যুগে যুগে বঙ্গদেশ ও বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস
আজকের বাংলাদেশ একদিনে, বা এক বছরে এমনকি কয়েকযুগেও গঠিত হয়নি বরং আজকের বাংলাদেশের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। আজকের বাঙালি জাতির উদ্ভব, যুগে যুগে বঙ্গদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও বাঙ্গালী জাতীর অবস্থান জানতে পড়ুন ধারাবাহিক ইতিহাস।

১৯৭১ সালে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র আকষ্মিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি; এর পিছনে রয়েছে একটি ধারাবাহিক ইতিহাস। সুদূর প্রাচীনকালেও বাংলার জনপদগুলো স্বাধীনভাবে শাসিত হতো।
কোন জনসমষ্টি যখন একই ভূখন্ডে বাস করে একই ভাষা, ধর্ম, ঐতিহ্য, প্রথা ও আচার-ব্যবহারে পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন এ ঐক্যের সমন্বিত রূপের নাম জাতীয়তাবোধ।
আর জাতী বলতে আমরা এমন একটি জাতী সমষ্টিকে বুঝি, যারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক নির্দিষ্ট ভূখন্ডে তাদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে আর হয়েছে মহামিলনের মন্ত্রে অনুপ্রাণিত।
জাতি একদিনে, এক বছরে কিংবা এক যুগেও গঠিত হয়না বরং প্রতিটি জাতির থাকে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
প্রতিটি জাতির ইতিহাসে থাকে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট, যে প্রেক্ষাপটের ভিত্তিমুলে রচিত হয় ইতিহাসের স্তম্ভ। জাতি হিসেবে ' বাঙালি'ও এমন একটি জাতি, যার ইতিহাসও পেরিয়ে এসেছে এক সুদীর্ঘ যাত্রাপথ।
প্রাচীনকাল থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পর্যন্ত বাঙালিদের স্বকীয়তা, স্বশাসনবোধ, সংগ্রামী মনোভাব ও স্বাধীকারের চেতনাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায় :
১। বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান ও স্বাতন্ত্র্যবোধঃ প্রাচীন ও মধ্য যুগ; ২। ব্রিটিশ ভারতে বাংলার অবস্থান : ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ; ৩। পাকিস্তানের জন্ম : ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন ধরা ; ৪। রাজনৈতিক সংঘাত : নতুন ভাবনা।
বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান ও স্বাতন্ত্র্যবোধ : প্রাচীন ও মধ্য যুগ
সাধারণত ইতিহাসে খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক শতক পূর্বের সময় থেকে খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতকেই প্রাচীনকাল বা যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে।
খ্রিষ্টীয় তেরো শতকের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় দু হাজার বছরের সময়কে বাংলার প্রাচীন যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে। প্রাচীন যুগে বাংলা (বর্তমানের বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গ) এখনকার বাংলাদেশের মতো কোন একক ও অখন্ড রাষ্ট্র বা রাজ্য ছিলোনা।
বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন অনেকগুলো ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত ছিলো। আর প্রতিটি অঞ্চলের শাসকরা যার যার মতন শাসন করতেন। বাংলার এ অচঞ্চলগুলোকে সমষ্টিগতভাবে নাম দেয়া হয় 'জনপদ'।
উৎকীর্ণ শিলালিপি ও বিভিন্ন সাহিত্য গ্রন্থে প্রায় ষোলোটি জনপদের কথা জানা যায়। এ প্রসঙ্গে রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন : " প্রাচীন হিন্দযুগে সমগ্র বাংলার কোন একটি বিশিষ্ট নাম ছিলো না। ইহার ভিন্ন অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল।
