বৃষ্টির জলে হারানো মনঃ একটি ছোট গল্প
আবিরের চলে যাওয়ার পর চারুর ঘড়ি আবার তাকে ঘরে ফেরার তাগিদ দিতে লাগলো। সে বাইরে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। চারু গুটিগুটি বৃষ্টি মাথায় রেখেই পা বাড়ালো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

বাইরের অদ্ভুত সুন্দর বৃষ্টি দেখে যখন পুরো ক্লাস বৃষ্টির গানে মেতে উঠেছিলো, চারুর ঘড়ি তখন বারবার তাকে তাগিদ দিচ্ছিলো ঘরে ফেরার। আজ সে তার ছোট মামাতো ভাই ইফাজ কে কথা দিয়েছিলো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে।
গ্রাম থেকে চট্টগ্রামে আসে সে পড়ার সুবাদেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম আসার পর সে যখন বারবার করে বলেছিলো তার শহর আর মা-বাবা কে ছেড়ে এখানে সে আসবেনা, তখনই তার মামা যত রাগ অভিমান আছে সব তাকে দেখিয়ে শেষমেষ এখানে নিয়েই এলো।
ভার্সিটিতে আজ তার পঞ্চম দিন। ক্লাসের প্রায় সবার ই আগের পরিচিত বন্ধু বান্ধব থাকলেও তার পূর্ব পরিচিত কেউই নেই এখানে। এখনো পর্যন্ত কারো সাথে ঠিক করে তার কথাও হয়নি।
মফস্বল থেকে বড় শহরে পড়তে আসা মানুষদের এই এক সমস্যা। তারা সহজে বড় শহরের মানুষদের সাথে মিশতে পারে না, তাদের মত করে কথা বলতে পারেনা। প্রায় সময় আবার দেখা যায়, তারা বড় শহরের মানুষদের কাছে হাসির পাত্র হয়ে উঠেছে। তাই চারু খুব সাবধানে কথা বলে তার ক্লাসের ছেলে মেয়েদের সাথে। খুব একটা প্রয়োজন না হলে সে আবার কথাও বলেনা।
ক্লাসের সবাই যখন বৃষ্টির গানে মেতে উঠছিলো আরো গভীরভাবে চারু তখন বাইরের বৃষ্টিতে মন ভেজাচ্ছিলো মুগ্ধ হয়ে। ঝুম বৃষ্টিতে বাইরের সব কিছু অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিলো তার কাছে। তার মনে হলো বৃষ্টির ছোঁয়ায় যেন সবকিছু নতুন করে সেজেছে আজ। দূরের পাহাড়, ঘন গাছপালা, আর পিঁচঢালা কুচকুচে কালো পথটাও যেন আজ নতুন রুপে মুগ্ধ করছে তাকে।
মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিলো, বৃষ্টির ফোঁটা গুলো যেন হালকা ধূসর রঙের দেখাচ্ছে। এর আগে সে অনেকবার ভালোভাবে বৃষ্টি দেখলেও কখনো বৃষ্টির ফোঁটা তার কাছে ধুসর দেখায়নি। আজই সে প্রথম এ ব্যাপারটা লক্ষ করলো।
আগে সে অনেকের কাছে শুনেছিলো চবি নাকি সৌন্দর্যের লীলাভূমি। তখন সে এই কথা এতটা বিশ্বাস না করলেও আজকাল সে এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এখানকার দু'পাশে পাহাড়ের মাঝে বয়ে চলা রাস্তা গুলো যেমন তাকে প্রকৃতির প্রতি বারবার প্রেমে পড়াচ্ছে, তেমনই এখানকার শাটল ট্রেন রোজ তাকে মায়ায় ফেলছে এক অজানা ভালোলাগার। আর আজ সে বৃষ্টিভেজা চবির আরেক নতুন সৌন্দর্যের সাথে পরিচিত হলো।
চারু যখন চবির সৌন্দর্যের গভীরে হারিয়ে যাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো এক পরিচিত কণ্ঠে একটি পরিচিত গান। সেই গান যে গান সে আজ থেকে চার বছর আগে তার স্কুলের এক সিনিয়র ভাইয়ার গলায় শুনেছিলো। চারু কৌতুহল নিয়ে আশেপাশে খুজেও যখন সে কণ্ঠের উৎস পেলোনা তখনই সে বুঝতে পারলো এ গানের উৎস ক্লাসের বাইরের করিড়োর। সে তখন ছুটে চলে যায় সেখানে। গিয়েই সে অবাক হয়ে যায় সেই চেনা মুখ দেখে। আজ থেকে চার বছর আগে সে যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তো তখনই সে প্রথম আবির কে দেখে। সেদিনও ঠিক আজকের মত এক ঘোর বর্ষার দিন ছিলো। সেদিনও আবিরের কণ্ঠে এই বৃষ্টির গান ছিলো। শুধু তফাৎ, সেদিন তার হাত ছোঁয়নি কোনো গীটারের তার।
