লৌকিক নাকি অলৌকিক? রহস্য গল্প

দুটো অস্বাভাবিক মৃত্যু। খুন নাকি আত্মহত্যা? জানতে হলে চোখ রাখুন গল্পে।

লৌকিক নাকি অলৌকিক? রহস্য গল্প
লৌকিক নাকি অলৌকিক? রহস্য গল্প


নটরাজ মন্দিরের মেইন গেট থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে একটা ছোটখাটো জটলা হঠাৎ করে জমে গেলো...একজন ভক্ত মন্দির থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হেঁটেই উপুড় হয়ে পড়লো আর ওঠেনি, স্পট ডেথ । ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে দশটা, অফিস টাইমের জনবহুল রাস্তা, চট করে তাই পথচলতি অনেকেরই চোখে পড়েছে । ভিড়ের মধ্যে কেউ অ্যাম্বুলেন্স কেউ মৃতের আইডেন্টিটির জন্য শশব্যস্ত হয়ে উঠলো ।


বছর উনিশের এক যুবতী ভিড়ের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলো, কারুর চোখে পড়লো না ।


বিকালের আজানের সুর ভেসে আসছে । রাস্তায় ভিড় এখন খুব বেশি নয় ।
     

সূর্য প্রায় ডুবে গেছে --- ঘড়িতে পৌনে ছ'টা বাজলো । মসজিদ থেকে লোকটা বেরিয়ে এলো কাঁপতে কাঁপতে বুকে হাত চেপে । কয়েক সেকেন্ড পরেই উপুড় হয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগলো । লোকজন ছুটে এসে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হসপিটালে পাঠালো । তারপর... ভোররাতে সব শেষ । 


হসপিটালে বেডের পাশে ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির সাথে লোকটার ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে যাওয়াটা উপভোগ করছিল ।


"কিভাবে সম্ভব ?এমনও হয়? সত্যিই বড় বিচিত্র এই বিশ্ব"--- ষ্টাডিরুমের চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আপনমনেই বললো কথাগুলো সত্যজিৎ ।

সত্যজিৎ বিশ্বাস,পরিচিতেরা "সত্য বিশ্বাস" বলে ডাকে । সত্যজিতের নিজের একটা স্কুল রয়েছে , স্টুডেন্টদের ড্রইং এবং ক্রাফট এর কাজ শেখায় যত্ন সহকারে । এছাড়া একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সাথে সে যুক্ত হয়েছে দু'বছর ধরে । দু'য়েকটা কেস সলভ করে পুলিশকে সাহায্য করে নামডাকও হয়েছে বেশ।

শহরে পরপর দু'দিন দুটো অস্বাভাবিক মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশ এবং গোয়েন্দা দপ্তরকে । পেপারে হেডলাইন পড়েই সত্য লোকাল থানায় কল করলো ---
"হ্যাঁ হ্যাঁ ভায়া আমরা এখুনি তোমার কথাই আলোচনা করছিলাম । নাম নিতেই তুমি হাজির । তা বলো কী ব্যাপারে?"

"ওই জোড়া অস্বাভাবিক মৃত্যু , ওটার ব্যাপারেই কদ্দুর এগোলেন ?"

"তেমন কিছু হাতা-মাথা পাচ্ছিনা বলেই তো তোমাকে তলব করবো ভাবছিলাম । যদ্দুর জানতে পেরেছি প্রথম ব্যাক্তির নাম রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কাঠ-ব্যবসায়ী , ৩টে বড় কাঠের গোলার মালিক । এছাড়াও মনিরাম স্ট্রিটের অ্যান্টিক শপটাও ওনারই । স্ত্রী,দুই ছেলে আর চাকর-বাকর নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট ফ্যামিলি। ভদ্দরলোক সংস্কারি, শিবভক্ত ।
পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে বডিতে একোনাইট পাওয়া গেছে । কিন্তু কিভাবে এলো সেটাই চিন্তার বিষয়।"

"এ...কো...না...ই...ইট ন্যাপ ! মন্দিরের প্রসাদে ছিল কি? খোঁজ নিয়েছেন!"

