বাংলাদেশের অজানা ৫টি সেরা মসজিদ সম্পর্কে জানুন
বাংলাদেশের বিখ্যাত আরও কিছু মসজিদ আছে। যেগুলো সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা খুব কম। এই মসজিদগুলো দর্শনীয় স্থান হিসেবেও পরিচিত। চলুন আজ এমনই সেরা ৫টি অজানা মসজিদ সম্পর্কে জেনে আসি।

১. খেরুয়া মসজিদ
Image source: wikipedia.org
অবস্থান : শেরপুর, বগুড়া
প্রতিষ্ঠিত :১৫৮২
গম্বুজ সমূহ : ৩টি
মিনার সমূহ : ৪টি
খেরুয়া মসজিদ বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন। মুঘল-পূর্ব সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে মোগল স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে নির্মিত এই মসজিদ।
প্রায় ৪৩৫ বছর ধরে টিকে থাকা এই মসজিদের অবস্থান বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলা সদরের খোন্দকার টোলা মহল্লায়।
মসজিদরির বিবরণ : এই মসজিদটি টিকে আছে চার কোণের প্রকাণ্ড আকারের মিনার আর চওড়া দেয়ালের কারণে। ইটে খোদাই করা নকশা ক্ষয়ে গেছে এবং চুন-সুরকির প্রলেপ ঝরে গেছে।
চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা পাতলা লাল ইটের দেয়ালগুলো ১.৮১ মিটার চওড়া। তার ওপর ভর করেই ছাদের ওপর টিকে আছে খেরুয়া মসজিদের তিনটি গম্বুজ। খেরুয়া মসজিদ বাইরের দিক থেকে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ১৭.২৭ মিটার, প্রস্থ ৭.৪২ মিটার।
এর পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলান দরজা। মাঝেরটি আকারে বড়। উত্তর-দক্ষিণে একটি করে খিলান দরজা। কোনোটিতেই চৌকাঠ নেই। ফলে দরজার পাল্লা ছিল না।
পূর্বের বড় দরজাটির নিচে কালো পাথরের পাটাতন। পূর্বের দরজা বরাবর পশ্চিমের দেয়ালের ভেতরের অংশে তিনটি মেহরাব। মেহরাবগুলোর ওপরের অংশ চমৎকার কারুকাজখচিত।
মসজিদটির নিচের অংশে ভূমি পরিকল্পনা মোগল স্থাপত্যরীতির। ওপরের অংশ মোগল-পূর্ব সুলতানিরীতিতে। চার কোণে দেয়াল থেকে খানিকটা সামনে চারটি বিশাল মিনার।
ছাদের ওপর তিনটি ৩.৭১ মিটার ব্যাসের অর্ধ গোলাকৃতির গম্বুজ। কার্নিশ ধনুকের মতো বাঁকা। তার তলায় সারিবদ্ধ খিলান আকৃতির প্যানেলের অলংকরণ। অত্যন্ত সুন্দর এর দেয়ালের গাঁথুনি।
নান্দনিক বৈচিত্র্য আনা হয়েছে ইটের বিন্যাস ও খাড়া প্যানেল তৈরি করে। সামনের অংশের ইটে আছে ফুল-লতা-পাতা খোদাই করা নকশা।
মিনার, গম্বুজ, নকশা ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনিতে পুরো স্থাপত্যটি অত্যন্ত নান্দনিক হয়ে উঠেছে। মসজিদের সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা আয়তাকার মাঠ।
মসজিদের কিনার দিয়ে তাল, নারকেল, আম, কদমগাছের সারি। এক পাশে মৌসুমি ফুলের গাছও আছে। ইটের প্রাচীরের ওপর লোহার রেলিং দিয়ে পুরো চত্বর ঘেরা।
মোট জায়গার পরিমাণ প্রায় ৫৯ শতাংশ। নামাজের সময় মুসল্লিরা ছাড়া সাধারণত কেউ ভেতরে প্রবেশ করে না। তাই প্রাঙ্গণটি নিরিবিলি এবং খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
২. ঘাঘড়া খান বাড়ি জামে মসজিদ
Image Source: wikipedia.org
অবস্থান : ঝিনাইগাতী উপজেলা, শেরপুর জেলা, ময়মনসিংহ
স্থাপত্য শৈলী : মুঘল স্থাপত্য
প্রতিষ্ঠাতা : আজিমোল্লাহ খান
প্রতিষ্ঠিত : ১৬০৮ সাল
ধারণ ক্ষমতা : ৩১ জন
দৈর্ঘ্য : ৩০ ফুট
প্রস্থ : ৩০ ফুট
গম্বুজ সমূহ : ১টি
মিনার সমূহ : ১০ টি
ঘাঘড়া খান বাড়ি জামে মসজিদ বাংলাদেশের শেরপুর জেলায় অবস্থিত প্রাচীন মসজিদ। মুঘল আমলে স্থাপিত এই মসজিদটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন।
