বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর ভাববাদের ধারণা
দর্শন শাস্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার কিছুকাল পর প্লেটোর মাধ্যমে ভাববাদ দর্শনের যাত্রা শুরু করে। দর্শনের ইতিহাসে যে দুইটি মতবাদ নিয়ে আলোচনা হয় তার প্রথমটি হল ভাববাদ অন্যটি হল বাস্তুবাদ। আমরা এই পর্বে ভাববাদ নিয়ে আলোচনা করবো। শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থাকুন।

এই আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আমাদের মাথায় যে প্রশ্নটি আসে, সেটি হলো ভাববাদ দর্শন কী?
এক কথায় ভাববাদ বলতে আত্নার বা পরমাত্নার সার্বজনীনতা কে বোঝায়। এই বিশ্বজগতের মূলে রয়েছে পরমাত্না বা পরম মন (পরম চেতনা)। পরমাত্না দ্বারা এই জগতের সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়।
পরমাত্না এই জগত সংসারের সৃষ্টি ও ধ্বংসের পেছনে কাজ করে। এখানে পরমাত্না বা পরম চেতনাই সত্তা। সকল কিছুর অস্তিত্বর মূলে আছে পরমাত্না। আর এই পরমাত্না থেকে চেতনার উৎসারিত হয় ।
তাই ভাববাদীরা বিশ্বাস করেন, জগৎ ও জীবনের সমস্ত কিছু পরমাত্না দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে আমরা আলোচনা করবো গ্রীক ভাববাদ দর্শনের মূল বিষয় বস্তু।
আমি কে? আমি যে চিন্তা করি, তার উৎস কোথায়? কে আমায় পরিচালিত করছে? এই জগৎ সংসারের চালিকাশক্তি কোথায়? এই সকল প্রশ্ন নিয়ে যখন মানুষের মনে ভাবনার সৃষ্টি হলো, তখন তারা খুঁজতে থাকলো সেগুলোর উত্তর। এবং এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে একেক জন একেক উত্তর খুঁজে পায়। এই একই প্রশ্নের ভিন্ন উত্তরের জন্য তৈরি হয় দার্শনিকদের একেকটি দল।
তখন তাদের মধ্যে একদল বললো, “দেহ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে না, আত্মা হল আমাদের নিয়ন্ত্রক। এই আত্না কোন বস্তু নয় বরং তা অবস্তুগত একটি শক্তি। এই অবস্তুগত আত্মা আমাদের দেহের মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাস করে।
আমাদের দেহের মৃত্যুর ঘটে কিন্তু এই চালিকা শক্তির(আত্মা) কখনো মৃত্যু ঘটে না। আমাদের দেহের বিনাশ ঘটার সাথে আত্মার বিনাশ ঘটে না, বরং আত্মার স্থানান্তরিত ঘটে।
মস্তিস্ক ধ্বংস হওয়ার মধ্যে দেহের মৃত্যু ঘটে কিন্তু এই মস্তিকের মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের চেতনার বা আত্মার মৃত্যু হয় না। এই আত্মা অন্য এক শক্তিতে রুপান্তর হয়। সেই রুপান্তরকে বলা যায় পরমাত্মা বা ঈশ্বর”।
ভাববাদী মতবাদ অনুসারে, জগৎ সংসারে সকল অস্তিত্বের মূল উপাদান হলো পরমাত্মা, পরম চেতনা বা পরম মন। ভাববাদীদের মতে জগতের সব কিছু পরমাত্মার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু পরমাত্মা একমাত্র স্বনির্ভর।
তাই জগতের সকল কিছু যেমন: বস্তু, স্থান, কাল, জীবন, শক্তি ইত্যাদি পরমাত্মার উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও ভাববাদী তত্ত্বে বলা হয়, পরমাত্মা দ্বারা বস্তু জগতের সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ বস্তুর ধ্বংস ও সৃষ্টি পরমাত্মার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত।
ভাববাদে বস্তু ও শক্তি কে আলাদা দুটি জিনিস হিসেবে দেখানো হয়েছে। ভাববাদীরা মনে করেন, বস্তু জড় বিশেষ হলেও শক্তি জড় বিশেষ নয় বরং শক্তি অবস্তুগত একটি জিনিস। বস্তুর উপর যখন শক্তির ক্রিয়া ঘটে সেই সময় বস্তু সক্রিয় হয়ে উঠে।
তাই বস্তু ও শক্তিকে ভাববাদীরা দুটি আলাদা বস্তু হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ভাববাদীরা বস্তুর পরিবর্তনশীলতায় মনে করে যে, জগতের সমস্ত বস্তু জড় অস্তিত্ব বিশিষ্ট হওয়ায়, বস্তু জগতের মধ্যে পরিমাণগত পরিবর্তনশীল হলেও তা গুনগত ভাবে ঠিকই থাকে অর্থাৎ বস্তু গুনগত ভাবে অপরিবর্তনীয় থাকে।
এই ভাববাদী দার্শনিকদের আবার বুদ্ধিবাদী দার্শনিকও বলা হয়। মানুষ বুদ্ধি ও চিন্তার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা ধারণ করতে পারে। চিন্তা ছাড়া বস্তুর অস্তিত্ব নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তাই বস্তু জগৎ তৈরি হয় চেতনার মাধ্যমে। আমরা যে জগৎ সংসারে আছি, তা মূলত আমাদের ভাব জগতের একটি বাহ্যিকরূপ।
