মনের মানুষঃ দুটি হৃদয়ের মিলনের গল্প

লাবণ্য আর প্রমিত কি পারলো তাদের মনের মানুষের কাছে যেতে?কীভাবে দুই হৃদয় এক হবে সেই পথচলার সঙ্গী হতে গেলে যেতে হবে মৌঝুড়ি স্টেশনে আর তিয়াস নদীর পাড়ে।

মনের মানুষঃ দুটি হৃদয়ের মিলনের গল্প
মনের মানুষঃ দুটি হৃদয়ের মিলনের গল্প


লাবণ্য কলেজ যাওয়ার সময় একদিন মৌঝুড়ি স্টেশনে ওকে দেখেছিল । এযুগের অন্য ছেলেদের চেয়ে একটু আলাদা রকমই লেগেছিল ওকে  --- চুলগুলো উস্কোখুস্কো, জামা প্যান্ট জমকালো নয় কিন্তু যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অত্যাধুনিক বেশভূষার বাহুল্য না থাকা সত্ত্বেও যেটা লাবণ্যর বেশ পছন্দ হল সেটা হচ্ছে অগোছালো মানুষটার শান্ত অথচ ঊজ্জ্বল চোখজোড়া যেগুলো দৃঢ় ব‍্যক্তিত্বের পরিচায়ক ।


লাবণ্য বি.এ ফাইনাল ইয়ারের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের মেধাবী ছাত্রী। মা-বাবা আর ভাইয়ের সাথে মৌঝুড়িতে এক ছোট্ট সুখী পরিবারে থাকে। সারাদিন ও মেইনলি স্টাডি আর ড্রইং নিয়ে থাকতে পছন্দ করে।


রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে লাবণ্য ভাবছিল যদি একবার কথা বলতে পারতাম ওর সাথে যদি পরিচয় করতে পারতাম মনটা ভালো লাগতো । এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ও ঘুমের চাদরে জড়িয়ে গেল।


প্রমিতের ব্রেক আপ হয়েছে এক বছর আগেই। আগের প্রেমিকা পামেলা বড্ড ওভারস্মার্ট টাইপের ছিল। সে আবার প্রমিতের লেখালেখির অভ্যেসটা নিয়ে রাগারাগি অশান্তি করতো। ওর শিল্পসত্ত্বার কোনো মূল্যই ছিল না সদাচঞ্চল পামেলার কাছে। আবেগ অনুভূতির অনেক অভাব ছিল তাই সম্পর্কটা টেকেনি চার মাসের বেশি।


প্রমিত ইউনিভার্সিটির বেঙ্গলি ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। ও থাকে কুসুমনগরে,মৌঝুড়ির পাশের গ্রাম। পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসাবে প্রমিত মা-বাবার নয়নের মণি। ওর বাবা একজন দক্ষ গায়ক আর অনেকটা সেই কারণেই হয়তো প্রমিতের শিরায় শিল্প বইছে। ও সময় পেলেই পেন ডায়েরি নিয়ে বসে পড়ে গল্প কবিতা লিখতে। এসবের পাশাপাশি রয়েছে ওর টুকটাক ড্রইংয়ের শখ।

 
ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় একজন মেয়েকে ও দেখেছে দু-তিনবার, ভালো লেগেছে, মুখটা বেশ মিষ্টি । কিন্তু বাক‍্যালাপ করার সাহস হয়নি এখনো অব্দি। "আজকালকার মেয়েরা সব! আদৌ পাত্তা দেবে কি না ! যদি মুখের ওপর কথা শুনিয়ে অপমান করে দেয় !

কিন্তু না,পরেরদিন কথা বলতেই হবে দেখতে পেলে"প্রমিত ভাবছিল,"তারপর যা হয় হবে"।


কয়েকদিন পরে আবার স্টেশনে দেখতে পেলো সেই ছেলেটাকে। লাবণ্য প্ল‍্যাটফর্মে বসেছিল তিনজন বান্ধবীর সঙ্গে। গল্প করার মাঝেই ও আড়চোখে লক্ষ্য করছিল ওকে। একটু পরেই ছেলেটা এগিয়ে এসে একজন বান্ধবীর সাথে কথা বলতে শুরু করলো । ছেলেটা জল চাইলো, লাবণ্যর হাতেই বোতল ছিল,ও এগিয়ে দিল সেটা।


লাবণ্য এই সুযোগে কথা বলবে ভাবলেও ছেলেটা শুকনো "থ‍্যাঙ্কস্" ছাড়া আর কিছুই না বলে বোতলটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লো । মনে মনে লাবণ্যর রাগ হলো হালকা ।


কলেজে অফটাইমে লাবণ্য ফেসবুকে খুঁজছিল যদি ওর বান্ধবীর মিউচুয়ালে পেয়ে যায় পছন্দের মানুষটাকে। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে হাতড়ে গেল তবুও,নাহ পেলো না। এত খুঁজেও না পেয়ে কেমন যেন চাপা অস্বস্তি হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। কিন্তু হাল ছাড়লে হবে না,কথা বলতেই হবে ওর সাথে, সোশ্যাল মিডিয়ায় না পেলে সামনাসামনিই বলবে। একটা জেদ চেপে ধরেছে লাবণ্যকে। কিছুদিন পরে হঠাৎ ইন্সটাগ্রাম স্ক্রল করতে করতে চোখে পড়লো একটা নাম। নামটা অচেনা হলেও ছবির মুখটা খুব চেনা,বেশ কয়েকবার দেখেছে এই মুখ। ফলো বাটনে প্রেস্ করে লাবণ্য মেসেজ করলো ।


