রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম প্রেম ঋভু চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম প্রেমের বিষয়ে কিছু আকর্ষণীয় ইতিহাস।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম প্রেম ঋভু চট্টোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম প্রেম ঋভু চট্টোপাধ্যায়


কথায় বলে প্রেমের থেকে কবিতা লেখার বড় অনুপ্রেরণা আর থাকে না, অথবা কবিতা লিখতে গেলে প্রেম করতে হয়। শুধু কবিতা কেন, সাহিত্যে বা শিল্পের যেকোন ধারা প্রেমেরই সমনাম বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই মহান সম্পর্ক থেকে তাঁর বয়সের নিয়মেই মুক্ত হতে পারেন নি। অবশ্য একে প্রেম না বলে অনুপ্রেরণাও বলা যায়। সেই অনুপ্ররণা কখনো পরিবারের মধ্যে কখনও বা বাইরে থেকে কবিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। শোনা যায় প্রায় সমবয়সি বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সাথে কিশোর রবিঠাকুরের একটি গভীর ও রহস্যময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা কিশোর কবির মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে।


নিজের আত্মীয়র মধ্যে এই সম্পর্ককে অনেকেই অবশ্য প্রেম বলতে নারাজ, ঠিক যেমন রবীন্দ্রাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সমবয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রী(সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে) ইন্দিরা দেবী যিনি রবীন্দ্রনাথকেরবিকাবলে ডাকতেন তাদের মধ্যকার আত্মিক যোগাযোগকেও হঠাৎ করে প্রেম বলতে অনেকেই রাজি হন নি। কিন্তু কিশোর রবি ঠাকুরের সাথে তার থেকে বয়সে বড় দক্ষিণি নারী অন্নপূর্ণা(আন্না) তড়খড়ের সম্পর্ক আজও বেশ রহস্যময়। অনেকে তাঁকেই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেম বলেন।


রবীন্দ্রনাথের তখন সতেরো বছর বয়স। ভারত থেকে বিদেশে পাড়ি দেবার ঠিক দুমাস আগে মুম্বই(তৎকালীন বোম্বে)এ ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরাম তড়খড়ের বাড়িতে থাকতে যান,উদ্দেশ্য ইংরেজি ভাষা ও আদব কায়দা সম্পর্কে ভালো ভাবে জ্ঞান লাভ১৮৭৮ সালের অগাস্ট মাস, সেই সময় পাণ্ডুরাম ছিলেন বোম্বের একজন নামকরা চিকিৎসক। শুধু তাই নয় সামাজিক ভাবে বেশ প্রতিষ্ঠিত এবং ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষায় শিক্ষিত। ভারতবর্ষের অনেক শিক্ষিত পরিবারের সাথে তাঁর ভালো যোগাযোগ ছিল। তিনিই আবার অন্যদিকে প্রার্থনা সভার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আত্মারামের ভালো চেনা পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। আমরা জানি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ভারতীয় যিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হন।


তিনিই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে পরামর্শ করে বিদেশ যাবার কিছু দিন আগে রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষায় শিক্ষিত একটি পরিবারে রাখতে চেয়েছিলেন যাতে রবি ঠাকুরের ভাষা শিক্ষার পাশে ইংরেজি সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা আসে। তাঁরই পরামর্শে কিশোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আত্মারামের বাড়িতে কিছু দিন(দুমাস) রাখবার পরিকল্পনা করা হয়। ঘটনাচক্রে আত্মারামের দ্বিতীয় কন্যা অন্নপূর্ণা তড়খড় বা আন্না তড়খড় কিছু দিন আগেই বিদেশ থেকে ফেরে এবং আত্মারাম সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা মত কিশোর রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার ভার তুলে দেন আন্নার হাতে।


আন্না সেই সময়েই ইংরেজি ভাষাতে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন কিন্তু তাকে শিক্ষিকা হিসাবে পেয়ে কিশোর রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কতটা উন্নতি হয় সে সম্পর্কে জানা না গেলেও তাদের মধ্যে যে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই ব্যাপারে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য কিশোর রবীন্দ্রনাথের থেকে আন্না প্রায় বছর তিনের বড় ছিলে তাও রবীন্দ্রনাথ আন্নাকে নিয়ে খুবই উৎসাহিত ছিলেন, তাকে নিয়ে কবিতা লেখেন, গান লেখেন এমনকি ১৮৮৪ সালে একটি গদ্য নাটকও লেখেন সেখানে উৎসর্গ পত্রটি শূন্য থাকে। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ তার নলিনীকে স্মরণ করেই এই উৎসর্গ পত্রটি এমনভাবে রাখেন। কিশোর কবি আন্নাকে তার নিজের নামে সম্বোধন না করে তাকে একটি নতুন নাম দেন, ‘নলিনী’। এই নামটি রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল, তাই অনেক কবিতায় এই নামটি তিনি ব্যবহার করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘শুন নলিনী, খোল গো আঁখি/ ঘুম এখনো ভাঙ্গিল না কি/দেখ, তোমারি দুয়ার পরে সখি এসেছে তোমারি রবি। ’


