মাশরাফি বিন মর্তুজাঃ জনপ্রিয় সাবেক ক্রিকেট তারকা
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সাবেক ক্রিকেট তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজা, যিনি তাঁর দুর্দান্ত বোলিং একশন এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণে কোটি বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিতে পেরেছেন।

ইচ্ছা থাকলে পৃথিবীর যেকোনো অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। এই ব্যাপারগুলো প্রতিনিয়ত আমরা কিছু কিছু মানুষকে দেখে শিখি। যারা আমাদের হৃদয়ে অনুপ্রেরণা যোগায়। তাদের দেখে আমরা সব ভুলে গিয়ে আবার জয়ের নেশায় আপ্লূত হতে পারি। ঠিক তেমনি একটি অনুপ্রেরণাদায়ী চরিত্র বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসের জ্বলজ্বল করতে থাকা উজ্জ্বল নক্ষত্র মাশরাফি বিন মর্তুজা। শুধু একজন খেলোয়াড় হিসেবে নয়, একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবেও তিনি সকলের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পেরেছেন।
মাশরাফি বিন মর্তুজার জন্ম ৫ই অক্টোবর, ১৯৮৩ সালে নড়াইল জেলায়। তিনি একজন বাংলাদেশি সাবেক ক্রিকেট খেলোয়াড় এবং বর্তমান সংসদ সদস্য। বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা পেস বোলার ও সেরা অধিনায়ক তিনি। ইএসপিএন কর্তৃক পরিচালিত "ওয়ার্ল্ড ফেইম ১০০" এ বিশ্বের সেরা ১০০ জন ক্রীড়াবিদের তিনি মধ্যে অন্যতম।
মাশরাফির বাবার নাম গোলাম মর্তুজা। বর্তমানে তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাঁর মা হামিদা মর্তুজা একজন গৃহিনী। তাঁর ডাকনাম কৌশিক। এছাড়া ভক্তরা তাকে ম্যাশ, নড়াইল এক্সপ্রেস নামেও ডেকে থাকে।
নিজ জেলা নড়াইলেই তাঁর বেড়ে ওঠা।গ্রামের আর পাঁচটি ছেলের মতোই সাদামাটা জীবন ছিল তাঁর।ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন মাশরাফি। তাদের বাড়ির পাশেই ছিল স্কুল মাঠ।ছোটবেলা থেকেই বাঁধাধরা পড়াশোনার পরিবর্তে ডানপিটে ছেলেটি ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন। আবার মাঝে মধ্যে চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটতেন। নিজ জেলা নড়াইলে সে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাই নড়াইলবাসী তাকে "প্রিন্স অব হার্টস" নামে ডাকে।
নোবেল বিজয়ী নাদিয়া মুরাদ : যৌনদাসী থেকে আজ হাজারো মানুষের মুক্তির প্রতীক
তারুণ্যের শুরুতে ক্রিকেটের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন। যদিও বোলার হিসেবেই তিনি বেশি জনপ্রিয়।
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নড়াইলে। নড়াইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। নড়াইল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে এসএসসি পাশ করেন। এইচএসসি পাশ করেন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ২০০৩ সালে। এরপর দর্শন শাস্ত্রে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় সুমনা হক সুমির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০০৬ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান সাহেল মর্তুজা এবং হুমায়রা মর্তুজা।
নব্বইয়ের দশকে নড়াইলের ক্রিকেটার-সংগঠক শরীফ মোহাম্মদ হোসেন উঠতি তরুণদের যত্ন নিতেন। মাত্র ১১ বছর বয়সের মাশরাফি তার ক্লাব নড়াইল ক্রিকেট ক্লাবে খেলার সুযোগ পান। ১৯৯১ সালে মাগুরায় বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পের বিকেএসপি কোচ বাপ্পির সান্নিধ্যে এসে বোলিংয়ের অনেক মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। পরের বছর জাতীয় কোচ ওসমান খান নড়াইলে এক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালাচ্ছিলেন। সে সময় মাশরাফির আমন্ত্রণ আসে খুলনায় খেলার জন্য। খুলনায় তার গতি ও সুইং হইচই ফেলে দেয়। সেই সূত্রে খুলনা বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলে সুযোগ এবং ঢাকায় আসা।
পরবর্তীতে তিনি সুযোগ পান জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। সেসময় তার বোলিং কোচ অ্যান্ডি রবার্টসের পরিচর্যায় পাল্টে যান মাশরাফি। অনূর্ধ্ব ১৯ দলে থাকতে মাশরাফি দারুন পারফরম্যান্সের কারণে জিম্বাবুয়ে দলের বিরুদ্ধে ‘এ’ দলের খেলায় তিনি সুযোগ পান। এ নিয়ে সমালোচনা হয়। কারণ মাশরাফি ঢাকার কোনো সিনিয়র ডিভিশন লীগেও খেলেননি। সেই সিরিজে মাশরাফি এক ম্যাচে চার উইকেট নিয়েছিলেন। এরপর নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে তার নাম হয়ে যায় ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
