বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার বা দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য একটি গুরুতর মানসিক রোগ

বাইপোলার রোগটি এখন গোটা বিশ্বে যেভাবে তার দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে করে রীতিমতো কপালে ভাঁজ পড়েছে মনোবিদদের। এটি তেমনই জটিল একটি মানসিক রোগ। চলুন আজ এই মানসিক ব্যধি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার বা দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য একটি গুরুতর মানসিক রোগ
বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার বা দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য একটি গুরুতর মানসিক রোগ


বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার’ বা দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য একটি গুরুতর মানসিক রোগ। ‘বাই’ শব্দের অর্থ ‘দুই’ আর ‘পোলার’ হলো মাথা বা দিক। এই রোগের দুটি দিক থাকে। একদিকে থাকে ‘ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা’, অপরদিকে থাকে ‘ম্যানিক কন্ডিশন’।


একদিকে যেমন বিষণ্ণতা কাজ করে, আরেকদিকে কাজ করে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস। শুনতে খুব সমস্যাদায়ক মনে না হলেও বিষয়টি খুবই গুরুতর। এ রোগটি নিয়ে বিস্তারিত জেনে রাখুন।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার কি?

এটি একটি তীব্র মানসিক রোগ, যাকে বাংলায় বলা হয় দ্বিমুখী আচরণ বৈকল্য। এই রোগে বিষণ্ণতা রোগের সমস্ত উপসর্গ দেখা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই যদি কারো মন খারাপ থাকে বা কষ্ট লাগার অনুভূতি হয় তবে তাকে বিষণ্ণতা বলে।


এর একদিকে অতিরিক্ত আনন্দ অনুভূত হয়, অন্যদিকে বিষাদে মন ছেয়ে যায়। একদিকে ব্যক্তি প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় ভোগে, বেশির ভাগ সময়ই মন খারাপ থাকে। অন্যদিকে ম্যানিক কন্ডিশনের কারণে ব্যক্তি নিজেকে অনেক বড় মনে করতে থাকে, অতি আনন্দ অনুভব করে, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস অনুভব করে। এ ছাড়া সব কিছুতেই অতিরিক্ত অস্থিরতা কাজ করে। তবে দুটি দিক থাকলেও রোগ একটিই।


আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াট্রির এক রিপোর্টে বলা হয়, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শতকরা ৬০ ভাগ বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রথম লক্ষণ দেখা দেয় কৈশোরে বা তার আগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাইপোলার ডিজঅর্ডার সারা বিশ্বে ষষ্ঠ অক্ষমতার কারণ।


বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার কেন হয়? 

মস্তিষ্কে নরঅ্যাড্রেনালিন, সেরোটনিন, ডোপামিন জাতীয় বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, তীব্র মনঃসামাজিক চাপ, স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা, নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণ ইত্যাদি কারণে এ সমস্যা হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আর বংশে কারও এ সমস্যা থাকলে অপর সদস্যদের মধ্যে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।


এই রোগটি কাদের হয়?

নারী-পুরুষ উভয়েরই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সমান। সাধারণত তরুণ বয়সে এই রোগের লক্ষণ শুরু হয়, তবে যেকোনো বয়সেই এমনকি শিশুদের ও বৃদ্ধ বয়সেও এ রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, এক হাজার জন মানুষের মধ্যে ৩ থেকে ১৫ জনের রোগটি রয়েছে।


বাংলাদেশে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক যৌথ জরিপের প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রতি ১০০০ জন মানুষের মধ্যে ৪ জন বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত।


বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার এর লক্ষণগুলো কি?

বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার রোগের বিষণ্ণতার লক্ষণের সাথে ক্লিনিক্যাল বিষণ্ণতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা হল:

১. খাবারের ইচ্ছে কমে যাওয়া বা ওজন হ্রাস কিংবা বেশী খাওয়া বা ওজন বেড়ে যাওয়া।

২. মনঃসংযোগ করতে, মনে রাখতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা।

৩. অবসাদ, কাজ করার ক্ষমতা কমে যাওয়া, অনেকটা “গয়ংগচ্ছ” ভাব।  

৪. দোষী দোষী মনে হওয়া, নিজেকে অপদার্থ ভাবা, নিরুপায় অনুভূতি। 

৫. হতাশা, ভালো না দেখে খারাপ দিকটা দেখা।

৬. নিদ্রাহীনতা, অনেক সকালে উঠে পড়া বা বেশীক্ষণ ধরে ঘুমনো। 

৭. পছন্দের শখ বা কাজকর্মের ইচ্ছা অথবা খুশী কিংবা তৃপ্তি হারিয়ে ফেলা।

৮. স্থায়ী শারীরিক উপসর্গ, যা চিকিৎসায় সাড়া না দেওয়া, যেমন মাথাব্যাথা, হজমের গোলমাল এবং ক্রনিক যন্ত্রণা। 

৯. সারাক্ষণ মন খারাপ, চিন্তাগ্রস্ততা, কিংবা “খালি খালি” লাগা। 

১০. অস্থিরতা-ছটফটানি, বিরক্তি। 

১১. মৃত্যু বা আত্মহত্যার চিন্তা, আত্মহত্যার চেষ্টা।


চিকিৎসা :

সঠিক সময়ে রোগটি শনাক্ত করার পর মনরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ধৈর্য সহকারে  ওষুধ সেবন করলে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। কখনো কখনো হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করার প্রয়োজন হতে পারে।


সময় মতো সঠিক চিকিৎসা না পেলে সম্পদ বিনষ্ট, মাদকাসক্তি, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মনোনিবেশ, আত্মহত্যা বা অপরকে হত্যার মতো যেকোনো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে এরা।


পরিবারের করনীয়:

১.বাইপোলার মুড ডিস অর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে আচরণে সচেতন থাকতে হবে। 

২. তাদের আঘাত করে বা কষ্ট দেয় এমন কোনো কথা অথবা কাজ করা যাবেনা।

৩. তাদের সঙ্গে তর্কে জড়ানো একেবারেই উচিত হবেনা। 

৪. তাকে অপরাধী মনে করবেন না। 

৫. এমনকি উত্ত্যক্তও করবেন না। 

৬. তার কোনো আচরণের জন্য দায়ী করে মারধর করবেন না। 

৭. ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিয়ে তাদের পাশে থাকবেন।


এতে ধীরে ধীরে হয়তো তারা এই রোগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এবং সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবে। আর মনে রাখবেন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ভাবেই ওষুধ বাদ দেয়া যাবে না।


তাই অন্যের কথা মতো বা নিজে নিজে পান্ডিত্য দেখিয়ে কোনো রোগ কেই অবহেলা করবেন না। এতে আপনি এবং আপনার পুরো পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে নিজে এবং নিজের পরিবারকে ভালো রাখুন।


প্রিয় পাঠক বন্ধুরা আজ এই পর্যন্তই! আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সবসময় শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।