উত্তর বঙ্গে পুন্ড্র ও বরেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গে রাঢ় ও তাম্রলিপ্তি এবং দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে বঙ্গ, সমতট, হরিকেল ও বঙ্গাল প্রভৃতি দেশ ছিলো। এ সমুদয় দেশের সীমানা ও বিস্তৃতি সঠিক নির্ণয় করা যায়না, কারণ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তাহার বৃদ্ধি ও হ্রাস হয়েছে।
ঐতিহাসিক আবুল ফজলের " আইন ই আকবরী" গ্রন্থ অনুসারে এ অঞ্চলের নাম ছিলো 'বঙ্গ'। নীহারঞ্জন রায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন :
'বাঙলার বিভিন্ন জনপদরাষ্ট্র তাহাদের প্রাচীন পুন্ড্র- গৌড়- সুক্ষ্ম -রাঢ়-তাম্রলিপ্ত-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল ইত্যাদির ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করিয়া এক অখন্ড ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য সমন্ধে যখন আবদ্ধ হইলো, যখন বিভিন্ন স্বতন্ত্র নাম পরিহার করিয়া এক বঙ্গ বা বাঙ্গাল নামে অভিহিত হইতে আরম্ভ করিল, তখন বাঙলার ইতিহাসের প্রথম পর্ব অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে"।
নীহারঞ্জন রায়ের এ বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বাংলা কোন নির্দিষ্ট জনপদ ছিলো না।
ঐতিহাসিক আবুল ফজলের 'আইন ই আকবরী' গ্রন্থ অনুসারে বর্তমানের বাংলাদেশ প্রাচীনকালে বঙ্গ ও বাঙ্গাল নামে পরিচিত ছিলো। এ কে এম ইয়াকুব আলী লিখেছেন, " Vanga is no doubt an older terms whose origin can be traced back to the epic age… As early as the 10th century A.D.the term ' Vanga' seems to have been used either to denote a tract of land which was both separate and distinct from Vanga'' ত্রয়োদশ শতকেও বঙ্গ বলতে খুলনা, যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চল কে বোজানো হতো। বঙ্গের জনসাধারণই ছিলো বঙ্গাল।
বাঙালি জাতির উদ্ভব ও প্রাচীন যুগে বাঙালি :
খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে গাঙ্গেয় অববাহিকায় বসবাসকারী প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সাথে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা জনগোষ্ঠী এসে বসবাস করা শুরু করে।
একহাজার বছর পর ভারতের উত্তর -পশ্চিম দিক থেকে আলপিনো- ককেশীয় -আর্যরা এবং আরো আটশত বছর পর আরবীয়রা এসে ভারত বর্ষে বসবাস শুরু করে।
সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দু ভাগে ভাগ করা যায় - প্রাক আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী এবং আর্য নরগোষ্ঠী । আর্য পূর্ব জনগোষ্ঠী মুলত চার শাখায় বিভক্ত - ক) নেগ্রিটো খ) অষ্ট্রিক গ) দ্রাবিড় ঘ) ভোটচীনীয়।
অষ্ট্রো এশিয়াটিক বা অষ্ট্রিক গোষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে ধারনণা করা হয়। এদেরকে 'নিষাদ জাতি' নামেও অভিহিত করা হয়।
প্রায় পাঁচ -ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে বাংলায় প্রবেশ করে অষ্ট্রিক জাতি নেগ্রিটোদের পরাজিত করে। অষ্ট্রিক জাতির সমকালে বা কিছু পরে দ্রাবিড় জাতি আসে এবং দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিক জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙালি জাতি।
অর্থাৎ বাংলার প্রাচীন জাতি অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি জাতি আদি অষ্ট্রলয়েড নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে উত্তর পূর্বাঞ্চল দিয়ে মঙ্গোলীয়দের আগমন ঘটে।
বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতিদের বড় অংশ এই মঙ্গলয়েড এবং খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে ককেশীয় অঞ্চলের আর্যগোষ্টি ভারত বর্ষে প্রবেশ করে।
