প্রাচীন কালে বাংলার রেশম চাষ

ভারত ও বাংলাদেশে রেশম চাষের ব্যাপারে কিছু তথ্য, প্রাচীন কালের।

প্রাচীন কালে বাংলার রেশম চাষ
প্রাচীন কালে বাংলার রেশম চাষ


একসময় যে সারা ভারতে বাংলাদেশের রেশম বস্ত্র শিল্পের খ্যাতি ছিল তা কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রের পাশে Periplus of Erythrean নামক একটি গ্রন্থ থেকেও জানা যায়। এমনকি বাংলার যে বস্ত্র বাণিজ্য হত সে সম্পর্কেও আমরা গ্রীক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে জানতে পারি।


আবার বাংলা ছাড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও যে রেশমের চাষ হত তা জানা যায় মান্দাশোরের শিলালিপি থেকে।যদিও প্রশ্ন উঠতে পারে রেশম বলা হলেও এই বস্ত্র কি আসলে রেশমের?কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের টীকাকার জানাচ্ছেন কীটের জিবের রস কোন একটি গাছের পাতাকে এক রকম উর্ণাতে রূপান্তরিত করে। তাহলে এই উর্ণাই যে রেশম সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়।


রেশম শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে উৎপত্তি হলেও এর সাথে চিন দেশের নাম জড়িয়ে আছে।বলা হয় খ্রীষ্টের জন্মের ২৬০২ বছর আগে সম্রাট হোয়াঁতির চর্তুদশতম রানী সি-লিং-চি একদিন গাছের নিচে চা পান করছিলেন। সেই সময় একটি রেশম গুটি তার চায়ের কাপে এসে পড়ে। চা গরম হবার জন্যে রেশম গুটি থেকে সুতো বেরিয়ে আসে। রানীর গায়ের ফর্সা রঙ থেকে হোক বা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হোক বা সুতোর নিজের রঙ হোক, সেদিন থেকেই এই সুতোকে সোনালি সুতো বলা হতে থাকে।


সেই সময় এই রেশম চিনাদের কাছে একটি গুপ্ত বিদ্যা ছিল। চিনারা এই রেশমের মাধ্যমে পূর্ব পশ্চিম এশিয়া সেখান থেকে ভূমধ্যসাগরের উপকূল হয়ে গ্রীস ও পরে রোমান স্রামাজ্যেও বানিজ্য আরম্ভ করে।পরবর্তী কালে বার্মা, ইয়েমেন ও ভারতবর্ষে বানিজ্য আরম্ভ হয় বলে জানা যায়। যে রাস্তা দিয়ে রেশমের বানিজ্য হত অর্থাৎ চিন থেকে ভারত, পারশ্য আরব গ্রিস হয়ে ইটালি আজও সেই রাস্তাকেসিল্ক রুটবলা হয়। আরেকটি মতে বলা হয় সেকালে জাপান কোন ভাবে  চিনের এই গুপ্ত বিদ্যাটা জেনে নেয় এবং জাপান থেকে সেটি ভারতে আসে।

কলমের আবিষ্কার, বিশ্বের দামি কলমের ইতিহাস জানুন

ফ্যাশন ইতিহাসে সবথেকে বিপদজনক ফ্যাশন ট্রেন্ড

পৃথিবীতে দুর্গাপূজার সূচনা কোথায়? বিচিত্র ইতিহাস

ফরাসি বিপ্লব কেন হয়েছিল? জেনে নিন

অর্থাৎ একটি ধারণা সবার মাঝে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে যে ভারত রেশম চাষ চিন থেকে শিখেছে।এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা দরকার, ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ ‘মনুস্মৃতিতেএই রেশম চাষের উল্লেখ আছে, সেখানে রেশমের পোশাককে কীটজ বস্ত্রবলা হত। সেক্ষেত্রে বলা হয় খ্রীষ্টের জন্মের অনেক আগেই মুর্শিদাবাদ, মালদা ও অবিভক্ত বাংলার রাজশাহি জেলায় রেশমের চাষ হত


