বাস্তবতার প্রয়োজনে - অমানবিক নির্যাতনের থেকে উঠে আসা একটি মেয়ের গল্প

অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা একটি লড়াকু মেয়ের গল্প। যে দরিদ্রতাকে হারিয়ে জিতে নিয়েছে স্বচ্ছলতা।

বাস্তবতার প্রয়োজনে - অমানবিক নির্যাতনের থেকে উঠে আসা একটি মেয়ের গল্প
বাস্তবতার প্রয়োজনে - অমানবিক নির্যাতনের থেকে উঠে আসা একটি মেয়ের গল্প


অভাব আর দরিদ্রতা যখন ছায়ার মত পিছু ছাড়তে নারাজ। তখন বিষন্নতায় জ্বলে পুড়ে নিশ্চুপ হাহাকার আর নিরব আর্তনাদ কেটে যাচ্ছে সেই মানুষগুলোর ,সেই পরিবার গুলোর দিন থেকে মাস মাস থেকে বছর, বছর থেকে যুগে কিন্তু পরিত্রান মিলছে না এই মানুষগুলোর।


অভাবী ঘরের মেয়ে রোকেয়া । তার দরিদ্র মুখখানায় বেশ মায়া লুকিয়ে । অভাবের তাড়নায় ক্লান্ত দুটি চোখ মাঠ প্রান্তর সমস্ত সীমানা পেরিয়ে ছুটে যায় অনেক দূরে। তার ক্লান্ত দুচোখ খোজে ফিরে অভাবমুক্ত সমাজ,স্বচ্ছল পরিবার,লাল টুকটুকে গোলাপের মতো সুগন্ধময় জীবন। 


রোকেয়ার বাবা একজন দিনমজুর। তাদের সংসারে অভাব লেগেই থাকে। ছয় ভাইবোন তারা। প্রতিনিয়ত ক্ষুধা,দরিদ্রতা তাদের নিত্য সঙ্গী। ভাইবোনদের মাঝে রোকেয়া সবার বড়। একদম অজ পাড়াগাঁয়ে তাদের জীবনযাপন।কাজের নেই তেমন কোনো সুযোগ। অবশ্য এই অঞ্চলের বেশির ভাগ পরিবারগুলো রোকেয়াদের পরিবারের মতই। আর রয়েছে কিছু প্রতিপত্তিশালী মহাজন। যারা চওড়া সুদে এ অঞ্চলের দরিদ্রদের ঋণ দেয়। ফলে দরিদ্র হয় নিঃস্ব। ভূস্বামীদের আরো সম্পত্তি বাড়ে। তবে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে এ অঞ্চলের অনেক ছেলেপুলে কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমায়। পড়াশোনার খুব একটা রেওয়াজ নেই এখানে।অবশ্য যেখানে একবেলা খেলে,আরেক বেলা অনাহারে কাটাতে হয়।সেখানে পড়াশোনা বিলাসীতা ছাড়া আর কি।


একবার কাজের ছুটিতে বাড়ি ফিরছে এলাকার যুবক রতন মিয়া। পথে রতন মিয়ার রোকেয়ার সঙ্গে দেখা । রতন মিয়া রোকেয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করে,কিরে রোকেয়া কেমন আছিস ? এলোমেলো চুল, শুকনো মুখ নিয়ে রোকেয়া দাড়িয়ে থাকে কাটফাটা রোদে আর চেয়ে চেয়ে দেখে রতন মিয়ার স্বচ্ছল চেহারাটা, চকচকে উজ্জ্বল পোশাক আশাক।


অতঃপর রতন মিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয় সে। রতন মিয়াকে দেখে রোকেয়ার মনে ও পুলক জাগে। তার ধীর স্থির চোখ দুটি হটাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। স্বপ্ন দেখে রতনের মতো সেও শহরে যাবে, কাজ করে টাকা পাঠাবে। রতন মিয়ার পরিবারের মতো তার পরিবার ও স্বচ্ছল জীবন যাপন করবে। এক সন্ধ্যায় রতন মিয়া সহ শহরে কাজ করা যুবকেরা টং এর দোকানে চা খায় আর তাদের কাজ নিয়ে গল্প করে। সেখানে রোকেয়ার বাবাও বসেছিল।