আরে এ কী দেখছে প্রমিত! এ তো মেঘ না চাইতেই জল! এইতো সেই মেয়েটা ওকে ইন্সটাতে মেসেজ করেছে---নাম "টেগোরিয়ান লাবণ্য"।


"পেন লভার প্রমিত"-এর তরফ থেকে রিপ্লাই আসতে থাকলো লাবণ্যর মেসেজের। কিছুদিনের মধ্যেই একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হলো লাবণ্য সেন আর প্রমিত চৌধুরীর ।


ইতিমধ্যে লাবণ্য একটা ছবি এঁকেছে প্রমিতের, ড্রইংটা লাবণ্যর সবসময়ের সঙ্গী আর পছন্দের মানুষের ছবি আঁকবে না তা কি কখনও হয় নাকি। ওর ইচ্ছে এবার মনের কথা বলেই দেবে প্রমিতকে । কিন্তু ভয় ভয়ও লাগছে যদি ও ভুল বোঝে লাবণ্যকে আর এর প্রভাবে বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায়।


ওরা একদিন সামনাসামনি দেখা করলো প্রমিতের পছন্দের জায়গা তিয়াস নদীর পাড়ে বাঁধানো ঘাটে। লাবণ্য তার আঁকা ছবিটা প্রমিতকে দেবে বলে তৈরী হচ্ছে এমনসময় হঠাৎই ওকে অবাক করে দিয়ে প্রমিত লাবণ্যর চোখদুটো হাত দিয়ে চাপা দিয়ে দেয়। যখন প্রমিত হাতটা সরালো লাবণ্য চোখ মেলে দেখে ওর কোলে একটা বাসন্তী রঙের সুন্দর কারুকার্য করা ওড়না আর জুঁইয়ের মালা,প্রমিতের পক্ষ থেকে তার প্রিয় বান্ধবীর জন্য সামান্য কিছু উপহার।


এরপরে লাবণ্য ওর আঁকা ছবিটা প্রমিতকে উপহার দিলো। ছবি দেখে মুগ্ধ প্রমিত তো লাবণ্যর প্রশংসায় মগ্ন।

বন্ধু হিসাবে আলাপ,কথোপকথন এবং উপহার আদান-প্রদান হল ঠিকই কিন্তু আসল চমকটা তখনও বাকি ছিল যেটা ওরা দু'জনেই বাড়ি ফিরে জানতে পারলো।


বিছানায় শুয়ে প্রমিত ছবিটা হাতে নিয়ে মুগ্ধ চোখে দেখছিল । চোখটা হঠাৎ ছবির ফ্রেমের ব‍্যাকসাইডে গেলো,কিছু লেখা রয়েছে লাল কালিতে---


"ইউ আর মাই ফার্স্ট ম‍্যান হুম আই লভ সো ডীপলি, তোমার আগলি লুক আমায় অ‍্যাট্র‍্যাক্ট করেছে এতটাই যে তোমার সাথে আমার ওই অনেকটা লভ অ‍্যাট ফার্স্ট সাইট বা প্রথম দর্শনে ভালোবাসা হয়ে গেছে বলতে পারো। আর তারপর তোমার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমার মধ্যে তোমার প্রতি গভীর এক অনুভূতির সঞ্চার করেছে। তোমায় প্রিয় বন্ধু হিসাবে সবটুকু সময় তোমাকে পেতে চায় আমার মন। আমি বুঝতে পেরেছি তুমিই আমার মনের মানুষ যার কাছে নিজের সকল কিছু নির্দ্বিধায় উজাড় করে দিতে কোনো কুন্ঠাবোধ হয় না। হবে নাকি আমার জীবনসঙ্গী ?"


সন্ধ্যেয় ফ্রেশ্ হয়ে উপহারটা ভালো করে দেখবে বলে হাতে নিল লাবণ্য। ও দেখলো ওড়নাটার ভিতরে অপূর্ব রংবেরঙের ডিজাইন করা। কিন্তু চোখ আটকে গেলো একটা পাশে ,কিছু লেখা আছে মনে হচ্ছে । ভালো করে দেখতেই ও বুঝলো একটা কবিতা, অ্যাক্রিলিক রঙ দিয়ে লেখা...প্রমিত লিখেছে মনের মানুষ, লাবণ্যর উদ্দেশ্যে । পায়ের কাছে একটা কাগজ পড়লো ,কুড়িয়ে নিয়ে লাবণ্য দেখলো তাতে দুটো ছোট্ট  লাইন---


" চলো প্রিয় লাবু আমার, বাকিটা পথ আমরা একসাথে হাঁটি।

ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে আর ফুলের মালাটা খোঁপায় লাগিয়ে একটা ছবি দিতে ভুলো না যেন। আমার আবদার রাখবে তো!"


এরপর আর কী?

শুরু হলো দুটি হৃদয়ের এক হয়ে আগামীর পথে একসঙ্গে পা মিলিয়ে হেঁটে চলা ।।