বঙ্গবন্ধুর স্বদেশের স্বপ্ন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু হিমালয়সম। তাইতো, কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কেস্ত্রো বলেছিলেন আমি হিমালয় দেখিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। একটা মানুষকে জানতে হলে তার স্বপ্ন, চালচলন, মানুষের সাথে তার ব্যবহার, ইত্যাদি সম্পর্কে জানলে তার সম্পর্কে জানা হয়।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশের স্বপ্ন
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশের স্বপ্ন


বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন এ দেশের মানুষের শান্তির জীবন৷ তিনি চাইতেন তার জীবনের বিনিময়ে হলেও যেন দেশের মানুষ শান্তিতে তাদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে। প্রতিটা মানুষই বড় কোন মানুষের সাহচর্য্যলাভ করে নিজে বড় হয়। বড় কারো কাছে না গেলে নিজেকে সেভাবে গড়া যায় না। বঙ্গবন্ধু হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, মাউলানা ভাষানী, শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হকের মত বড় মানুষদের সাহচর্যে নিজেকে ধন্য করেছিলেন।


বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী সাহেব এবং তার আগে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের এক সময়ের কাছের মানুষ আবুল হাশিম সাহেবের কাছ থেকে তিনি রাজনীতির মহাবিদ্যা আয়ত্ব করেছিলেন। তাদের মাধ্যমে দেশ বিদেশের বড় বড় নেতাদের সাথে তার পরিচয় ঘটেছিল। যা তার রাজনৈতিক মর্যাদাকে অনেক উপরে নিয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ কর্মী।


দেশ ও দেশের মানুষদের জন্য তিনি কষ্ট করতে পিছপা হননি। কোন চিন্তা ছাড়া তিনি জনতার স্বার্থে কাজ করতেন। ব্রিটিশ আমলে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দিকে খেয়াল দিলে দেখা যাবে তিনি মুসলমানদের জন্য কাজ করেছেন যাতে মুসলমানরা নিরাপদে তাদের অবস্থানে থাকতে পারে। অর্থাৎ সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা যাবে তিনি শুধু মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু না, তিনি ছিলেন অহিংস, উদার মননের মানুষ।সেসময় গোপালগঞ্জ, কলকাতা, আসামসহ পাক ভারতের প্রায় সব যায়গায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা খুব বেশী হত। এবং তা বঙ্গবন্ধুর মনকে আঘাত করত। দাঙ্গা হোক এটা তিনি চাইতেন না। কিভাবে দাঙ্গা, হাঙ্গামা বন্ধ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা যায় সে চেষ্টা করতেন।


তিনি চাইতেন ধর্মবিরোধিতা নয় বরং সব ধর্মের মানুষ যেন সুন্দরভাবে ধর্মপালন করতে পারে৷ কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা বাড়াবাড়ি যেন না হয় । সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সংস্পর্শে থাকাকালীন সময়ে তিনি এ উদারতার শিক্ষা পেয়েছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন খুব উদার, নির্লোভ, দূরদর্শী, দেশপ্রমিক ব্যক্তিত্ব। এ জন্যই তিনি পাক ভারতের অতুলনীয় শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রভাব খুব লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু হয়ে গড়ে উঠেছিলেন সোহরাওয়ার্দীর জন্যই। তার রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণ করে তিনি পৌছাতে পেরেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে কতটুকু শ্রদ্ধা করতেন তা তার লেখা পড়লে বুঝা যায়।


তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নামের সাথে সবসময় সাহেব লিখতেন এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে স্যার বলে সম্বোধন করতেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দী প্রেমিক এবং অসাম্প্রদায়িক। তিনি সবসময় ধর্মীয় সহিংসতামুক্ত শান্তির স্বদেশের স্বপ্ন দেখতেন। ব্রিটিশ আমলে মুসলমান সমাজের কষ্ট দেখে উনারা পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন। এরপরেও দেশের মানুষের কষ্ট, দূর্ভোগ লাগোব হওয়ার বদলে বেড়ে যাওয়ায় একসময় পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করতে হয়েছিল। কিন্তু সবসময় তা ছিল আমজনতার জন্য। বঙ্গবন্ধু এবং তার সময়ের সহযাত্রীরা অভাব অনটনের মধ্যে থেকেও আদর্শ বিচ্যুত হন নাই। প্রোগ্রামের টাকা ছিল না। মিটিংএ যাবেন ভাড়ার টাকা ছিল না তবুও বেঈমানী করেন নি।


কিন্তু বর্তমান প্রায় সবাই টাকার পিছনে লেগে থাকে। তখনকার সময়ে যারা আদর্শ বিচ্যুত হয়েছিল তাদেরকে এখনো ঘৃণাভরে স্মরণ করা হয়। এ থেকেও টাকার পিছনে ঘুরঘুর করা রাজনীতিবিদরা কেন শিক্ষা নেন না সে প্রশ্ন থেকেই গেল। যুক্তফ্রন্ট নেতাদের অনেকে যেভাবে নীতি আদর্শের জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন সেভাবে আজো অনেক নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নীতির কবর দিতে পিছপা হন না। যারা ক্ষমতায় থাকার জন্য বিরুধী মতের মানুষদের জুলুম, নির্যাতন, মামলা, হয়রানি করেছিলেন তাদেরকে জাতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল।


বিরুধী মতের ভালো পরামর্শ থাকলে দেশের স্বার্থে তা গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকে দেশের স্বার্থের উপরে স্থান দিলে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব৷ রাজনীতির ক্ষেত্রে কোটারি বন্ধ করা আবশ্যক৷ আইয়ুব খান, খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবরা কিভাবে মিলিটারি নির্ভর হয়ে জনতার কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিলেন তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। সহিংস রাজনীতি সবসময় অবিরত আছে। হিংসাত্মক রাজনীতি না ছাড়লে দেশ রসাতলে যাবে৷ বিনাবিচারে বন্দি করার সংস্কৃতি এখনো যায়নি।


বঙ্গবন্ধু বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়৷ দেশের স্বার্থে এ থেকে সরে আসাটা প্রতিটা দেশপ্রেমিকের জন্য কর্তব্য। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, আমরা বাঙ্গালী এবং মুসলমান। আমরা খুব পরশ্রীকাতর। বোধহয় পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায়ই পরশ্রীকাতরতা শব্দটা নেই। বর্তমানে আমাদেরকে পেয়ে বসেছে পরমতে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিপক্ষকে ঠেকাতে ঘুম খুন, মুখ বন্ধ করে দেয়ার রীতি। যা দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের জন্য বিরাট অভিশাপ। এগুলো ছাড়তে হবে।


কথা বলার সুযোগ দেয়া, ভুল হলে সংশোধিত হওয়া,সমালোচনা থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার। বিরুধীতার স্বার্থে বিরুধীতা নয় বরং বিরুধীতা করা দরকার দেশ ও জাতির স্বার্থে। মানুষ শত বৎসর বাঁচে না কিন্তু তার কর্ম তাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমরা হুজুগে , হিংসুক এবং আবেগী। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জনতাকে সাথে নিয়ে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হবে। গড়তে হবে এমন দেশ। যে দেশে মানুষের শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে। বঙ্গবন্ধু এমন শান্তির দেশ দেখতেই জীবনে এত জেল, জুলুম নির্যাতনের পরেও শান্তির দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

লেখকঃ আহমদ ইকবাল খান