এখানে মূলত অতুঁতজাত রেশমের চাষ হত।তাই বলা যেতে পারে তুঁতজাত রেশমের চাষ চিন থেকে পারশ্যের মাধ্যমে ভারতে এলেও অতুঁতজাত রেশম এই বাংলাতে অনেক আগে থেকেই চাষ হচ্ছে।এই অতুঁতজাত রেশমকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।তসর, মুগা ও এণ্ডি বা এরি।ইংরেজ বণিকরাও ১৬২১ সালে মুর্শিদাবাদে রেশম চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠে।কাশিমবাজারে একটি কুঠিও স্থাপন করা হয়।


বলা হয় বাংলা তথা সারা ভারতেই অন্যান্য রাজ্যের রাজারা এই সময় মুর্শিদাবাদে তাদের লোক পাঠাতেন রেশম চাষ শেখবার জন্যে। সম্ভবত টিপু সুলতানও মহিশুরের তাঁতিদের বাংলাতে এই রেশম চাষ ও রেশম সুতো থেকে বস্ত্র নির্মানের কৌশল শেখবার জন্যে পাঠিয়েছিলেন।কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন ইংরেজদের এই দেশে আসার অন্যতম কারণ হল এই রেশম চাষ। ‘Bengal Silk’ বলতে রাজশাহী, মালদা ও মুশিদাবাদের সিল্ককেই বোঝায়


আমরা চানক্যের ‘অর্থশাস্ত্রথেকে জানতে পারি বাংলাদেশে যিশুখ্রীষ্টের জন্মের চারশ বছর আগে রেশমের চাষ হত এবং রেশমের ভালো কাপড়ের নাম ছিল পত্রোর্ণবা পাতার পশম(পত্র হতে যার উর্ণা) ।মগধ, পৌণ্ড্রদেশ ও সুবর্ণকুড্য বা সুবর্ণকুড্যক প্রভৃতি দেশে লিকুচ, বকুল ও নাগবৃক্ষে এই রেশম কিট জন্মাত।এই প্রসঙ্গে বলা রাখা দরকার মগধ হল বর্তমান বিহার, আর সুবণ্যকুড্য হল পরবর্তী কালের কর্ণসুবর্ণ, যা মুশির্দাবাদ ও রাজমহল নিয়ে গঠিত ছিল


এই অঞ্চলের মাটি ছিল সোনালি রঙের এবং এখানেই খুব নাগকেশ গাছ জন্মায়।সাধারণত লিকুচ গাছ থেকে ধুসর, বকুল গাছ থেকে সাদা এবং নাগবৃক্ষ থেকে হলুদ এবং অন্য কয়েকটি গাছ থেকে ননী রঙের রেশম জন্মাত


এই সুবর্নকুড্যেই সব থেকে ভালো রেশম পাওয়া যেত বলে জানা যায়। ‘অর্থশাস্ত্রের’ ‘কোষপ্রবেশ্যরত্নপরীক্ষাএই অধ্যায়ে রাজকোষে কোন কোন ভালো জিনিস রেখে দিতে হবে তার একটা তালিকা আছে।সেই সব ভালো জিনিসকে ‘রত্নবলা হয়েছে, যার মধ্যে আছে অগরু, চন্দন, চামড়া, এছাড়া পাট, তুলো ও রেশমের কাপড়


অর্থাৎ যিশুখ্রীষ্টের জন্মের বহু আগেই যে এই বাংলাতে রেশমের চাষ হত এবং সেই রেশম থেকে বস্ত্র তৈরি করে তার বানিজ্য হত এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।তাহলে রেশম চাষ শেখানোতে চিনের কি কোন ভূমিকা নেই? আছে যেহেতু বাংলাতে অতুঁতজাত রেশম জন্মাত তাই আমরা বলতে পারি তুঁতজাত রেশম চাষ শেখানোটা চিনের কৃতিত্ব


কিন্তু মুশকিল হল অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন সম্পূর্ণ রেশম চাষ আমরা চিন থেকেই শিখেছি।ভ্রান্ত ধারণা বেশির ভাগ সময়েই সঠিক ইতিহাস রচনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

 ঋণ- প্রাচীন বাংলার গৌরব (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী), বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব( নীহাররঞ্জন রায়), কিছু পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেট।