বাংলাদেশের দৃষ্টিনন্দন ৫টি সেরা মসজিদ সম্পর্কে জানুন
মসজিদ শুধু ইবাদতই নয়, ইসলামি শাসনামলে মসজিদ থেকেই পরিচালিত হতো রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। ইসলামের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে নির্মিত হয়েছে বহু মসজিদ। এই মসজিদগুলো শুধু ইবাদত বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনাতেই খ্যাত নয়, এগুলো বেশ দৃষ্টিনন্দনীয়। এমনই ৫টি সেরা মসজিদ সম্পর্কে জানতে হলে পড়তে থাকুন শেষ পর্যন্ত।

১. হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ
Image Source: wikipedia.org
অবস্থান : চাঁদপুর জেলা, চট্টগ্রাম
প্রতিষ্ঠাতা : হাজী আহমদ আলী পাটোয়ারী
প্রতিষ্ঠিত : ১৩৩৭
ধারণ ক্ষমতা : প্রায় ১০ হাজার
গম্বুজসমূহ : ২টি
মিনারসমূহ : ১টি
মিনারের উচ্চতা : ১২১ ফুট
মসজিদটির ইতিহাস: চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জে অবস্থিত শৈল্পিক কারুকার্যময় হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদটি। এটি আয়তনের দিক দিয়ে উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম।
১৩৩৭ বঙ্গাব্দে হাজী আহমদ আলী পাটোয়ারী হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা করেন। প্রায় ২৮,৪০০ বর্গফুট আয়তনের বিশাল এই মসজিদে একসাথে প্রায় ১০ হাজার মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন।
আর বাংলাদেশে জুমাতুল বিদা’য়ার সবচেয়ে বড় জামাত এই মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ৬ষ্ঠ বৃহৎ এই মসজিদে প্রায় ১৮৮ ফুট উঁচু দৃষ্টিনন্দন মিনার রয়েছে।
বাংলা একাদশ শতকের দিকে মকিম উদ্দিন (রঃ) নামে বুজুর্গ কামেলের বংশের শেষ পুরুষ হাজী মনিরুদ্দিন (রঃ) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি দোকান থেকে পর্যায়ক্রমে হাজীগঞ্জ গড়ে ওঠে। হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও ওয়াকীফ হাজী আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রঃ) ছিলেন মনাই হাজী (রঃ) এর প্রপৌত্র।
খড়ের তৈরি একচালা এবাদতখানা থেকে যাত্রা শুরু করে ধীরে ধীরে মসজিদটি খড়ের দোচালা এবং পরবর্তীতে টিনের দোচালা মসজিদের রূপ লাভ করে।
পরবর্তীতে বাংলা ১৩৩৭ সনে হযরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রঃ) কতৃক পাকা মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করানো হয়।
হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হলে মর্মর পাথরের মূল মসজিদে ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ১০ অগ্রহায়ণ প্রথম জুমার নামাজের আযান দেয়া হয়।
সেই ঐতিহাসিক জুমার নামাজে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী একেএম ফজলুল হক, নওয়াব মোশারফ হোসেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও নওয়াবজাদা খাজা নসরুল্লাহসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
২. মির্জাপুর শাহী মসজিদ
Image Source: bn.wikipedia.org
ধরন : প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
অবস্থান : আটোয়ারী উপজেলা, পঞ্চগড় জেলা
প্রতিষ্ঠিত : ১৬৫৬
মির্জাপুর শাহী মসজিদ পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটি আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর নামক গ্রামে অবস্থিত বলে এর নামকরণ করা হয়েছে মির্জাপুর শাহী মসজিদ।
মসজিদটির ইতিহাস: মসজিদের শিলালিপি ঘেঁটে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ধারণা করেন মির্জাপুর শাহী মসজিদটি ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে মসজিদটি কে নির্মাণ করেছেন এটি নিয়ে ঐতিহাসিক মতপার্থক্য রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন, মালিক উদ্দিন নামে মির্জাপুর গ্রামেরই এক ব্যক্তি মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই মালিক উদ্দিন মির্জাপুর গ্রামও প্রতিষ্ঠা করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, দোস্ত মোহাম্মদ নামে জনৈক ব্যক্তি মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ধারণা করেন, মুঘল শাসক শাহ সুজার শাসনামলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিলো।
মসজিদটির বিবরণ: মির্জাপুর শাহী মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট ও প্রস্থ ২৫ ফুট। মসজিদটির সামনের দেওয়ালে চিত্রাঙ্কন ও বিভিন্ন কারুকার্য রয়েছে যেগুলো একটি অপরটি থেকে আলাদা।
মসজিদটিতে একই সারিতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। প্রতিটি গম্বুজের কোণায় একটি করে মিনার রয়েছে। মসজিদটিতে ফারসি ভাষার একটি শিলালিপি রয়েছে যেটা থেকেই ধারণা করা হয় এটি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল।
কিংবদন্তী অনুসারে, একটি ভূমিকম্পে মসজিদটির কিছু অংশ ভেঙ্গে যায় এবং ইরান থেকে মসজিদটি সংস্কারের জন্য লোক নিয়ে আসা হয়।
৩. পাগলা মসজিদ
Image Source: travelbd.xyz
নেতৃত্ব : মুফতি খলিলুর রহমান, পেশ ইমাম
অবস্থান : কিশোরগঞ্জ সদর
স্থাপত্য শৈলী : আধুনিক
ধারণ ক্ষমতা : ১৫০০
গম্বুজসমূহ : ৩টি
মিনারসমূহ : ১টি
মসজিদটিতে ২৪ ঘণ্টা দান-খয়রাত করার ব্যবস্থা রয়েছে
পাগলা মসজিদ বা পাগলা মসজিদ ইসলামি কমপ্লেক্স বাংলাদেশের একটি প্রাচীন মসজিদ যা কিশোরগঞ্জ সদরের নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত।
তিন তলা বিশিষ্ট মসজিদটিতে একটি সুউচ্চ মিনার রয়েছে। মসজিদ কমপ্লেক্সটি ৩ একর ৮৮ শতাংশ জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭৯ সালের ১০ মে থেকে ওয়াকফ্ স্টেট মসজিদটি পরিচালনা করছে।
