বৈপরিত্যের কলমঃ ছোট গল্পকার মঁপাসা
বিখ্যাত ছোট গল্পকার মঁপাসার ওপর লেখা

আঠারো বছর বছর বয়সে সেই সময়ের অন্যতম বিখ্যাত কবি সুইনবার্নকে জলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচান। অথচ নিজেই দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। একবার নিজের বন্দুক দিয়েই নিজেকে গুলি করেন আরেকবার ছুরি দিয়ে গলা কেটে নেন। বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর প্রথম বোর্ডিং স্কুল থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, অথচ দ্বিতীয় স্কুলে ভর্তি হয়েই ক্লাসে র্যাঙ্ক করেত থাকেন।
ভালো ভাবে পড়াশোনা করলেও মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে নেভিতে কাজে যোগ দেন। অবসর সময়ে নৌকায় ভ্রমণ করে সময় কাটাতেন। পরে নিজেই কিনে নেন ছোট একটি নৌকা, নাম রাখেন নিজের প্রকাশিত দ্বিতীয় উপন্যাসের নামে, ‘বেল আমি’।
মৃত্যুর আগে শেষ আঠারো মাস থাকতে হয়ে ছিল স্যানিটেরিয়ামে, আবার নিজেই লিখে রাখেন নিজের এপিটাফ, ‘I have coveted everything and taken pleasure in nothing.’ লিখে বেশ ভালোই রোজগার করতেন কিন্তু নিজে সময় পেলেই চলে যেতেন শহরের সব থেকে কম দামি রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে। ঠিক আমি বলছি বিশ্ব সাহিত্যেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকার হেনরী রেনে এলবার্ট গঁ দ্য মঁপাসার কথা, পরবর্তীকালে যিনি অবশ্য জোসেপ প্রুনিয়ার, গায় দ্য ভালমন্ট এবং মৌফ্রিগনিউস ছদ্ম নামেও লিখেছেন, যদিও শেষের নামটি মাত্র চার বছর ব্যবহার করেছেন।
নেলসন ম্যান্ডেলাঃ যিনি জীবন্ত কিংবদন্তীর রাষ্ট্রনায়ক
সারাটা জীবন অসংখ্য অদ্ভুত সব বৈপরীত্য দেখা যায়। হয়ত এই কারণেই তাঁকে নিয়ে পরবর্তী কালে প্রবন্ধ লিখে ফেলেন স্বয়ং লিও টলস্টয়,গল্প লেখেন উইলিয়াম সারোইম, এমন কি তাঁর লেখা ‘নেকলেশ’ গল্প অবলম্বনে পরবর্তী কালে অন্যতম আরেক শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকার সমারসেট মম,‘মিস্টার নো অল’ নামে এবং হেনরী জেমস, ‘পেস্ট’ নামে একটি গল্প লেখেন, তাঁর ‘লা হোরলা’ গল্প অবলম্বনে ‘অশরীরী’ নামে একটি গল্প লেখেন বাংলার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
আত্মীয়ের থেকেও তাঁকে ভালোবাসতেন ‘ম্যাডাম বোভারী’ উপন্যাসের লেখক গুস্তাভ ফ্লুভার্ট। নিজে আলাপ করিয়ে দেন এমিলি জোলা, এবং রাসিয়ান উপন্যাসিক ইভান টার্জিনেভের সাথে। আবার সাহিত্যের জগতে প্রবেশের পিছনে লেখক বালজাকের ভূমিকা ছিল। আসলে সারাটা জীবন তিনি জীবনকেই বিভিন্ন ভাবে খুঁজে গেছেন, আর হয়ত সেকারণেই বিভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, তার ফল যে সব সময় ভালো হয়েছে তা নয়, কিন্তু খুঁজে পেয়েছেন এক অন্য রকমের ন্যাচারালিজম পরবর্তীকালে তাকেই আবার স্কোপেহরিয়ান অ্যানথ্রোপোলোজিকাল পেসিমিসিম বলা হয়েছে।
বলা হয় ফ্রাঙ্কো প্রুসিয়ান ওয়ার ও তৎপরবর্তীকালের সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর গল্পে বার বার উঠে এসেছে। তাঁর সাহিত্য জীবন খুব বেশি দিনের নয়, মাত্র দশ বছরের, অথচ এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি লিখে ফেলেন,প্রায় তিনশর বেশি ছোট গল্প, দুটি উপন্যাস, তিনটি ভ্রমণ সংক্রান্ত বই এবং একটি কবিতার বই। ‘আলা ফিউলি ডি রোস’ নামে একটি কমেডিও লেখেন, এবং সেখানে অভিনয়ও করেন। শোনা যায় কবিতার বইটি নিয়ে সমস্যাতে পড়েছিলেন। ‘দেস ভার্স’ নামে এই কাব্য সংকলেনে কুড়িটি কবিতা ছিল।
শোনা যায় তাদের মধ্যে কয়েকটি কবিতার জন্য তাঁকে জেলে পাঠানোর ভয়ও দেখানো হয়। আবার আইফেল তৈরীর বিরুদ্ধে অন্য অনেক বুদ্বিজীবিদের সাথে নিজেও মিনিস্টার অব পাবলিক ওয়ার্কসে চিঠিও লেখেন। আসলে মঁপসা মানেই বৈপরীত্য, মঁপসা মানেই চমক। ছোটবেলাতে জীবনে মায়ের প্রভাব ছিল খুব।
মঁমসার মা শেক্সপিয়র সহ সেই সময়কার অনেক সাহিত্যিকের লেখা পড়তেন। ছোট বেলাতেই মায়ের থেকে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। আবার ঘনিষ্ট মহলে বলেন, ‘মাকেই তিনি সব থেকে হিংসা করতেন। ’ সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ যদি মায়ের থেকে পেয়ে থাকেন বলা যায় অতিরিক্ত মহিলাদের সঙ্গে মেলামেশা করবার পরম্পরা বাবার থেকেই পান। বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছিন্ন হবার প্রধান কারণই নাকি বাবার বিবাহ বহির্ভূত সর্ম্পক, পরবর্তী কালে যা বাবাকে আরো বেশি হিংস্র করে তোলে।
শোনা যায় মঁমসা কোথাও বেড়াতে গেলে হোটেলে মহিলাদের জন্য অতিরিক্ত একটি ঘর ভাড়াতে নিতেন মা। এই জীবন যাপনের জন্যেই খুব কম বয়সে সিফিলিসের মত অসুখে আক্রান্ত হয়ে যান, যা মৃত্যুর প্রায় দুবছর আগে থেকেই তাঁর স্নায়ু তন্ত্রকেও বিকল করে দিয়েছিল। এই রোগেই তাঁর বাবা এমনকি ভাইয়েরও মৃত্যু হয়। কেউ কেউ বলেন অনেক প্রতিভা ক্ষণস্থায়ী হয়।
হয়ত তাই এই প্রতিভাধর মানুষটি যাকে এমিলি জোলা বলেছেন,‘ইল ফেটেড ম্যান’, হেনরী জেমস বলেন,‘লায়ন ইন দ্যা পথ। ’ তাঁর মৃত্যুটাও এমনি একটি চমক, তাঁর ছোট গল্পগুলির মত।