এভাবে আর্য ও অনার্য আদিম অধিবাসীদের সংমিশ্রণে এক নতুন মিশ্র জাতির উদ্ভব ঘটে। কাজেই বর্তমান বাঙালি জাতি অষ্ট্রিক, দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোলীয় ইত্যাদি জাতির রক্ত ধারায় এক বিচিত্র সংকর জাতি।
গাঙ্গেয় বঙ্গে বসবাসরত এসব জাতি -উপজাতির মানব স্রোত সময়ের পরিক্রমায় পরিচিত হয় 'বাঙালি ' জাতি হিসেবে।
বিভিন্ন জাতীর সংমিশ্রণ এখনো লক্ষনীয় বাঙালির দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট্যে। নীহারঞ্জন রায় তাই যথার্থ উল্লেখ করেছেন - " সাধারণভাবে বলা যায়, বাঙালির চুল কালো, চোখের মণি পাতলা থেকে ঘন বাদামি, গায়ের রং হালকা থেকে ঘন বাদামি। দৈর্ঘ্যের দিক থেকে মধ্যমাকৃতি, খর্বতাকেও অস্বীকার করা যায়না " [ উৎস: বাঙালির ইতিহাস - নীহারঞ্জন রায়।
অধ্যাপক হার্বার্ট রিজলি বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিরূপণ করতে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সাতটি মুল শ্রেনীতে (তুর্কো-ইরানীয়, ইন্দো -আর্য, শক -দ্রাবিড়ীয়, আর্য-দ্রাবিড়ীয়, মঙ্গোলীয় -দ্রাবিড়ীয়, মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড়ীয়) বিভক্ত করে বাঙ্গালীকে এই সাত শ্রেণির সৃষ্ট বলে বর্ণনা করেছেন।
তবে চুড়ান্ত বিশ্লেষণে তিনি দেখিয়েছেন যে, প্রধানত মঙ্গোলীয় দ্রাবিড়ীয় নরগোষ্ঠীর আনুপাতিক অন্তর্মিলনে বাঙালি জাতির উদ্ভব।
অধ্যাপক রিজলির বক্তব্যের সীমাবদ্ধতা থাকলেও তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ব্যাখা প্রদান করেন। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, প্রাক-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর লোকেরাই বাংলার প্রকৃত আদিবাসী। পরবর্তীকালে এদের সাথে নান ধারার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে আজকের বাঙালি জাতি।
বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাচীন বাংলার সীমা :
পূর্ব -পশ্চিম -উত্তরে পাহাড় ও জঙ্গলাকীর্ণ উচ্চভূমি এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর প্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত এমন বেষ্টনীর মধ্যেই বাংলার অবস্থান।
ড.নীহারঞ্জন রায়ের ভাষায়, " একদিকে সু-উচ্চ পর্বত, দুই দিকে কঠিন শৈলভূমি আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র ;মাঝখানের সমভুমির সাম্য-ইহাই বাঙালির ভৌগোলিক ভাগ্য। ড. নীহারঞ্জন রায় তার 'বাঙালির ইতিহাস ' গ্রন্থে প্রাচীন বঙ্গদেশের সীমানা নির্দেশ করেছেন।
তার ভাষ্যমতে, উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয়ধৃত নেপাল, সিকিম, ভুটান রাজ্য; উত্তর -পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ ও উপত্যকা ; উত্তর -পশ্চিমদিকে দ্বার বঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবর্তী সমভুমি; পূর্ব দিকে গারো, খাসিয়া জৈন্তিয়া -ত্রিপুরা -চট্রগ্রাম শৈলশ্রেণি বাহিয়া দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত; পশ্চিমে রাজমহল-সাওতাল পরগনা -ছোট নাগপুর -মালভূম-ধলভূম-কেওঞ্জর-ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি ;দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর"।
এ প্রাকৃতিক সীমাবিধৃত ভূখন্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান। এবং এ সীমারেখার মধ্যেই প্রাচীন বাংলার গৌড়-পুণ্ড্র-বরেন্দ্রী- রাঢ়-সুক্ষ-তাম্রলিপ্ত- সমতট- বঙ্গ- বঙ্গাল -হরিকেল প্রভৃতি জনপদের অবস্থান ছিলো।
আরও পড়ুনঃ ফারসি ও উর্দু সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি মির্জা গালিব