বুদ্ধি হলো চেতন সত্তার একটি রূপ, আবার চেতন সত্তা সার্বিক চেতন সত্তার উপর নির্ভর করে থাকে। তাই যে জগতকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা মূলত ভাব জগতের একটি রূপ।
বস্তু জগৎ সম্পর্কে প্লেটো বলেছেন যে, “বস্তুজগতের সমস্ত বস্তু সত্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বস্তুর প্রকৃত সত্তা শুধুমাত্র ভাব জগতে বিদ্যমান।”
যেমন: একজন মানুষের প্রকৃত সত্তা ভাব জগতে বিদ্যমান কিন্তু যাকে দেখতে পাচ্ছি সেই ব্যক্তি ঐ ভাবজগতের মানুষটির বিকৃত রুপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবে প্লেটো এর মাধ্যমে ভাববাদী দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভাববাদী দার্শনি প্লেটো তার বিখ্যাত গ্রন্থ রিপাবলিক ওফ ডায়ালগে যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, আত্মা অমর ও অবিনশ্বর। দেহের মৃত্যুর সাথে আত্মা দেহকে ত্যাগ করে অমর বা অবিনশ্বর জগতে প্রবেশ করে।
আত্মার যে অবিনশ্বর সেই সম্পর্কে সক্রেটিসও বলেছেন। তিনি বলেছেন, “ মানুষকে যখন মৃত্যু আক্রমণ করে, তখন মানুষের দেহে নশ্বর অংশের মৃত্যু হলেও দেহের ভেতরের অবিনশ্বর অংশের মৃত্যু ঘটে না। বরং সেই অবিনশ্বর অংশ, দেহে মৃত্যুর আগমনে দেহকে ত্যাগ করে পরমাত্মায় রুপান্তিরত হয়”।
সক্রেটিস বলেন, আত্মা ও দেহ যখন একে অপরের সাথে মিলিত হয় তখন প্রকৃতির নিয়ম অনু্যায়ী আত্মা হয়ে যায় শাসক ও দেহ হয়ে যায় শাসিত। অন্য একটি জায়গায় সক্রেটিস বলেছেন, “আত্মা যেহেতু শাসক, তাই সে ঈশ্বর”।
তিনি দেহ কে নশ্বরের সাথে তুলনা করেছেন। এছাড়া তিনি আত্মাকে বুদ্ধিমান ও ঐশ্বরিক এবং অপরিবর্তনীয়তায় স্বীকার করে দেহকে মরণশীল, মানবিক, পরিবর্তনীয় বলেছেন।
ভাববাদী দর্শনে জ্ঞান অর্জন ও বিশ্বাস স্থাপন করার উপায়:
প্লেটো তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘কখনো চোখ, কান ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করবেন না। ইন্দ্রিয়ের মোহজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজেদের নিজের জ্ঞানের ওপর নির্ভর হতে নিষেধ করেন। কারণ ওরা প্রতারক।
এজন্য নিজের পবিত্র সত্তার ভেতর আসা উচিৎ। এবং নিজের উপর বিশ্বাস দৃঢ় করা উচিৎ। নিজের আপন উপলদ্ধিই বিশুদ্ধ জ্ঞান। তাই অন্য উপায়ে নিজেদের অর্জিত জ্ঞানকে বিশ্বাস করা যাবে না। কেননা তারা দৃশ্য ও স্পর্শ আর স্বীয় সত্তার উপলদ্ধি তাদের বিপরীত অদৃশ্য এবং তা স্পর্শ করা যায় না।
প্লেটোর বক্তব্য থেকে আরো স্পষ্টভাবে জানতে পারি যে, আত্মা মানুষের দেহের মধ্যে ধারণ করার আগেও বিদ্যমান ছিল। এবং আত্মা দেহহীন থাকা অবস্থায়ই জ্ঞান অর্জন করেছে। এভাবে আত্মা পূর্ব থেকেই বিদ্যমান। আত্মা দেহে প্রবেশের পর যখন আবার সেই দেহে মৃত্যু প্রবেশ করবে তখন আত্মা দেহ ত্যাগ করবে। কারণ সে পরমাত্মা বা ঈশ্বর।
ধর্মীয় শ্রেনীর ভাববাদীদের মতে আত্মার অমরত্বের সংজ্ঞা: ”যেহেতু আত্মা অমর, তাই দেহের মৃত্যুর পর আত্মা তার পূর্বের কাজের জন্য শাস্তি বা পুরস্কার হিসেবে স্বর্গ বা নরকে অবস্থান করবে”।
এছাড়াও বাস্তব মানুষের জীবন অনেকটা স্বপ্নের মতো। বাস্তব জীবনের পর আরেকটি জীবন আছে। সেই জীবন হলো পরকালের জীবন। তাই ঐ জীবনের লক্ষ্যে কর্ম সম্পাদন করা একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য সেই জীবনের জন্য অর্থাৎ পরকালের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেতে হবে।
বৈজ্ঞানিক ভাবে মানুষের সকল সামাজিক কাজের সমস্যার কার্য কারণ নিয়ন্ত্রণ বা সমাধান করা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় আবার কিছু ক্ষেত্রে যায় না। ভাববাদীদের আচরণ অনেকটা মৌলবাদীর মতো। কারণ তারা ধর্মনীতি ও মৌলিক নীতিগুলো পরিবর্তন করতে চায় না।
ভাববাদের একেকটি বিষয়কে এভাবে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দার্শনিকগণ স্বীকার করে, আবার অন্য জিনিসগুলোকে অস্বীকার করে ভাববাদের নতুন শাখার জন্ম দিয়েছেন।
আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কিছু নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সবসময় শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।