মানুষটার আফসোস, রোকেয়া যদি তার বড় মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো। সেও শহরে কাজে পাঠাতো। তার সব অভাব মিটে যেত। তবে তার আফসোসের মাঝে আশা জাগায় যুবক ছেলে গুলো। তারা রোকেয়ার বাবাকে বোঝায়, যে পোশাক কারখানায় তারা কাজ করে। সেখানে মেয়েদের কাজের অনেক সুযোগ আছে। রোকেয়ার মত হাজার হাজার নারী শ্রমিক কাজ করে সেখানে। তারপর ছেলে গুলো রোকেয়ার কাজের ব্যবস্থা করে। স্বচ্ছল ভবিষ্যতের আশায় রোকেয়াও শহরে পারি জমায় এলাকার ছেলেপুলেদের সঙ্গে একটু ভালো থাকার আশায় ।


ছেলেগুলো অল্প খরচে একটা বস্তিতে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। লম্বা সরু একটা গলি। চারপাশে আবর্জনার স্তুপ, কুকুর,বিড়াল,কাক লুটেপুটে খাচ্ছে। রাস্তার মানুষ যাওয়ার সময় নাকে হাত দিয়ে এই পথ চলে।অন্ধকার ছোট একটি কামরায় থাকে রোকেয়া। শীর্ন দেয়াল, স্যাতস্যাতে মেঝে আর ক্লাসরুমের বেঞ্চের মত সরু বিছানা। তবে এসব নিয়ে রোকেয়ার মাথাব্যাথা নেই। কারন তার এখন একমাত্র লক্ষ্য পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা । তবে রোকেয়া যে বেতন পায় তা দিয়ে থাকা খাওয়ার খরচ মিটিয়ে আবার সংসারের ভার কাধে নেওয়াটা বেশ কঠিন। 


কিছুদিন পর রোকেয়া যে বাড়িটিতে থাকে সে বাড়ির মালিক আবেদ আলী রোকেয়ার পারিবারিক অবস্থা জানতে পারে। তাই আরো স্বচ্ছল জীবন যাপনের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশে একটি ভাল কাজ, বেশ ভাল বেতনের এমন একটি প্রস্তাব রোকেয়াকে দেয় সে। রোকেয়া কি কাজ জানতে চাইলে সে বলে, অনেক ভাল কাজ গেলেই দেখতে পাবি। 


রোকেয়ার মনে পড়ে যায় অনাহারে থাকা ছোট ভাইগুলোর শুকনো মুখগুলো।সব কিছু নিয়ে কয়েকদিন ভাবে সে, কিছুটা ভেবে বাড়ির মালিক আবেদ আলীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় রোকেয়া। কিছু দিনের মধ্যেই পোশাক কারখানার কাজ ছেড়ে দেয় সে ।কাজে গেলে নিয়মিত রতন মিয়ার সাথে কারখানায় দেখা হতো রোকেয়ার। কয়েকদিন যাবত রোকেয়ার দেখা নেই। রতনের একটু চিন্তা হলো। মেয়েটা এই শহরে নতুন। অসুখ-বিসুখ কিছু হয়নি তো আবার। হাসনা এই কারখানারই কর্মী । রোকেয়ার বেশ ঘনিষ্ট ছিলো মেয়েটি ,তাই রতন মিয়া হাসনাকে রোকেয়ার কথা জিজ্ঞেস করল । হাসনা উত্তরে বললো, রোকেয়া হেই কবে কাম ছাইড়া দিছে। রতন মিয়া ভাবলো রোকেয়া হয়তো অন্য কোথাও এর চেয়ে ভাল কাজ পেয়েছে। তাই হাসনার কথা শুনে আর কিছু বলল না রতন।


তারপর সবকিছু গুছিয়ে ভাগ্য বদলের সন্ধানে রোকেয়া পাড়ি দেয় ভৌগোলিক সীমানা। আবেদ আলী তাকে নিয়ে রাখলো একটি তিনতলা বাড়িতে। প্রথমে ঢুকতেই রোকেয়ার কেমন সন্দেহ হচ্ছিল। অন্ধকার একটি গলি। আশেপাশে মানুষের বসতি ও আনাগোনা কম, অনেক দূরে দূরে কয়েকটা বাড়ি। গলির ভেতরে এবং বাড়িটিতে অনেক যুবতী মেয়ে তার বয়সের। কিছু কিছু রুমে অনেক জোরে গান বাজছে। প্রথমে রোকেয়া ভেবেছিলো হয়তো এখানে কারো বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠান। মেয়েগুলো রোকেয়াকে আড় চোখে দেখে আর হাসে।