এত বড় ক্যাম্পাসে এতগুলো অপরিচিদের ভীড়ে একটি চেনা মুখ যেন স্বস্তির ছোঁয়া দিলো চারুর মনে। সে আবির কে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে, তার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছে এই ভেবে যে, অন্তত একজন কে তো সে চিনে।
চারু আবির কে কি বলবে মনে মনে তা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলো আবিরের কাছে। আট-দশেক ছেলেমেয়ের ভীড়ে থাকা আবিরের কিছুটা কাছে গিয়ে চারু যখনই কথা বলবে ঠিক করলো তখনই সে দ্ধিধায় পড়ে গেলো কি বলে কথা শুরু করবে এই নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে মনে মনে ভেবে নেয়া সব কথা সে গুলিয়ে ফেললো। নিজের উপর তার প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো।
সে ভাবতে লাগলো, বিধাতা শুধু তাকেই কেন সব কিছুতে কম কম দিয়েছে। কেন অন্য সবার মত সে সবার সাথে খোলাখুলি ভাবে কথা বলতে পারেনা। গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা। কেন সে একটা কথা বলতে গেলে আগে থেকে ভেবে রাখতে হয়। কেন!
চারু যখন এসব ভেবে নিজের উপর জমতে থাকা রাগদের আরো বাড়তে দিচ্ছিলো তখনই চারুকে অবাক করে দিয়ে আবির ওর সামনে এসে দাড়ালো। আবির কে দেখে চারু তার মনে জমানো রাগদের ভুলে গিয়ে যখনই ভাবলো, কোনো কিছু একটা বলে সে এবার কথা শুরু করবে তখনই চারুর কথা বলায় বাঁধা দিয়ে আবির বলে উঠলো,
-- এখনো তাহলে অবাক হলে হা করে থাকো?
আবিরের কথা শুনে চারু কিছুটা অবাক হলেও তাকে তা বুঝতে না দিয়ে এবার সে বলে উঠলো,
-- কখনো তো জানতাম না কেউ আমার হা করে অবাক হওয়ার বিষয় টা নোটিশ করতো, যদি জানতাম তাহলে হা করে তাকানোর বদ অভ্যেসটা ভুলে যেতাম।
চারুর কথা শুনে আবির এবার হো হো করে হেসে উঠে বললো,
-- হা করে তাকানোটাও একটা আর্ট চারু। যা সবাই পারেনা।
-- তাহলে এখনো সব কিছুতে বুঝি আর্ট খুঁজেন আবির ভাই?
-- আমি যে সব কিছুতে আর্ট খুঁজি তাও যে একজন নোটিশ করতো তা যদি আগে জানতাম তাহলে আমিও সবকিছুতে আর্ট খোঁজা বন্ধ করে দিতাম।
কথাটা বলেই আবির মুখে এক দুষ্টুমির ভাব নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো চারুর দিকে। চারু প্রথমে কথাটার মানে না বুঝলেও পরে বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- আমার কথা আমাকেই ফেরত দিলেন বুঝি।
আবির চারুকে লজ্জা পেতে দেখে ভাবতে লাগলো, এখানে লজ্জা পাওয়া কি আছে। আবির যখন চারুর লজ্জা পাওয়ার বিষয় টা খুঁজতে যাচ্ছিলো তখনই আবিরের বন্ধুর ডাকে তার ভাবনায় ছেদ পড়লো। আবির চারু কে বিদায় জানিয়ে সিড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় চলে গেলো কাঁধে সেই গাঢ় মেরুন রঙের গীটার ঝুলিয়ে।
আবিরের চলে যাওয়ার পর চারুর ঘড়ি আবার তাকে ঘরে ফেরার তাগিদ দিতে লাগলো। সে বাইরে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। চারু গুটিগুটি বৃষ্টি মাথায় রেখেই পা বাড়ালো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
