ফেসবুকের আবিষ্কার ও ইতিহাসঃ বৃহৎ সামাজিক পরিবর্তন

ফেসবুক সম্পর্কে ধারণা নেই এমন মানুষ বর্তমান সময়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে তরুণদের বেশিরভাগ সময় কাটে ফেসবুকে৷ এই ফেসবুক কিভাবে আবিষ্কৃত হলো এবং সমাজে এর কি ধরনের প্রভাব পড়ছে, তা নিয়েই আজকের লেখা।

ফেসবুকের আবিষ্কার ও ইতিহাসঃ বৃহৎ সামাজিক পরিবর্তন
ফেসবুকের আবিষ্কার ও ইতিহাস


ফেসবুক সময়ের এক আজব আবিষ্কার। বর্তমান পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ তাদের দিন শুরু করে ফেসবুকে স্ক্রল করার মধ্য দিয়ে, আবার দিনের শেষেও একবার এতে ঘুরে না গেলে যেন দিন সম্পূর্ণ হয় না। ছবি, ভিডিও এবং বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করা থেকে শুরু করে অনলাইন ব্যবসা সবই এখন এর মাধ্যমে করা যাচ্ছে। সব বয়সী মানুষের কাছে ফেসবুক তাই হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় এবং সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।


ফেসবুক কি

বর্তমান সময়ের সর্বাপেক্ষা বেশি ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো ফেসবুক। ইংরেজি Facebook অথবা ফেসবুককে সংক্ষেপে ফেবুও বলা হয়। এটি সারা বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইট, যা ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফেসবুক ইনক এর মালিকানাধীন এ ওয়েবসাইটে কোনো মূল্য ছাড়াই সদস্য হওয়া যায়।

এর সদর দপ্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত। নিষিদ্ধ করা হয়েছে এরকম দেশগুলো ছাড়া বিশ্বের বাকি সব দেশেই ফেসবুক ব্যবহার করা হয়। ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ওকুলাস ভিআর এর অধীনস্থ কোম্পানি। সারাবিশ্বে প্রায় ২.৭ বিলিয়ন সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে।


ফেসবুকের আবিষ্কার

মার্ক জাকারবার্গ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার রুমমেট কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র এডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিতস এবং ক্রিস হিউজের সহায়তায় ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমদিকে এটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে বোস্টন শহরের অন্যান্য কলেজ এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পরবর্তীতে এটি সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, হাইস্কুল এবং ১৩ বছরের বেশি বয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।


২০০৪ সালের জুন মাস নাগাদ প্রায় দেড় লক্ষ এবং ডিসেম্বর মাস নাগাদ প্রায় ১ মিলিয়ন ব্যবহারকারী ফেসবুক ব্যবহার শুরু করে। ২০০৫ সালে মার্ক জাকারবার্গ 'দ্য ফেসবুক' নামকে সংক্ষিপ্ত করে ফেসবুক রাখেন এবং এ নামেই একটি ডোমেইন কিনে নেন। এতে প্রায় ২ লক্ষ মার্কিন ডলার খরচ হয়েছিল। আর এরপর থেকেই একের পর এক সাফল্য তার হাতে ধরা দিতে থাকে। বর্তমানে সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারী। 



ফেসবুক আবিষ্কারের ইতিহাস

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে পড়ার সময় মার্ক জাকারবার্গ ২০০৩ সালের ২৮ অক্টোবর ফেসম্যাস নামের একটি সাইট তৈরি করেন। এতে তিনি হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের ছবি ব্যবহার করে দুইটি করে ছবি পাশাপাশি দেখান এবং সব শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে বলন। 'হট অর নট' নামের এই ভোটদান প্রোগ্রামের জন্য জাকারবার্গ হার্ভার্ডের সংরক্ষিত তথ্যকেন্দ্র হ্যাক করেন। ফেসম্যাস এ মাত্র ৪ ঘণ্টায় প্রায় ২২০০০ ছবিতে ভোট প্রদান করা হয়।


