মা আর অভিমান

অভিমান আমরা আপনজন আর প্রিয় মানুষদের সাথে করে থাকি বেশি। সেটা মায়ের বেলায় বেশি হয়। বকুনি কিংবা মার খাওয়ার পর আমরা অভিমান করে থাকি মায়ের সাথেই।

মা আর অভিমান
মা আর অভিমান


মা'কে আমরা বিভিন্ন নামে ডেকে থাকি। আমরা তৃপ্তিভরে মা'কেই একমাত্র ডাকতে পারি। আম্মু,মা,মম,মাম্মা,আম্মা এসব নামে আমরা ডেকে থাকি। আমার কেন জানি মনে হয় “আম্মা “ শব্দটার মধ্যে বাঙালীরা যে তৃপ্তিটুকু পায় তা অন্য কোথায়ও পায় না।


এই মায়ের সাথে আমাদের যত রাগ,অভিমান,একাকিত্বের সময়টুকু ভাগাভগি করে নেই। নিজের পাহাড়সম দু:খের গল্প মায়ের হাসির কাছে তুচ্ছ। মায়ের সাথে আমরা রাগ-অভিমান করি,সেটা নিজেদের ভূল কর্ম-কান্ডে কিংবা খাওয়া-দাওয়া নিয়ে।


আবার কখনও মোবাইল ফোন চালানো নিয়ে মায়ের বকাতে আমরা রাগ করি, অভিমান করি। আমার অভিমানের গল্প প্রিয় মানুষদের সাথে একটু বেশি। বেস্টফ্রেন্ড থেকে শুরু করে বোন-ভাইয়ের সাথে অভিমানের গল্প এতটাই দৃঢ় যে মাসের পর মাস ভাই-বোনদের থেকে আমাকে আলাদা করে রাখত এই অভিমান। আম্মার সাথে আমার অভিমান কেন জানি মনে হলো জীবনের সবচেয়ে বড় ভূল ।



একদিন দুপুরের পর খাওয়ার পর ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠলাম বিকেল ৬ টার দিকে। ২-৬টা পুরো ৪ ঘন্টার ঘুম দেখে আম্মা বকাবকি শুরু করলেন। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরি,পড়তে বসি না,দিন – রাত মোবাইল ফোন নিয়ে পড়ে আছি ইত্যাদি। ৬-টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত আধা ঘন্টা পর পর বকা শুরু হতো।


আমার বকা শুনে অভ্যাস হয়েগেছে,তাই এখন আর গায়ে লাগে না। আব্বা বাসায় চুপচাপ সোফায় বসে টিভি দেখছেন,আমি দরজা লাগিয়ে চেয়ারে বসে আছি। এক ঘন্টা পর দরজা খুলে রাতের খাবার খেতে যাব, রান্না ঘরে গিয়ে দেখি ভাত-তরকারী কিছুই নাই,সবাই ঘুমাচ্ছে। মন খারাপ হলো, প্রচন্ত ক্ষিধা নিয়ে রাত পার করলাম।


ঘুম থেকে উঠলাম সকাল ৮ টায়,এত দেরিতে ঘুম থেকে উঠায় আবার বকা-বকি শুরু হলো। রান্না ঘরে গিয়ে দেখলাম সবাই নাস্তা করতেছে, আমার অতি আদরের দুষ্টু ভাই-বোন খাচ্ছে আর হাসতেছে। ছোট বোন চায়ের কাপ আমার সামনে দিতেই আব্বার বকুনি শুরু। এতক্ষণ আম্মা বকতেছিলেন এখন যোগ দিয়েছেন আব্বা।


“ কি বড়লোক হইছে- সকাল ৮ টায় ঘুম ভাঙে, সারাদিন টু-টু করে ঘুরে বেড়ায়,কোনো কাজ নেই,ফ্রি-তে খাচ্চে আর ঘুমোচ্ছে' এই কথা বলেই আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ভেসিনে ফেলে দিলেন।