চারু ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আয়তনে অনেক বড় হওয়ায় এখানকার এক ফ্যাকাল্টি থেকে অন্য ফ্যাকাল্টি দেখা যায়না। এক ফ্যাকাল্টি ছেড়ে অন্য ফ্যাকাল্টির রাস্তা যেমন আলাদা তেমন দেখতেও মনে হয়, যেন পুরো ভার্সিটি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা ভার্সিটি।
চারু ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে অটো করে জিরো পয়েন্ট চলে আসে। এসেই জানতে পারে শাটল আসবে ২.৩০ এ। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে মাত্র ২ টা বাজে। আরো আধ ঘন্টা তাকে এভাবে একা বসে থাকতে হবে ভাবতেই তার পুরো শরীর জুড়ে কেমন যেন ভয় নেমে এলো।
একরাশ ক্লান্তি আর নিরাশা নিয়ে সে স্টেশনে বসে পড়লো। মনে মনে এখানে বসে থাকতে কিছুটা ভয় হলেও তার চোখ বারবার ঘড়ির কাটার বয়ে চলাই দেখছিলো। কিন্তু সময় যেন তার নিজ নিয়মে চলছেনা। চারুর মনে হলো সে তাকাচ্ছে বলেই ঘড়ি আরো আস্তে আস্তে চলছে। সে সিদ্ধান্ত নিলো সে আর বারবার ঘড়ির দিকে তাকাবেনা।
এবার চারু ঘড়ির দিক থেকে নজর সরিয়ে আশেপাশে বসে থাকা ছেলে মেয়েগুলো কে দেখলো। সবাই কত সহজেই একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে।
সে ভাবতে লাগলো, সবাই এতো সহজে কি করে বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে নেয়। সে কেন পারেনা। সবার বন্ধুত্ত দেখে হঠাৎ করে তার কেন যেন কষ্ট হতে লাগলো। মনে মনে ক্লাসের সবার উপর রাগ হলো, তারা তার সাথে এখনো পর্যন্ত কথা বলেনি বলে। চারু যখনই তার ক্লাসের সবার উপর অহেতুক রাগদের বাড়াচ্ছিলো তখনই সেখানে আবির আর তার কিছু বন্ধুবান্ধব এসে হাজির হয়। আবিরকে দেখে চারু তার রাগদের ভুলে গিয়ে এবার মনে সাহস ফিরিয়ে আনলো। সে বারবার আবিরের দিকে তাকাচ্ছিলো। ভেবেছিলো আবির ওকে দেখলেই সে উঠে গিয়ে কথা বলবে।
কিন্তু আবির তার বন্ধুদের সাথে কি নিয়ে কথা বলতেই যেন ব্যাস্ত। আশেপাশে কারো উপরই তার নজর নেই। আবির দেখবে এ আশায় মিনিট দশেক বসে থাকার পর চারু এবার নিজে গিয়েই হাজির হলো আবিরের সামনে। চারুকে দেখে আবির অবাক হয়ে বললো,
-- এখনো বাসায় যাওনি?
-- নাহ।
কথাটা বলেই চারু অসহায়ের মত দাড়িয়ে রইলো আবিরের সামনে। চারুর এমন ভাব দেখে আবির ওকে বললো,
-- অকে এক সাথে যাবো। আর কিছুক্ষণ পরই শাটল চলে আসবে।
চারুকে একপ্রকার অভয় দিয়েই আবির আবার তার বন্ধুদের সাথে আগের কথায় ফিরে গেলো।
আর অন্যদিকে আবিরের কথা শুনে চারুর মনে এবার প্রশান্তি ফিরে এলো। সে নির্ভয়ে আবিরের পাশে দাড়িয়ে শাটলের অপেক্ষা করতে লাগলো।
বৃষ্টিরা আবার একটু একটু করে বেড়ে যেতে লাগলো। এবারের বৃষ্টিটা কেমন যেন একটানা ঝরেই যাচ্ছে কয়দিন ধরে। শুরু হলে আর থামার নাম নেয়না।
চারু আবিরের পাশে দাড়িয়ে বিন্দু বিন্দু করে ঝরে পড়া বৃষ্টিদের দেখে যাচ্ছিলো আপন মনে। তার আবার মনে হচ্ছিলো এ বৃষ্টি যেন ধূসর রঙে সেজেছে আজ। আর সাথে সাজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এ পৃথিবীকে। সে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বৃষ্টি জলে হারিয়ে যেতে লাগলো আনমনে।