মানবিকতা এবং মানবিক দর্শন/মানবতাবাদ কি?

মানবতাবাদী চিন্তা শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে। গ্রীক দার্শনিক প্রোটাগোরাস বলেন, Man is the measure of all things... অর্থাৎ, মানুষই সব কিছুর মাপকাঠি।

মানবিকতা এবং মানবিক দর্শন/মানবতাবাদ কি?
ফটো গ্রহণ করা হয়েছে the-prominent.com থেকে

মানবতাবাদ হল গবেষণা, দর্শন ও অনুশীলনে এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী যা মানবিক নীতি ও বিষয়াদি নিয়ে কাজ করে।


এই শব্দটি বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন; প্রথমত, মানবতাবাদকে একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন বলা হয়। যাকে ইতালীয় রেনেসাঁসের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কায়িত করা হয়।


দ্বিতীয়ত, এটি একটি শিক্ষাবৃত্তিক কার্যপদ্ধতি, যা সাহিত্যবিষয়ক উপাদান অথবা মানবিক বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দান করে।


তৃতীয়ত, দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গীগুলো যেগুলো যে কোন প্রকার “মানব প্রকৃতি” এর অস্তিত্ব ঘোষণা করে।


চতুর্থত, এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শ যা যুক্তি, নীতিশাস্ত্র, ও ন্যায়বিচারকে নৈতিকতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। এবং সবপ্রকার অলৌকিকতা এবং ধর্মীয় শাস্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে।


সর্বশেষ এই অর্থটির উপর ভিত্তি করে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদকে একটি জীবনবিধান বলা চলে। আধুনিক অর্থে মানবতাবাদ বলতে তাই অলৌকিকতা ও ঐশী কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা বোঝায়।


শব্দটির এই ভাবার্থকে প্রথাগত ধর্মীয় বৃত্ত্বে ব্যবহৃত “মানবতাবাদ” শব্দটির ভাবার্থের বিপরীতে দাঁড় করানো যেতে পারে।


জ্ঞান আন্দোলনের প্রত্যাদেশবিরোধী আস্তিকতা বা একাত্মবাদ, পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধবাদ, ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং বিজ্ঞানের প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে এই তরিকার মানবতাবাদের জন্ম হয়েছে।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানবতাবাদ কী?

‘মানবতা আর ‘মানবতাবাদ’ এক বিষয় না। যদিও আমরা চেতন এবং অবচেতন মনে প্রায়শই শব্দ দু’টিকে অদলবদলভাবে ব্যবহার করে থাকি। মানবতা/ মানুষতা বলতে ‘মানব-প্রকৃতি’ এবং ‘মানব-গুনাবলী’কে বুঝায়।


আর মানবতাবাদ হচ্ছে একটি দার্শনিক মতবাদ যার অন্টলজিকাল, জ্ঞানতাত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, নান্দনিক, নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং মতবাদটির লক্ষ্য হচ্ছে জগতে মানুষের মুক্তি এবং শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিত করা।


এই মানবতাবাদী চিন্তা শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে। গ্রীক দার্শনিক প্রোটাগোরাস বলেন, (Man is the measure of all things) অর্থাৎ, ‘মানুষই সব কিছুর মাপকাঠি।’


সে নিরিখে মানুষ হচ্ছে জগতের কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচীন গ্রীক-রোমান সংস্কৃতিতে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল মানবকেন্দ্রিক ও ইহজাগতিক।


‘রেঁনেসাসের সময়ে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ কর্তৃক ল্যাটিন এবং গ্রীক ভাষার বইপুস্তকগুলো পুনঃআবিষ্কারের ফলে এ মতবাদ আবার ইউরোপীয় সমাজে প্রচার হওয়া শুরু করে।


মানবতাবাদের এই পুরো ধারণাই এসেছে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতকে ইউরোপিয় রেঁনেসার হাত ধরে। আর এ চিন্তাধারা থেকেই সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে আলোকায়ন আন্দোলন অনুপ্রাণিত হয়।