বাংলাদেশ এ-দলের হয়ে একটিমাত্র ম্যাচ খেলেই মাশরাফি জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। ৮ নভেম্বর, ২০০১ এ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় তাঁর।একই ম্যাচে খালেদ মাহমুদেরও অভিষেক হয়। মাশরাফি অবশ্য অভিষেকেই তাঁর জাত চিনিয়ে দেন ১০৬ রানে ৪টি উইকেট নিয়ে। একই বছর ২৩শে নভেম্বর ওয়ানডে ক্রিকেটে মাশরাফির অভিষেক হয় ফাহিম মুনতাসির ও তুষার ইমরানের সাথে। অভিষেক ম্যাচে মোহাম্মদ শরীফের সাথে বোলিং ওপেন করে তিনি ৮ ওভার ২ বলে ২৬ রান দিয়ে নিয়ে নেন ২টি উইকেট।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যক্তিগত তৃতীয় টেস্ট খেলার সময় তিনি হাঁটুতে আঘাত পান। এর ফলে তিনি প্রায় দু'বছর ক্রিকেটের বাইরে থাকতে বাধ্য হন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট খেলায় তিনি সফলতা পান। ৬০ রানে ৪ উইকেট নেয়ার পর আবার তিনি হাঁটুতে আঘাত পান। এযাত্রায় তিনি প্রায় বছরখানেক মাঠের বাইরে থাকতে বাধ্য হন।
২০০৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে খেলার সময় রাহুল দ্রাবিড়কে অফ-স্ট্যাম্পের বাইরের একটি বলে আউট করে তিনি স্বরুপে ফেরার ঘোষণা দেন। সেই সিরিজে তিনি ধারাবাহিকভাবে বোলিং করেন এবং তেন্ডুলকর ও গাঙ্গুলীকে আউট করার সুযোগ তৈরি করেন। তবে ফিল্ডারদের দুর্বলতার কারণে তিনি উইকেট পাননি।
২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে তিনি ভালো বল করেন। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নাটকীয় জয়ে তিনি অবদান রাখেন। তিনি মারকুটে ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে শূন্য রানে আউট করেন এবং দশ ওভারে মাত্র ৩৩ রান দেন।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ভালো পেস বোলারের ঘাটতি ছিল। মাশরাফি বাংলাদেশের সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন।
২০০৬ ক্রিকেট পঞ্জিকাবর্ষে মাশরাফি ছিলেন একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় বিশ্বের সর্বাধিক উইকেট শিকারী। তিনি এসময় ৪৯টি উইকেট নিয়েছেন।
২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয়ে মর্তুজা ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ৩৮ রানে ৪ উইকেট দখল করেন। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি খেলায় নিউজিল্যান্ডের সাথে বিজয়েও মাশরাফির ভূমিকা রয়েছে।
মাশরাফি একজন তুখোড় ব্যাটসম্যান। ভারতের বিপক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় তিনি পরপর চার বলে ছক্কা পেটান। সেই ওভার থেকে তিনি ২৬ রান সংগ্রহ করেন যা কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের জন্য এক ওভারে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
২০০৯ সালের শুরুতে মাশরাফি অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলের সহকারী ছিলেন। পরবর্তীতে ওই বছরেরই জুন মাসে তিনি মোহাম্মদ আশরাফুলের স্থলাভিষিক্ত হন এবং তার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পান সাকিব আল হাসান। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে নিজের প্রথম ম্যাচেই তিনি হাঁটুতে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। ঐ খেলায় বাংলাদেশ জয়লাভ করে কিন্তু মাশরাফি এই চোটের কারণে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাঠের বাইরে ছিলেন।
১৬ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার চোটের কারণে দলের বাইরে যেতে হয়েছে মাশরাফিকে। চোটই তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ২০১১ সালের দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় খেলায় ২ উইকেট সংগ্রহের মাধ্যমে মোট ২১৬ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারী হিসাবে তুলে ধরেন নিজেকে।
২০১৪ সালের জিম্বাবুয়ের সাথে হোম সিরিজে তিনি পুনরায় অধিনায়কত্ব পান।২০১৫ সালের বিশ্বকাপেও তিনি বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৭ সালে ৬ই এপ্রিল বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কা সিরিজের শেষ টি২০ দিয়ে উনি আন্তর্জাতিক টি২০ খেলা থেকে অবসর নেন। মাশরাফি বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার যিনি অধিনায়ক থাকা অবস্থায় অবসর নেয়।
টি২০ ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট সংগ্রহ করেন বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ ২০২০-তে জেমকন খুলনার হয়ে।
তিনি ১১ নভেম্বর, ২০১৮ আওয়ামী লীগ প্রার্থী হয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, মাশরাফি নড়াইল-২ আসনের হয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। তিনি ৩০শে ডিসেম্বর, ২০১৮ অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন থেকে ২৭১২১০ ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হন।
মাশরাফির জীবনের গল্প টা উত্থান, পতন আর রোমাঞ্চে ভরপুর। যারা জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছেন। তাদের জন্য মাশরাফি একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। আর তাই তো আজ হাজারো তরুণের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম মাশরাফি বিন মর্তুজা। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে এরকম এক একটি মাশরাফি তৈরি হোক। মাশরাফিরা আজীবন এভাবেই বেচে থাকুক সকলের হৃদয়ে।