এখানে গুটি কয়েক পুরুষ মানুষও আছে। তবে তাদের আচারনগুলো একটু কেমন কেমন যেনো লাগলো রোকেয়ার। আবেদআলী একটি মহিলার রুমে ঢুকালো রোকেয়াকে নিয়ে । তার সাথে কি যেন গোপন আলোচনা করলো। তারপর রোকেয়াকে বলল আজকে তুই এই ম্যাডামের কাছে থাকবি। কালকে কাজে জয়েন করবি। ম্যাডামকে তুই মাসি বলে ডাকবি। মহিলাটি বেশ সাজুগুজু করেছে। দেখে মনে হয় বেশ রাগি মহিলা। 


এরপর আশেপাশে সকলের চালচলন এবং তাদের মাসির অসভ্য আচরনে রোকেয়ার কাছে সব স্পষ্ট হয়ে যায়। রোকেয়ার দুচোখ অন্ধকার হয়ে আসে। ঐ স্বাপ্নালু দুচোখে যে বর্ণিল স্বপ্ন সে দেখেছিল। তা আজ পরিনত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। 


বন্ধ ঘরে আটকে রাখা হয়েছে রোকেয়াকে। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে সারাদিন চোখের পানি ফেলে আর দূর আকাশে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ানো পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর মুক্তির প্রার্থনা করে,এই বন্দিশালা থেকে। অনেকবার পালিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্ত পারেনি। বাড়িতে ফোন দিতে চেয়েও পারেনি। উল্টো মাসির হাতে মার খেয়েছে। মাসি তাকে সোজা বলে দেয় এই ছোরি, তোর মালিক তোকে দিয়ে দেড় লাখ টাকা নিয়েছে। যেতে হলে আমার টাকা দিয়ে তারপর যাবি।


অজপাড়াগায়ের সহজ সরল এই মেয়েটি হিসাব মিলাতে পারে না কিছুতেই। সব হিসাব গুলিয়ে যায় তার বসে বসে ভাবে, মানুষকি কখনো কেনাবেচা হয়? নিজের শরীলটাকে কি বিক্রি করা যায়?এভাবে বিলিয়ে দেওয়া যায় নরপুরুষদের কাছে ? স্বচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে আজ সে একজন পতিতা।এসব ভেবে নিজের প্রতি অনেক ঘৃণা জন্মে রোকেয়ার।


এভাবেই অমানবিক নির্যাতনের মধ্যে কাটতে থাকে রোকেয়ার দিনগুলো। কুকুর বিড়ালের মত লুটেপুটে খাচ্ছে নিঃষ্পাপ দেহটাকে। তবে এখানে অনেক মেয়ে আছে রোকেয়ার মতো যারা স্বেচ্ছায় এখানে আসেনি। এমন করে কেটে যায় ছয় মাস। হঠাৎ একদিন খুব চিৎকার চেচামেচি শুনা যায় বাহিরে। মেয়েরা সবাই হুড়োহুড়ি করে পালাচ্ছে। মাসি এমন ছুটোছুটি লাগিয়েছে পালানো কোনো নিরাপদ জায়গা যেন সে খুজেই পাচ্ছে না। এরই মধ্যে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো পুলিশ । মাসি এবং আরো কিছু দালালকে গ্রেপ্তার করা হলো। আর সকল মেয়েদের পুলিশি হেফায়জতে রাখা হলো । মহিলা পুলিশ অফিসার সীমানা চ্যাটার্জিকে দেখে মনে হয় বেশ রাগী।কিন্তু উপরের ঐ রাগী চেহারাটার পিছনে অনেক মায়া লুকিয়ে। এক অবসরে সব মেয়েদের কথাগুলো শুনেন তিনি।


রোকেয়া তার সব কথা খুলে বলে সীনামা চ্যাটার্জিকে। অবশেষে বন্দিশালা থেকে মুক্তি মেলে রোকেয়ার ।সীমানা চ্যাটার্জি রোকেয়াকে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। কাজটি অনেক মহৎ । রোকেয়ার এখন একজন এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। বেশ ভালোই আছে । মাঝে মাঝে পরিবারের কথা মনে করে চোখের জল ফেলে । আর ভাবে,তার বাবা-মা হয়তো তাকে নিয়ে চিন্তা করে আর চোখের পানি ফেলে ফেলে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে রোকেয়া স্বপ্ন দেখে অতিশীঘ্রই দেশে ফিরবে সে। আর বাবা-মাকে বলবে যে গোলাপের মতো সুগন্ধময় জীবনের স্বপ্ন সে দেখত, সে স্বপ্ন আজ বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে । অনেক চড়াই উতড়াই পেরিয়ে পেরেছে স্বাবলম্বি হয়ে, স্বচ্ছলতা অর্জন করতে।