"না আজ সকালেই রিপোর্ট এলো । তুমি তাহলে চলে এসো থানায় এখুনি । সবাই মিলে ঢু মেরে আসি মন্দিরে ।"

"ওকে আসছি । গিয়ে সেকেন্ড মৃত্যুর ব্যাপারে শুনবো ।"



নটরাজ মন্দিরের সকালের পুজো সবেমাত্র শেষ হয়ে ভোগ বিতরণের আয়োজন চলছে । সত্য আর দারোগা প্রিয়তোষ তপাদার প্রধান পুরোহিতকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন ।
"ওইদিন ক'টা নাগাদ রামেশ্বর ভট্টাচার্য মন্দিরে এসেছিলেন?

"আজ্ঞে, উনি তো প্রতিদিনই গোলায় যাবার আগে মন্দিরে আসতেন ৯টা সাড়ে ৯ টায় । দিয়ে কোনোদিন প্রণাম করেই চলে যেতেন,কোনোদিন আবার পুজো দিয়ে খানিক বসে ১০ টায় যে ভোগ বিতরণ হয় তা খেয়ে যেতেন। পরশুদিন এলেন ,কিছুক্ষন বসলেন, তবে ভোগ নিলেন না, স্নান জল পান করেই চলে গেলেন তাড়াহুড়ো করে আর তারপরেই তো দেখি ঐ কাণ্ড।"
 
"আচ্ছা ওই পাত্রের স্নান জল আর কেউ খায়নি?"
হ্যাঁ, জনা কুড়ি ভক্ত ছিল । সবাইকেই নিজে হাতে করে দিয়েছিলাম । কই কিছু হয়নি তো,দিব্যি সুস্থ আছে সব।"

সত্য উঠে গিয়ে স্নানজলের পাত্র,পুজোর সরঞ্জাম সব নিরীক্ষণ করে এলো । "নাহহ...সবই ঠিক আছে । রিপোর্টে শরীরে বিষ ঢোকার যে টাইমের উল্লেখ আছে সেসময়টুকু রামেশ্বরবাবু মন্দিরে ছিলেন । তাহলে বিষ এলো কোথা থেকে?" চিন্তায় ৩ টে ভাঁজ ফুটে উঠলো সত্যর কপালে ।

প্রিয়তোষবাবু ,সত্য আর কনস্টেবল দু'জন মন্দির থেকে বেরিয়ে জিপে গিয়ে উঠলো । 
"এবার কোথায় যাবেন ?''
"থানাতেই ফিরি..."
"আরেকজন কীভাবে মরেছেন ?"

"উনি জসীমউদ্দীন শাহ্ । টমসন স্ট্রিটে জুয়েলারির বড় শোরুম রয়েছে আর পারিবারিক সম্পত্তি, চাষাবাদের জমি রয়েছে অনেকটা । বাড়িতে স্ত্রী,এক ছেলে,আর অবিবাহিত দু'ভাই আছে । ভাইরা জমিজমার দিকটা দেখে ।"

"মৃত্যুর কারণ খুঁজে পেলেন?"

"ডক্টর তো হার্ট অ্যাটাক বললেন সেইমত ট্রিটমেন্ট করছিলেন কিন্তু একজন সুস্থ মানুষের হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের কারণ জানা যায়নি এখনো। দেখা যাক রিপোর্ট কী বলে।"

"মসজিদে কি কোনো উত্তেজক ঘটনা !!... আচ্ছা গাড়িটা ঘুরিয়ে চলুন তো ওদিকে একবার ।"

মসজিদের সামনে প্রায় মিনিট কুড়ি দাঁড়িয়ে আলোচনা করার পরে হঠাৎ সত্যর চোখ আটকে গেলো মসজিদের দেওয়ালের এক কোণায় ।একটা অদ্ভুতরকমের শামুক। কাছে গিয়ে ও বুঝলো এটা যে সে শামুক নয়, এটা বিষাক্ত মার্বেল কোন স্নেইল যার একফোঁটা বিষ মানুষ মারার জন্য যথেষ্ট।

