লা বনোট: কেন এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি আলু!

জাফরান, বেলুগা ক্যাভিয়ার (সামুদ্রিক মাছের ডিম), ট্রাফলস (কন্দক জাতীয় ফল) এগুলোকে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু এটা খুব কম মানুষই জানে যে একটা আলু এ সবগুলো খাবারের চেয়ে অনেক বেশি দামি হতে পারে। তবে এটা কোন সাধারন আলু নয় বরং এর নাম লা বনোট।

লা বনোট: কেন এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি আলু!
লা বনোট: কেন এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামি আলু!

লা বনোট উৎপাদনের স্থান ও সময়কাল

আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত ফ্রান্সের একটি ছোট্ট দ্বীপ হলো নরমুতিয়ের। মাত্র ৪৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের মতো।


এই দ্বীপটির মোট আয়তনের মাত্র ৫.৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গা কৃষিকাজের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। আর এই ৫.৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গার মধ্যেই কৃষকেরা উৎপাদন করেন লা বনোট নামক পৃথিবী বিখ্যাত আলু।


১৯২০ সালে সর্বপ্রথম এই প্রজাতির আলু উৎপাদন শুরু করা হয়। পরবর্তীতে এই আলুর প্রচার এবং প্রসার ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বব্যাপী।


উল্লেখ্য, এই নরমুতিয়ের দ্বীপ ছাড়া আর কোথাও সাধারণত লা বনোট আলু উৎপাদন করা হয় না। মূলত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে এই প্রজাতির আলুর বীজ রোপণ করা হয় এবং মে মাসের দিকে উত্তোলন করা হয়। প্রায় আড়াই হাজার কৃষক একসাথে এই আলু উত্তোলন এর কাজ করেন।


লা বনোট আলু রোপণের পদ্ধতি

লা বনোট আলুর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি বেশ ভঙ্গুর প্রকৃতির।  আলুর বীজ যদি মেশিনে রোপণ করা হয়, তবে সেটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।


এছাড়াও নরমুতিয়ের দ্বীপের মাটি বেশ বালুময়। তাই প্রতিটি আলুর বীজই হাতে রোপণ করতে হয়। ফেব্রুয়ারীর শুরুর দিকে কৃষকেরা জমি কোদাল দিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে মাটি আলগা করে নেন।


এরপর সেই মাটিতে একটি একটি করে আলুর বীজ রোপণ করা হয়। মার্চ এবং এপ্রিল এই দুইমাস কৃষকেরা চারার রক্ষণাবেক্ষণ, কীটনাশক প্রয়োগ এবং আগাছা দমনের কাজে ব্যস্ত থাকেন।


মে মাস থেকে কৃষকেরা আলু উত্তোলনের কাজ শুরু করেন। লা বনোট প্রজাতির আলুগুলো আবার বেশিদিন রাখা যায় না। কারণ এতে করে আলুগুলোতে পচন ধরতে পারে।


তাই মে মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু করে মে মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত আলু উত্তোলনের কাজে মেতে উঠেন কৃষকেরা।


আলুর বীজ রোপণের মতো আলু উত্তোলনের কাজও হাতেই করতে হয় এবং একটি একটি করে আলু তুলতে হয়।


তবে অনেক সংখ্যক কৃষকেরা একসাথে কাজ করেন বলে বেশ ভালো পরিমাণ আলু চাষ করতে সক্ষম হন তারা। কখনও কখনও ২০ হাজার কেজি পর্যন্ত চাষ করতে সক্ষম হন তারা।


কেন লা বনোট আলু এত দামি

লা বনোট আলু বিশ্বের সবচেয়ে দামি আলু হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত অন্যান্য সবজি বীজের মতো এই আলুর বীজ মেশিনে রোপণ করা অসম্ভব।


কাজেই প্রতিটি আলুর বীজ হাতে রোপণ করতে অনেক বেশি সময় এবং অনেক সংখ্যক কৃষকের প্রয়োজন পড়ে।