শোনা যায় আন্না রবীন্দ্রনাথকে দাড়ি রাখতে বারণ করে বলেছিলেন,‘দাড়ি রাখলে তোমার মুখের কোমলতা লালিত্য সব নষ্ট হয়ে যায়। দাড়ি মুখের সরলতাকে লুকিয়ে রাখে। ’এই কথাতে কিশোর রবীন্দ্রনাথ এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন বহুদিন পর্যন্ত মনে রেখেছিলেন। এমনকি আন্নার মৃত্যুর পরেও এই কথা রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল। বহুবার বহুজনের সাথে একান্ত আলাপের সময়(এনাদের মধ্যে অতুলপ্রসাদ সেন ও দীলিপকুমার রায়ও ছিলেন। )এই প্রসঙ্গের উত্থাপন করে আন্নার কথা তিনি যে রাখেন নি সেকথাও উল্লেখ করেন। অন্যদিকে আন্নাও কিশোর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ উৎসাহিত ছিলেন।


নিজেও এক জায়গায় লেখেন,‘কবি আমি মৃত্যু পথ যাত্রি হলেও তোমার লেখা আমাকে আবার জীবন দেবে। ’( Poet I think that even if I were on my death bed your songs would call me back to life) জানা যায় ঐ বয়সে সদ্য যুবতি আন্না এই সম্পর্কের ব্যাপারে যতটা প্রগলভ ছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথ ততটা ছিল না। স্বভাবতই সেই সম্পর্ক কোন পরিণতি পায় নি। কিছু সূত্র থেকে অনেকে অনুমান করেন আন্না কিশোর রবীন্দ্রনাথকে শারীরিক ভাবে চেয়েছিলেন, সেখানেও কিশোর রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট লাজুক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এরপর বোম্বে থেকেই বিদেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। এই সম্পর্কের একটা প্রাথমিক পরিসমাপ্তি ঘটে বলে জানা যায়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের মতই আন্নাও তাঁকে ভুলতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নলিনী নামটিই পরবর্তী কালে তাঁর ছদ্মনাম হয় এমনকি নিজের এক ভাইপোর নামও রাখেন রবীন্দ্রনাথ।


১৮৮০ সালে হ্যারোল্ড লিটিলডেল নামের এক স্কটিশ ভদ্রলোকের সাথে আন্নার বিয়ে হয়। হ্যারোল্ড সেই সময় বরোদা হাইস্কুল ও কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। বিয়ের পরেই অবশ্য দুজনেই বিদেশে চলে যান। ১৮৯১ সালে এডিনবোরাতে তেত্রিশ বছর বয়সে আন্নার মৃত্যু হয়।


এখন প্রশ্ন হল এই সম্পর্ক কি শুধু কৈশোরের মোহ? কিন্তু প্রমান তো সেই কথা বলে না। ‘The Myriad Minded Man’(  By Krishna Dutta &W Andrew Robinson)বই থেকে জানা যায় আন্নার পরিবার তাদের দুজনের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিদেশে যাওয়ার কিছুদিন পরেই আত্মারাম তার বড় মেয়ে(মতান্তরে আন্নাকে নিয়েই) কলকাতায় জোড়াসাঁকোতে আসেন ও ঠাকুর পরিবারে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেন। তাদের মধ্যে ঠিক কি কথা হয় এসম্পর্কে সঠিক জানা গেলেও অনুমান করা হয় সম্ভবত তড়খড় পরিবার রবীন্দ্রনাথের সাথে আন্নার বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রস্তাব মেনে নেন নি, শুধু তাই নয় তিনি যথেষ্ট মনক্ষুন্ন হন


আন্না যে রবীন্দ্রনাথের থেকে বয়সে বড় সেটাই মূলত এই আপত্তির কারণ ছিল বলে মনে করা হয় এছাড়া সাংস্কৃতিক ভিন্নতা অপর একটি কারণও হতে পারে। এই ঘটনা ঠাকুর পরিবারে একটা প্রভাব ফেলে। দেবেন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি রবীন্দ্রনাথের বিয়ের ব্যবস্থা করবার কথা ভাবেন ও দেশে ফেরবার পরেই রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহে পাঠিয়ে দেবারও সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথও ভিতরে ভিতরে এতটাই রেগে যান যে ভাবেন,‘তিনি যাহাকে প্রথম দেখিবেন তাহাকেই বিবাহ করিয়া ফেলিবেন, সামাজিক মর্যাদার অপেক্ষা না রাখিয়া। ’


কৃষ্ণ কৃপালানির বই ‘ঠাকুর-একটি জীবনএই সম্পর্কের কথা আমরা খুব অল্পই জানতে পারি। আসলে আমরা এই রকম অনেক কিছুই ভালো করে জানতে পারি না বা জানতে চাইনা। কিন্তু একটা কথা ভুললে চলবে না, লেখকের অনুপ্রেরণা না থাকলে লেখা হয় না এবং প্রেমের থেকে বড় অনুপ্রেরণা আর কিছু হতেই পারে না। এখানে একটি সমস্যা আছে, বিদেশে লেখকদের অনুপ্রেরণা নিয়ে যতটা উৎসাহ দেখায় এখানে আমরা তার সিকিভাবও ভাবিনা। রবীন্দ্রনাথ ও আন্না তড়খড়ের সম্পর্কও একটি জটিল রহস্যই হয়ে আছে। তবে একটাই আশার কথা খুব অল্পদিন আগে একটু তথ্য ভিত্তিক স্বল্প দৈর্ঘ্যে ছায়াছবি মুক্তি পেয়েছে, যার মূল বিষয় হল রবীন্দ্রনাথ ও আন্না তড়খড়ের সম্পর্ক