-কিসের চা?কিসের নাস্তা? আজ থেকে সব বন্ধ। নিজে ইনকাম কর নিজো খাও।

-এখানে বসে আছিস কি জন্য? যা এখান থেকে। [আম্মা]

আম্মার কথা শুনে বেশ কষ্টই পেয়েছি। আবার কেন জানি আম্মার উপর অভিমান দৃঢ় হতে লাগল। দরজা লাগিয়ে ভাবতে ছিলাম “ রাতে আম্মার আমার জন্য খাবার রাখেন নাই,ডাকেন ও নাই। এখন আব্বা বকলেন সাথে সাথে আম্মাও। ১৮ বছর বয়সে এসেও এমন কঠিন মূহুর্তের সম্মুখীন হতে হবে – এমন কখনও ভেবেছিলে আরাফাত? ( নিজেকে প্রশ্ন করলাম) চোখ ভেয়ে পানি পড়তে লাগল।


শেষ কেঁদেছিলাম ক্লাস সিক্সে, পড়া না পারার জন্য মাহমুদ স্যার পটিয়েছিলেন। আজ অজান্তেই চোখ ভেয়ে পানি পড়ল,আব্বা-আম্মার বকুনিতেই। তারপরেও কেন জানি আম্মার উপরই রাগ হচ্ছে,অভিমান করছি। মানুষ আপনজন আর প্রিয়দের বেলায় নিজের সব রাগ আর অভিমানই ফেলে রাখে। এসব ভাবছি, হঠাৎ ছোট বোন এসে হাজির।



-কিরে কেমন লাগে এখন?খুব মজা না? বলে চলে গেল। হঠাৎ কানে আওয়াজ এলো “ বাসায় থাকার দরকার নেই,যে যার মতো পথ দেখুক। আমি বাসায় অপদার্থ রাখতে চাই না। “ ডয়ারে থাকা সব কাগজপত্র, ফাইল,কিছু শার্ট-প্যান্ট,পান্জাবি, জমানো কিছু টাকা দিয়ে কিনা সাইকেল নিয়ে চুপি চুপি বাসা থেকে চলে আসি। চলে আসার পর ছোট বোনকে  ‘চলে যাচ্ছি-ভালো থাকিস' বলে কল কেটে দেই। দু'দিন বড় ভাইয়ের একটা বাসায় থাকার পর কাজ জুটে বন্ধুর ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে।


তাও এক শিফটে ক্যাশিয়ার পদে। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত। এদিকে দু'দিন পর সিম করে বোনলে কল দিতেই বলে “ কি রে কোথায় বেড়াতে গেসিছ? বাসায় আয়। আম্মা সেদিন রাতে ভাত-তরকারী তোর রুমের পাশের সোফায় রাখেছিলেন। তুই খাস নাই? আম্মা দু'দিন ধরে কাঁদতেছেন। আয় ভাই- বাসায় ফিরে আয়”। কল কেটে দিলাম, মন চাচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি। জীবনের সবচেয়ে ভুলের মাশুল কি দিয়ে দিব ভেবে পাচ্ছি না।


বিকেল ৪ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত হাতিরঝিলে বসে ছিলাম এক মনা হয়ে। ভুলের মাশুল ‘সফলতা’ দিয়ে দিব বলে ঠিক করলাম। যেদিন আম্মাকে বলতে পারব ‘আম্মা  তোমার আরাফাতকে আর কেউ অপদার্থ বলার সুযোগ পাবে না আর” সেদিন আম্মার কাছে ফিরব। এসব ভাবছি আবার মনে হলো আম্মা চাইলে তো আমার সাথে কথা বলতে পারতেন। এখনও আমার উপরে রাগ করে আছেন,যাহ আমি ও এভাবে থাকব।