দাম বেশি হবার আরেকটি কারণ হলো এই প্রজাতির আলুগুলোর স্বাদ সাধারণ আলুর মতো নয়। এতে কিছুটা নোনতা স্বাদ, কিছুটা কাঠবাদামের স্বাদ এবং কিছুটা মিষ্টতা অনুভব করা যায়।


স্বাদের ভিন্নতার কারণ হলো যেই দ্বীপে চাষ করা হয়, সেই দ্বীপের আবহাওয়া এবং মাটির প্রকৃতি ভিন্ন। দ্বীপটি আটলান্টিক মহাসাগরের পাশে অবস্থিত হওয়ায় দ্বীপের মাটিতে লবণাক্ত রস বিদ্যমান।


এই রস আলুর বীজে প্রবেশ করে আলুতে এক নোনতা ভাব নিয়ে আসে। এছাড়াও কৃষকেরা আলুর বীজ রোপণের আগে যে মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আলগা করে নেন, সেই মাটিতে সারের সাথে কিছু বিশেষ অ্যালগি বা শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ মেশান।


সাধারণ আলুতে এ রকম কোন কিছু মেশাতে দেখাযায় না। এসব কারনেই মূলত সাধারণ আলুর তুলনায় লা বনোট আলুর দাম অনেক বেশি।


লা বনোট আলুর মূল্য

পৃথিবীতে শর্করার চাহিদা মেটানোর জন্য যেসব খাদ্য সহজলভ্য, তাদের মধ্যে আলু অন্যতম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হিসাব করলে প্রতি কেজি আলুর দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।


কিন্তু লা বনোট প্রজাতির আলু এতটা সহজলভ্য নয়। ১৯২০ সালের একটি নিলাম অনুষ্ঠানে প্রতি পাউন্ড লা বনোট আলুর দাম উঠে ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত।


তবে বর্তমানে দাম কিছুটা কমে এসেছে, প্রতি পাউন্ড লা বুনো আলুর মূল্য ৫ ডলার করে। যদি কেজি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে প্রতি কেজি লা বনোট আলুর দাম ১১ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় হিসেব করলে প্রায় ৮৮৮ টাকা। তারপরও এই মূল্য অনেক বেশি কারণ পৃথিবীর  কোন দেশ এত টাকা দিয়ে আলু কিনে না।


লা বনোট ফেস্টিভ্যাল

প্রতিবছর লা বনোট আলু উত্তোলন এবং সারা বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করার পর কৃষকেরা তাদের নিজেদের মধ্যে আনন্দ এবং খুশি ভাগাভাগি করে নেবার জন্য "লা বনোট ফেস্টিভ্যাল" নামক একটি উৎসবের আয়োজন করে।


মূলত সারা বছরের খাটাখাটুনির পর একটু আনন্দ আয়েশ করতেই আশেপাশের সব কৃষক পরিবার মিলে এই আয়োজন করে থাকে।


ফেস্টিভ্যালে মূল অংশ জুড়ে থাকে লা বনোট আলুর বিভিন্ন রকম রান্না এবং সেগুলো পরিবেশন করা। ২০১১ সালে টেসকো নামক একটি ব্রিটিশ কোম্পানি কৃত্রিমভাবে লা বনোট আলু বানানোর চেষ্টা করে। পুরোপুরি না পারলেও কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছিল তারা।


অবশ্য তাদের আলুর দাম আসল লা বনোট এর চেয়ে কম, প্রায় আড়াই ডলার এর মতো। তবে গুণগত দিক থেকে লা বনোটকে কখনই হারাতে পারে নি তারা।


বড় বড় সকল রেস্তোরাঁতে যখন আলুর কোন ডিস বানানো হয়, তখন লা বনোট আলুই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দামে, গুণে ও মানে লা বনোট এখনো পৃথিবীর শীর্ষ স্থান দখল করে আছে।


আরও পড়ুনঃ দিল্লির লোভনীয় সেরা ৫টি বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় খাবার