২০০৪ সালে ফেসম্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মার্ক জাকারবার্গ নতুন একটি সাইটের কোড লেখা শুরু করেন এবং ঐবছর ফেব্রুয়ারিতে হার্ভার্ডের একটি ডরমিটরি থেকে শুরু হয় 'দ্য ফেসবুক' এর যাত্রা। এতে জাকারবার্গের সাথে যুক্ত হন ডাস্টিন মস্কোভিতস, ক্রিস হিউজ, এডওয়ার্ডো সেভারিন এবং অ্যান্ড্রু ম্যাককালাম। ২০০৫ সালে কোম্পানির নাম শুধু ফেসবুক রাখা হয়। ২০০৬ সালে বিভিন্ন টেকনিক্যাল কারণে ফেসবুকের সাথে যুক্ত হয় মাইক্রোসফট। একই বছর সেপ্টেম্বরে সবার সবার জন্য ফেসবুক উন্মুক্ত করা হয়। এর পূর্বে এটি শুধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত মানুষেরাই ব্যবহার করতো।


২০০৭ সালে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দুই   কোটিতে পৌঁছে যায়। ২০০৮ সালে মাত্র ১ বছর পরেই তা হয়ে যায় ১০ কোটি। আর বর্তমান সময়ে বিশ্বের প্রায় ২৪০ কোটি লোক ফেসবুক ব্যবহার করছে। শুরুর দিকে ফেসবুকে ছবি আপলোড, ওয়াল, নিউজফিড, ইভেন্ট পেজ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য ছিল না। এগুলো পরবর্তীতে সংযুক্ত করা হয়েছে।


সামাজিক পরিবর্তনে ফেসবুক

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক আধুনিক সমাজের নতুন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। আর এর মাধ্যমে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মানুষ এখন চা খেতে খেতে পত্রিকা পড়ার চেয়ে ফেসবুকের নিউজফিড ঘাঁটতে বেশি পছন্দ করে। দেশ-বিদেশ থেকে শুরু করে নিজের চারপাশে কি ঘটছে তা ফেসবুকের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যাচ্ছে সবাই। আমাদের নিউজফিড ভরে যায় দরকারী-অদরকারী ছবি, সংবাদ এবং ঘটনায়।


পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষকে আরেক প্রান্তের মানুষের সাথে জুড়ে দিচ্ছে ফেসবুক। এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতে দূর হয়েছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। অনেকে তাদের সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া পুরনো বন্ধুদের সাথে নতুন করে যোগাযোগ করতে পেরেছে ফেসবুকের কল্যাণে। তবে এর ক্ষতিকর দিকও নেহাত কম নয়। ফেসবুকে সারাদিন থাকা মানুষটা হয়তো তার পাশের মানুষটার সম্পর্কেই জানে না। তাই বাস্তবে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানুষগুলো। তাছাড়া এর মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের মানসিকতায় ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।


ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে এক ধরনের নেশা তৈরি হয়। এর ফলে শারীরিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমন মানসিক স্বাস্থ্যেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আবার অনেকে সাইবার বুলিং বা সাইবার ক্রাইমেরও শিকার হয়। তবে অনৈতিক কাজগুলো বন্ধ করতে পারলে এবং সবাই সচেতন হলে, ফেসবুকের মাধ্যমে হওয়া সব পরিবর্তন ইতিবাচক হতে পারে।



আজকের যে বৃহৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক তা রাতারাতি এই পর্যন্ত আসেনি, চলার পথে এর প্রতিষ্ঠাতারা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। অনেক দেশে এটির আংশিক চালু আছে। আবার অনেক দেশ সময়ের অপচয় বলে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। তবে এসব বিষয় থাকা সত্ত্বেও এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মার্ক জাকারবার্গ এবং তার সহকর্মীরা। আর ফেসবুকের মাধ্যমেই গত দশকে সমাজের সব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে।


এখন প্রায় সমস্ত আন্দোলন ফেসবুকেই বেশি সরব হয়ে ওঠে, আর তা সফলতার মুখও দেখে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মানুষকে রাস্তায় বেরোতেই হলো না, সব এর মাধ্যমেই করা যাবে। আর তেমনটা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই, প্রযুক্তি এখন এতটাই উন্নত।