষ্কে আসতে থাকে যার রেশ আত্মহনন পর্যন্ত যেতে পারে।
প্যানিক ডিজঅর্ডার কি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব? এর চিকিৎসা কি?
প্যানিক ডিজঅর্ডার রোগীর সাময়িকভাবে ভালোই উন্নতি হয়। এরপর তাদের যদি কাউন্সিলিং করা হয় বা কগনিটিভ বিহেইভিয়ার থেরাপি দেওয়া হয় এর ফলে যথেষ্ট উন্নতি করা সম্ভব এবং প্রায়ই রোগীরা ভালো হয়ে যায়।
প্যানিক ডিজঅর্ডারে সাইকোথেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি ও ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এছাড়াও শিথিলায়ন পদ্ধতিও রয়েছে।
প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণগুলো কমিয়ে আনতে প্রথমেই স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন;
১. অতিরিক্ত ক্যাফেইন প্রোডাক্ট যেমন কফি, চা, কোলা ও চকলেট খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
২. যেকোনো ওষুধ বা হারবাল প্রতিষেধক ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কারণ, অনেক ওষুধে অ্যাংজাইটি লক্ষণ উদ্রেককারী কেমিকেল থাকে।
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা এই ছিলো প্যানিক ডিসঅর্ডার সম্পর্কে তথ্য। আশা করি আপনারা জেনে উপকৃত হবেন।আজ এই পর্যন্তই।
আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। শুভ প্রভাত মানেই নতুন নতুন তথ্য। ধন্যবাদ।
আরও পড়ুনঃ সাইকোসিসঃ অত্যন্ত গুরুতর মানসিক সমস্যা সম্পর্কে জানুন