চাকরি,টিউশনিতে যা পেতাম তা দিয়ে বেশ ভালোই দিন চলে যেত আমার। মাস শেষে টাকা জমা ও থাকতো। তারপর ল্যাপটপ কিনি,ফিল্যান্সিং শিখি। ফিল্যান্সিং শিখতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো। কত রাত যে ক্ষিধায় কাটিয়েছি মনে নেই। আম্মার কথা মনে পড়ে,একটি রাত ক্ষিধায় কাটানোর কথা মনে পড়ে। আব্বাকে দেখি না অনেক দিন।


আম্মার সাথে কথা হয় না, ভাই-বোনরা কল দিলে টুক-টাক কথা হয়। পরিবারহীন এতটা মাস কতটা কষ্টে পার হয়েছে আল্লাহ ছাড়া আর কে জানবে আম্মা?আম্মা আমি ভালো নেই,আমার অভিমান আমাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে,আমার পাশে আর কেউ নেই। এভাবে মাঝ রাতে ছাদে উঠে চিৎকার করি।


কয়েকমাস পর চাকরি পাই একটা ইন্সটিটিউটে। ছয় মাস কাজ করার পর আরো ভালো ট্রেনিং এর জন্য কানাডা পাঠানো হয় অফিস থেকে। কানাডা থেকে ছয় মাসের ট্রেনিং এসে দেশে ফিরি।


মাসিক বেতন ৫০+ হয়েছে আম্মা,নিজের ইনকাম মিলিয়ে লাখ-দেড়েক কামাই করতে পারু আম্মা। আব্বা তোমার আরাফাত অপদার্থ নয় এখন। এভাবে আর কবে বলতে পারব জানি না। হঠাৎ ফোন বেঁজে উঠল সামিয়ার ফোন। সামিয়া আমার ছোট বোন।

-ভাইয়া কেমন আছিস?
-ভালো। তোরা?
-হ্যাঁ আমরা ভালো আছি।
-আব্বা-আম্মা ভালো আছে?কি করেন?
-তুই জিজ্ঞাস কর। আমি কেন বলব? ভাইয়া শুন আদনান ভাইয়ার বিয়েরে ৩ তারিখ। তুই আসবি না?
- এর বয়স হইছে? এখন কিসের বিয়া?
-আব্বা চাইতেছেন তাই। তোরে অনেক দিন দেখি না, চেহারাট ও দেখাস না। আয় না বিয়েতে,আয় প্লিজ। দেখবি আব্বা-আম্মা তুই আসলে খুশি হবে।
-অকে



আজ ৫ বছর হলো-পরিবারহীন। আদনানের বিয়েতে যাই নি অফিসের কাজ ছিলো। এ নিয়ে আদনান এবং তার স্ত্রী,সামিয়া অনেক অভিযোগ ধার করালো। আম্মা শুধু বললেন” আসলে ভালো হতো”। কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে আম্মার সাথে দেখা নাও হতে পারে। একটা সংশয়,ভয়,আকাঙ্ক্ষা কাজ করছেন।

অতপর ১ বছর পর বোনের বিয়ের খবর আসলো। এবার স্বয়ং সামিয়ার জন্য নির্ধারণ করা পাত্রই কল দিয়ে যাওয়ার জন্য বলছে। ৬ বছর আগে পরিবার,আব্বা-আম্মা ,আত্নীয় কেমন হয়েছেন জানি না। আমি কেমন হয়েছি তা বন্ধি মহলে বেশ চর্চা হয়। বাসা থেকে চলে আসা/পালিয়ে আসা রোগা-পাতলা ছেলেটা আজ স্বাস্থ্যবান ইত্যাদি।


আম্মাকে যত দিনই কল দিয়েছি কোনো দিন কল রিসিভ করেন নাই। সামিয়া/আদনানের কাছে কল দিলে মাঝে মাঝে আম্মা রিসিভ করতেন, আমার কন্ঠ শোনার পর পরই কেটে দিতেন। আমার প্রতি আম্মার রাগ/অভিমানটা এখনও আছে কি না জানি না। তবে জানি আম্মা উনার আঁচলে আমার ৬ বছরের চোখেরজল মোছার সুযোগটা দিবেন।