অর্থাৎ মানবতাবাদের মূল কথা হলো, মানুষকে ভালোবাসা বা মানুষের মঙ্গল করা। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান প্রভৃতির চর্চার ফলে মানুষ বুঝতে শুরু করে যে, এই জগৎ আনন্দময় এবং দেহ-মনের উন্নতি সাধনই হলো জীবনের উদ্দেশ্য।


তারা মানব জীবনের উন্নতির উপর গুরুত্ব দিয়ে সাহিত্য ও শিল্পকলায় মানুষের জীবনকে ভিত্তি করে বিভিন্ন সৃষ্টি কর্মকে সমর্থন জানান।


মানবতাবাদ কোনও ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত এবং সম্মানজনক মনোভাব। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, সমর্থন, সহানুভূতি। মার্কসবাদী তত্ত্ব অনুসারে মানবতাবাদ এমন একটি বিশ্বদর্শন যা কোনও ব্যক্তির সর্বোচ্চ মূল্য, তার ভাল ও মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়।


প্রথম মানবতাবাদী হলেন ফ্রান্সেস্কো পেটর্যাচ, তিনি ছিলেন একজন ইতালিয়ান কবি এবং প্রোটো-রেনেসাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।


মানবতাবাদের অনেকগুলো ঘটনা আছে। যেমন— সেক্যুলার মানবতাবাদ, ধর্মীয় মানবতাবাদ, রেনেসাঁস মানবতাবাদ, মার্কসীয় মানবতাবাদ ও উত্তর-মানবতাবাদ।


ধর্মের মত মানবতাবাদেরও জগত-দেখার আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মানবতাবাদ ধর্মের খোদাকেন্দ্রিক জগতকে নাকচ করে, খোদার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, কিংবা এমন খোদাকে বিশ্বাস করে যার জগতের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ নাই।


এবং মানুষ ও খোদার মধ্যকার সম্পর্ককে ছিন্ন করার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার নির্মাণের চেষ্টা করে, যেখানে মানুষ হচ্ছে ঈশ্বর সমতুল্য।


জ্ঞানতাত্বিক জায়গায় ‘মানবতাবাদ’ বৈজ্ঞানিক সংশয়বাদকে সমর্থন করে। অর্থাৎ, কোন দাবীর পিছনে পরীক্ষামূলক প্রমাণ না থাকলে তার সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক তরিকাকে সমর্থন করে।


অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণ ও পরিক্ষণের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করা এবং তা পরখ করে দেখা। রাজনৈতিক দর্শনের জায়গায় মানবতাবাদ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধ, মানবিক মূল্যবোধ ও সহানুভূতি এবং সহিষ্ণুতা ও সহযোগীতাকে গুরুত্বারোপ করে।


পাশাপাশি কর্তৃত্ববাদী বিশ্বাসকে অস্বীকার করে। নৈতিক প্রশ্নে মানবতাবাদ মানুষের মর্যাদা এবং কদর নিশ্চিত করতে চায় এবং ন্যায় ও অন্যায়ের বিচারের ক্ষেত্রে ঐশী মূলনীতিকে প্রত্যাখান করে যুক্তি-বুদ্ধির উপর নির্ভর করে।


ধর্মীয় বিশ্বাস ছাড়াই মানুষ নৈতিকভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং ইতিহাসের শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও চিন্তার দ্বারা মানুষ তাদের নৈতিক আইনকানুন প্রণয়ন করতে সক্ষম। এ মতবাদটি এমন বিশ্বাস পোষণ করে।


প্রিয় পাঠক বন্ধুরা আজ এই পর্যন্তই। আবারও নতুন কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হবো আপনাদের কাছে। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সবসময়ই শুভ প্রভাতের সঙ্গেই থাকুন। ধন্যবাদ।


আরও পড়ুনঃ জাতীয়তাবাদ কি? জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব সম্পর্কে জানুন