প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস: নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের নিয়ে জেন অস্টিনের মাস্টারপিস উপন্যাস
প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস জেন অস্টিনের ১৮১৩ সালে প্রকাশিত এমন একটি উপন্যাস যার প্রেক্ষাপট যুক্তরাজ্যের সেই সময়ের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জীবন ব্যবস্থা সংক্রান্ত নিয়ে লেখা। এবং এই উপন্যাস অবলম্বনে ২০০৫ সালে প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস নামে চলচ্চিত্রও মুক্তিপ্রাপ্ত হয়।

প্রথম দেখাতে হাসিখুশি চটপটে এলিজাবেথের কাছে মি. ডারসিকে একটা নাক উঁচু অভদ্র বড়লোক জমিদার ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। তার উপর ডারসি তাকে অপমান করেছে।
প্রথম দেখাতে তাদের সেই ঘৃণা, আত্মসম্মান, অহঙ্কার আর ভুল ধারণা যে মনের অজান্তে কখন ভালবাসায় রূপ নিয়েছে, এবং মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের অবস্থা এতটা শোচনীয় তারই এক মাস্টারপিস জেন অস্টেনের উপন্যাস এবং তার অবলম্বনে জো রাইটের ২০০৫ সালের রোমান্টিক ছবি 'প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস'।
আঠার শতকের শেষ দিকে গ্রামীণ ইংল্যান্ডের বেনেট পরিবারের পাঁচ মেয়ে ছিলো। সুন্দরী ও মিষ্টি জেন সবার বড়, চটপটে ও বুদ্ধিমতী এলিজাবেথ দ্বিতীয়, শান্তশিষ্ট মেরি তৃতীয়, অপরিপক্ক কিটি চতুর্থ এবং উচ্ছৃঙ্খল লিডিয়া সবার ছোট।
বাবা মারা গেলে অসচ্ছল পরিবারটির সম্পত্তি মেয়েরা পাবে না, এই চিন্তায় মেয়েদের মায়ের ঘুম হারাম। দিনরাত তার একটাই সাধনা- মেয়েদের বড়লোক ছেলে ধরে বিয়ে দিতে হবে।
আর মেয়েদের বাবা এসব দেখেও দেখেন না। এমন সময় এলাকায় এক এস্টেটে আসেন ধনী তরুণ জমিদার মি. বিংলি। সাথে নিয়ে আসেন বন্ধু মি. ডারসিকে। যিনি আরো ধনী।
তাদের সম্মানে দেওয়া এক পার্টিতে বেনেটদের সাথে তাদের পরিচয় হয়। মিসেস বেনেট, কিটি ও লিডিয়ার অভদ্র আচরণ দেখা গেলেও জেন ও বিংলি একে অপরকে পছন্দ করে ফেলে।
অপরদিকে ডারসি অনিচ্ছাকৃতভাবে এলিজাবেথকে নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করেন। এবং এলিজাবেথ তা শুনে ফেলে।
এই তো শুরু হয় তাদের একে অপরের প্রতি বিরূপ ধারণা। প্রথম দর্শনেই নাক উঁচু ভদ্রলোকটির প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা আসে এলিজাবেথের মনে।
কিন্তু যখন জেনের অসুস্থতার কল্যাণে ডারসি আর এলিজাবেথের একে অন্যকে জানার সুযোগ হয়, তখন ডারসি নিজেকে আবিষ্কার করে এমন একজনের প্রেমে পড়তে।
কিন্তু এই ভালবাসার পথে তার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমাজ, পরিবার- সবকিছু। একদিন ডারসি এলিজাবেথকে বলেই ফেলে মনের কথা, তবে অনিচ্ছাকৃত অপমানজনক ভাষায়।
এর মাঝে অনেক কিছু ঘটে যায় তাদের মধ্যে। যাতে এলিজাবেথের মনে ডারসির প্রতি ঘৃণা আরো বেড়ে গিয়েছিলো।
তাই ডারসিকে বিয়ে করলে নিজের ও পরিবারের মঙ্গল হবে তা সত্ত্বেও সে ডারসিকে প্রত্যাখ্যান করে। এলিজাবেথের অসাধারণ ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ডারসি এলিজাবেথকে সুযোগ দেয় তাকে অন্য চোখে দেখার।
তার তথাকথিত উঁচুতলার গম্ভীর মুখোশের ভেতর থেকে নিজেকে বের করে আনার। এরপর কাহিনীতে দেখা যায় ডারসির অহংকার এবং সে সম্বন্ধে এলিজাবেথের ভুল ধারণা ভেঙে কাছে আসার এক আত্মোপলব্ধি।
তখনকার এই পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এলিজাবেথের আত্মসম্মানবোধ আর প্রতিবাদ সত্যিই প্রশংসনীয়।
আর ডারসি প্রথমে সত্যিই অহঙ্কারী থাকলেও এলিজাবেথের খোঁচা দেওয়া কথা আর আত্মবোধ তার ভেতরের আসল হৃদয়বান মানুষটিকে বের করে আনে।
এলিজাবেথের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ডারসি নিজেকে বদলে ফেলে বেশ ইতিবাচক করে। আর এলিজাবেথ চরিত্রটির মাঝেও যে ত্রুটি দেখানো হয়েছে সেটা হল তার ভুল ধারণা।
ডারসির প্রাইড বা অহংকার সম্পর্কে এলিজাবেথের প্রেজুডিস বা ভুল ধারণাও ডারসির আসল রূপ দেখে ভেঙে যায়।
আর এখানেই কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে। তাদের এক হওয়ার পথে বাধা সেই প্রাইড আর প্রেজুডিস ভাঙার পরীক্ষাতেই তারা এক হয়ে ওঠে। এলিজাবেথ আবিষ্কার করে এক নতুন ডারসিকে।
আসলে বিংলি জেনকে ভালোবাসতো তাই তাদের ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়নি এটাই দেখানো হয়েছে উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রটিতে।
পরবর্তীতে ডারসি এলিজাবেকে আবার প্রস্তাব দেয় এবং এলিজাবেথের সঙ্গে ডারসির মিলন ঘটে। উপন্যাসটি একটি সুখকর সমাপ্তির মাধ্যমে শেষ হয়।
অবাক লাগে, ২০০ বছর আগে লেখিকা জেন অস্টেন কীভাবে এমন দূরদর্শী উপন্যাস লিখেছিলেন! এলিজাবেথ চরিত্রটি তো পুরো একুশ শতকের মেয়ে! সেই সময়ে পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণই ছিল নারীর নিয়তি।
সেই সময়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত ইংরেজ পরিবারের মেয়েদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই ছিলো বিয়ে।
কোনোরকমে একটু ভালো ঘর এবং ভালো পাত্রের হাতে কন্যাকে তুলে দেয়াই ছিলো যেন সেই সময়কার নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সার্বিকভাবে এই চরম সলত্যিটাই এই উপন্যাস এবং তার অবলম্বনে চলচ্চিত্রটিতে জায়গা করে নিয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খুব একটা অমিল নেই।
বর্তমান সময়েও মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এসবই হয়।
আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। মনে রাখবেন শুভ প্রভাত প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় নিয়ে হাজির হয় আপনাদেরই জন্য। ধন্যবাদ।