এটি শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলার ঘাঘড়া লস্কর গ্রামে অবস্থিত। আর সে কারণেই এর নাম হয়েছে ঘাঘড়া খান বাড়ি জামে মসজিদ। ১৯৯৯ সালে মসজিদটির রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
মসজিদটির ইতিহাস : ঘাঘড়া খান বাড়ি জামে মসজিদ মুঘল আমলে নির্মিত হয়।
মসজিদের দরজায় কষ্টি পাথরে খোদাই করা আরবি ভাষায় নির্মাণকাল দেওয়া আছে হিজরী ১০২৮ সাল অথবা ইংরেজি ১৬০৮ সাল.মসজিদের গাঁয়ের নিদর্শন থেকে ধারণা করা হয় মসজিদটি বক্সার বিদ্রোহী হিরঙ্গী খানের সময়কালে নির্মাণ করা হয়েছিল।
আজিমোল্লাহ খান মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন বলে অনুমান করা হয়।
মসজিদের বিবরণ : মসজিদের ভিতরে দুটি সুদৃঢ় খিলান রয়েছে। মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট এবং এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৩০ ফুট। মাঝখানে গম্বুজে ছোটবড় ১০টি মিনার রয়েছে।
পূর্বদিকে একটি দরজা রয়েছে। ভিতরে মেহরাব ও দেয়ালে বিভিন্ন রঙের ও কারুকার্য করা ফুল ও ফুলদানি আঁকা আছে। মসজিদের দেয়ালের গাথুনী চুন ও সুরকি দিয়ে গাথা যার প্রস্ত ৪ ফুট।
মসজিদের মোট জমি ৫৮ শতাংশ যা তৎকালীন খান বাড়ির লোকজন ও গ্রামের অনেকে মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দিয়েছে।
মসজিদের মূল ভবন ও বারান্দা মিলে ১৭ শতাংশ এবং বাকি ৪১ শতাংশ জায়গায় রয়েছে কবরস্থান।
৩. আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ
Image Source: dhakapost.com
অবস্থান : বাংলাদেশ সিরাজগঞ্জ-এনায়েতপুর সড়ক, বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ
প্রতিষ্ঠিত : ২ এপ্রিল ২০২১
নির্মাতা : মোহাম্মদ আলী সরকার
গম্বুজ সমূহ : ১টি
ধারণক্ষমতা : ৫০০০
আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ সিরাজগঞ্জ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বেলকুচি পৌরসভা এলাকার ০৭ নম্বর ওয়ার্ডের মুকন্দগাঁতী মহল্লায় সিরাজগঞ্জ-এনায়েতপুর সড়কের পশ্চিম পাশে আড়াই বিঘা জমির ওপর নির্মিত একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। মসজিদটি ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মসজিদটির ইতিহাস : ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুকুন্দগাতী গ্রামের মোহাম্মদ আলী সরকার বেলকুচি পৌরভবনসংলগ্ন দক্ষিণে আড়াই বিঘা জমির ওপর তার ছেলে আল-আমান ও মা বাহেলা খাতুনের নামে আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
তিনি তার নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করে মসজিদটি নির্মাণ করেন। এটি নির্মাণে সময় লেগেছে চার বছর। শুরু থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪৫ শ্রমিক কাজ করেছেন।
মসজিদটির বিবরণ : মসজিদটিতে ছাই রঙের বড় একটি গম্বুজ রয়েছে। এ ছাড়া মেঝেতে সাদা রঙের টাইলস এবং পিলারগুলো মার্বেল পাথর জড়ানো রয়েছে।
মসজিদের তৃতীয় তলায় গম্বুজের সঙ্গে এবং অন্যান্য স্থানে রয়েছে বেশ কয়েকটি আলো ঝলমল ঝাড়বাতি। দুই পাশে রয়েছে ১১০ ফিট উচ্চতার দুটি মিনার।
মসজিদের চারপাশে সাদা রঙের পিলার, উঁচু জানালা, সাদা রঙের টাইলস এবং মসজিদচত্বরে সবুজ ঘাস।
৪. হিন্দা-কসবা শাহী জামে মসজিদ
Image Source: vromonguide.com
প্রতিষ্ঠিত : ১৩৬৫
প্রতিষ্ঠাতা : আব্দুল খালেক চিশতি
গম্বুজ সমূহ : ৫ টি
ধারণ ক্ষমতা : প্রায় ৩০০-৪০০