মসজিদটির ইতিহাস: পাগলা মসজিদটি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার হারুয়া নামক স্থানে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত।
জনশ্রুতি অনুসারে, ঈসা খান এর আমলে দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা নামক একজন ব্যক্তি নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। পরবর্তীতে স্থানটিতে মসজিদটি নির্মত হয়।
জিল কদর পাগলার নামানুসারে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। অপর জনশ্রুতি অনুসারে, তৎকালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের ‘পাগলা বিবি’র নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয়।
সমাজ কল্যাণ: মসজিদের আয় থেকে বিভিন্ন সেবামূলক খাতসহ জটিল রোগীদের চিকিৎসায় এর অর্থ ব্যয় করা হয়।
এবার মসজিদের আয় দিয়ে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনে দেওয়া হয়।
৪. আতিয়া মসজিদ
Image Source: gootrip.xyz
অবস্থান : টাঙ্গাইল জেলা, ঢাকা
প্রতিষ্ঠিত : ১৬০৮-১৬০৯, ১৬১০-১৬১১
নির্মাতা : সাঈদ খান পন্নী
আতিয়া মসজিদ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলায় অবস্থিত একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক মসজিদ যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
এই মসজিদটি ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে এবং এখানে নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এ স্থাপনার তত্ত্বাবধান করছে।
মসজিদটির ইতিহাস: আরবি ‘আতা’ থেকে ‘আতিয়া’ শব্দটির উৎপত্তি। যার বুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘দান কৃত’। আলি শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরী (র.) কে সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ দান করলে তিনি এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন।
সে সময় তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের জন্য আফগান নিবাসী কররানী শাসক সোলাইমান কররানীর কাছ থেকে সংলগ্ন এলাকা দান বা ওয়াকফ্ হিসাবে লাভ করেন। এবং এই এলাকাটি তাঁকে দান করায় এই অঞ্চলটির নাম হয়েছে ‘আতিয়া’।
পরবর্তীতে বাবা আদম কাশ্মিরীর পরামর্শক্রমে সাঈদ খান পন্নী নামক সুফিজির এক ভক্তকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গির উক্ত আতিয়া পরগণার শাসন কর্তা হিসেবে নিয়োগ দান করেন।
এই সাঈদ খান পন্নীই ১৬০৮ সালে বাবা আদম কাশ্মিরীর কবরের সন্নিকটে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন।
মুহাম্মদ খাঁ নামক তৎকালীন এক প্রখ্যাত স্থপতি এই মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
রওশন খাতুন চৌধুরাণী ১৮৩৭ সালে এবং আবুল আহমেদ খান গজনবী ১৯০৯ সালে মসজিদটির সংস্কার করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার এই মসজিদটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে অধিগ্রহণ করেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রিত দশ টাকা মূল্যমানের নোটের একপার্শ্বে আতিয়া মসজিদের ছবি রয়েছে।
মসজিদটির বিবরণ: লাল ইট দ্বারা নির্মিত এই মসজিদটি আকারে বেশ ছোট। দেয়ালের পুরুত্ব ২.২৩ মিটার। এর চারকোণে ৪টি অষ্টকোণাকৃতীর মিনার রয়েছে। যার উপরের অংশটি ছোট গম্বুজের আকৃতি ধারণ করেছে।
সুলতানি ও মুঘল—এই দুই আমলেরই স্থাপত্যরীতির সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে এই মসজিদের নির্মাণ শৈলীতে।
৫. আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ
Image Source: jagonews24.com
অবস্থান : চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
প্রতিষ্ঠিত : ১৬৬৭
ধরণ : মুঘল স্থাপত্য
গম্বুজ : ৩টি
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য।
মসজিদটির ইতিহাস: চট্টগ্রামের চাটগছার আন্দরকিল্লার সাথে মোঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনী সম্পর্কিত। এই কিল্লা বা কেল্লায় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিলো।
১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁ'র ছেলে উমেদ খাঁ এই আন্দরকিল্লার অন্দরে বা ভিতরে প্রবেশ করলে এর নাম হয়ে যায় "আন্দরকিল্লা"।
চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে এখানে নির্মাণ করেন "আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ"।
মসজিদটির বিবরণ: আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোঘল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভুমি থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের উপর এর অবস্থান।
মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৬ মিটার দীর্ঘ, ৬.৯ মিটার প্রস্থ এবং প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২.২ মিটার পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি।
মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। ১৬৬৬ সালে নির্মিত এর চারটি অষ্টভূজাকৃতির বুরুজগুলির মধ্যে এর পেছনদিকের দুটি এখন বিদ্যমান।
মসজিদটির পূর্বে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মাঝের ও সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এই ছিলো বাংলাদেশের দৃষ্টিনন্দন ৫টি সেরা মসজিদ। আশা করি ভালো লেগেছে। আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে।
সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।