বিয়ের ২ দিন আগে বোনের হলুদ সন্ধ্যা। আদনানকে বললাম ‘বিকেলের দিকে আসব,কাউকে বলিস না'। শুনেছি আব্বা এখন পান্জাবি পড়েন,শার্ট-প্যান্ট পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। আম্মার চশমা পড়তে হয়,চোখে সমস্যা। সিলেটের ট্রেন আসতে দেরি করেছিলও,তাই সন্ধ্যায় এসে পৌঁছালাম। এদিক দিয়া আদনান কল করেই যাচ্ছে বাসে আসব না ট্রেনে আসব?কয়টায় আসব? আমাকে নিতে আসবে নাকি।


বললাম' লাগবে না একাই আসব'। ৭ টার দিকে বাসার গেইটে পৌঁছালাম। আদনান আমাকে দেখে বলল ‘ তুমি আসবে জেনে আম্মা সেই আসরের নামায পড়ে বসে আছে। কখনও ছাঁদে যান আবার কখনও রোডে যান।

-তোরে না বললাম ‘বলবি না কাউরে'
-আমি বলছি নাকি। আম্মা আমার পিছনে ছিলেন তোমার সাথে কথার বলার সময়। আমি জানতমই না।
-অহ
-আসো। ভিতরে আসো।



আম্মা সিঁড়ি পাশে থাকা পিলার ধরল দাড়িয়ে আছেন। আম্মার মাথার উপরে একটা লাইট আলো দিচ্ছে। আর সামনের দিকটা অন্ধকার। আমাকে দেখেন নাই। আজ চশনা পড়েন নাই,আমাকে নাকি খালি চোখেই দেখবেন আদনান বলল।


আমি এই আরাফাতকে কিভাবে আম্মার সামনে দাড় করাব? ভূল,অপরাধবোধ,দায়িত্বহীনতা আমার মাথায় চেপে বসেছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি। আদনান বলল' চলো তো'
আম্মা আদনানকে দেখে বললেন “ আরাফাত কই? কোথায় আসছে?কতক্ষণ লাগবে?কল দেনা বাবা। দেখ আমার আরাফাত কোথায় আসছে? বিপদে পড়ল কি না?

-আরাফাতের আব্বা শুনছো? 
-কি? ( আব্বা রুমের সামনে চেয়ারে বসা)

-আরাফাত ও এখনও আসল না। বিপদ হলো নাকি? আমার আরাফাতের কিছু হলে আমি বাঁচব না [ কেঁদে কেঁদে বললেন]
আদনান নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদনানের মাথার উপর এখন লাইটের আলো। আম্মা আব্বার পায়ের কাছ বসে আছেন। আমি এক আধটু করে আদনানের দিলে এগোচ্ছি। আম্মা “ অই আদনান, দাড়িঁয়ে আসস কেন? আরাফাত কই? বলে এগোলেন। আমি আবছায়া আলোয় দাঁড়ালাম, হাত-পা কাঁপছে। আদনানের ছায়া আমার উপর পড়ল। আম্মা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন

- “ আরাফাতের আব্বা। আমার আরাফাত এসেছে। এই যে দেখো।
আম্মা দুই সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েগেলেন। আম্মার বুকে মাথা রেখে ৬ বছরের গল্প করা হলো না। আইসিইউতে জীবনে শেষ ২ টা দিন কাঁটিয়ে আমার প্রতি একরাশ অভিমান বাক্সে ভরে রেখে দিয়ে চলেগেলেন।



“ আম্মার রেখে যাওয়া টিনের অভিমানের বাক্সে আমি এখন অভিমান জমাই।