এটি বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলায় অবস্থিত ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের ছোয়ায় নির্মিত অন্যতম মসজিদ। জয়পুরহাট শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ক্ষেতলাল উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের হিন্দা গ্রামে এ মসজিদটি অবস্থিত।
মসজিদটির কাচ, চিনামাটির টুকরা ও মোজাইক করা দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন রকম নকশা যা মোগল স্থাপত্য শিল্পের অনুকরনে করা হয়েছে।
মসজিদটির ইতিহাস : বাংলা ১৩৬৫ সালে বাগমারী পীর হিসাবে পরিচিত চিশতিয়া তরিকার অন্যতম পীর হযরত আব্দুল গফুর চিশতীর (রহ) নির্দেশে মাওলানা আব্দুল খালেক চিশতি আমলে তারই তত্ত্বাবধানে এই মসজিদটি নির্মিত হয়।
হযরত আব্দুল কাদের নিজেই এর নকশা তৈরি ও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
মসজিদটির বিবরণ : মসজিদটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর অবকাঠামো। মোগল আমলের আকৃতিতে নির্মিত বেশিরভাগ মসজিদের বাইরের দেয়ালে পোড়ামাটির আস্তরন দেখা যায়।
কিন্তু এই মসজিদের বাইরের আস্তরণে পরিলক্ষিত হয় কাঁচ ও চিনামাটির টুকরার সমন্বয়ে বিভিন্ন নকশা। সূর্যের আলো পড়তেই এই মসজিদটির ঝলমলে নজরকাড়া রূপ যে কাওকে মুগ্ধ করে।
মসজিদের কক্ষের দৈর্ঘ্য ৪৯.৫০ ফুট ও প্রস্থ ২২.৫০ ফুট। ইসলামের ৫ টি স্তম্ভের কথা চিন্তা করে এর ৫ টি গম্বুজ তৈরি করা হয়েছে।
মাঝের বড় ১টি ও চারপাশের ৪টি ছোট গম্বুজ রড ছাড়াই তৈরি হয়েছে। মসজিদের উত্তর পাশে ৪০ ফুট লম্বা মিনার রয়েছে। মিনারটির নিচে একটি ছোট কক্ষ আছে যেখান থেকে আযানের ব্যবস্থা করা আছে।
মিনারের উপরে মাইক স্থাপন করা আছে যেখান থেকে আযানের ধ্বনি এলাকায় মুসল্লিদের নামাজের আহ্বান জানায়।
পূর্ব পাশে রয়েছে হযরত শাহ্ সুলতান বখতির ৪জন শিষ্যের মাজার। প্রায় ৩০০-৪০০ মুসল্লী এখানে একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে।
৫. জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ
Image Source: arthosuchak.com
প্রতিষ্ঠিত : ২০১৩
অবস্থান : চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
ধারণক্ষমতা : ১০,০০০
জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত একটি বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক মসজিদ; যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় মসজিদ হিসাবেও পরিচিত।
২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিল-২০১৩ পাসের মাধ্যমে এই মসজিদ ও কমপ্লেক্স ব্যবস্থাপনা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় আনা হয়।
মসজিদটির বিবরণ : এটি অনেকগুলি খিলানসহ চমৎকার স্থাপত্যে নির্মিত। মূল ভবনটি পাঁচতলা মসজিদ। প্রায় ১০০০০ মানুষ এখানে একত্রে নামায আদায় করতে পারে।
মূল ভবনের সামনে একটি বিশাল জায়গা রয়েছে সেখানে ঈদ উল ফিতর এবং ঈদ উল আযহার সময় ঈদের নামায অনুষ্ঠিত হয়। ঈদের সময় এখানে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ একত্রে জড়ো হয়।
পাঠক বন্ধুরা এই ছিলো বাংলাদেশের ৫টি সেরা অজানা মসজিদ সম্পর্কে তথ্য। আশা করি ভালো লেগেছে। এমন আরও সুন্দর সুন্দর তথ্য নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে।
সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।
আরও পড়ুনঃ খুলনা বিভাগের ৫টি ঐতিহাসিক দর্শনীয় মসজিদ