"কিন্তু এই শামুক এখানে কীভাবে এলো, এর থাকার কথা সেই অস্ট্রেলিয়ায়।"

"সত্য,আমি এখানের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম , কেউই এই প্রাণীর ব্যাপারে কোনোদিন কিছু শোনেনি । তাহলে...?"
"নাহ,যত দেখছি শুনছি কেস ঘোরালো হচ্ছে! চন্দনগঞ্জের মন্দিরে কুড়িজন স্নান জল খেল কিন্তু একজনের পেটে একোনাইট ... লালগড়ের মসজিদের দেওয়ালে অস্ট্রেলিয়ার কোন স্নেইল !"



"কী যে দিনকাল পড়লো, দু' দু'খানা মৃত্যু তাও আবার অস্বাভাবিক ! গোয়েন্দা পুলিশমহল সব কী করছে?"---কিছুটা বিরক্তির সাথে বলে উঠলেন ধনঞ্জয়বাবু ।

"আরে মশাই, আজকের পেপারটা দেখলেন? মৃতদের ডিটেইলস যেটুকু দিয়েছে দেখলাম বেশ মালদার লোক দুজনেই । ওই সম্পত্তিই হয়তো অভিশাপ হয়েছে রামেশ্বর ভটচাজ আর জসীমউদ্দীন শাহ্-এর কপালে।" বললেন বীরেনবাবু।

বীরেন তরফদার, ধনঞ্জয় মিত্রের প্রতিবেশী । প্রায়দিনই সকালে বিপত্নীক ধনঞ্জয় বাবুর বাড়ি চলে আসেন চায়ের টেবিলে। দেড়-দু'ঘন্টা আড্ডা মেরে,পেপার পড়ে বাড়ি ফেরেন বীরেনবাবু। 

"নাম দুটো কী যেন বললেন?"--- চমকে উঠে বললেন ধনঞ্জয়বাবু।

"রামেশ্বর আর জসীমউদ্দীন... কেন?"

"নাহ্ মানে ঠিক শুনছি আমি?... নিউজটা কোথায় দেখি পেপারটা ।"

"বুঝলেন মশাই আসলে অস্বাভাবিক বলে কিছু হয়না কোনোদিন, সবকিছুই স্বাভাবিক। যার সাক্ষাতে ঘটে সে জানে স্বাভাবিকত্বটা ।"--- বলে চললেন বীরেনবাবু কিন্তু বিস্ফারিত চোখে পেপার হাতে নিয়ে বিস্মিত ধনঞ্জয় মিত্রের কানে তখন কিছুই ঢুকছে না ।



ডিং ডং... ডিং ডং

"আসছি"
কলিং বেলের শব্দে মহিলা কণ্ঠের সাড়া এলো ভিতর থেকে।

দরজা খুললেন একজন ভদ্রমহিলা,"আপনি?"
"হ্যাঁ আমি সত্যজিৎ বিশ্বাস আর আমার সঙ্গে... এনাকে তো চেনেন আশা করি, দারোগা প্রিয়তোষবাবু ।"
"হুমম..."

"আপনি রামেশ্বরবাবুর ওয়াইফ? কিছু জিজ্ঞাসা করবো ওনার মৃত্যুর কেসটা নিয়ে।"
"হ্যাঁ বলুন"

"ওনার সাথে কি কারুর কোনো শত্রুতা ছিল ?"

"না তেমন কিছু শুনিনি কখনও। ১৬ বছর ধরে ওর সাথে আছি ,ভদ্রভাবে সবার সাথে মিশতো দেখেছি আর ওই ঠাকুর দেবতা নিয়ে থাকতে পছন্দ করত ।"

"আপনাদের বিয়ের ১৬ বছর হচ্ছে তাহলে রামেশ্বরবাবুর বড়ো ছেলের বয়েস যে শুনলাম ১৮... তবে কি আপনি ওনার সেকেন্ড ওয়াইফ?"

"হ্যাঁ ও আমার সৎ ছেলে। আমার একটাই ছেলে,১৫ বছরের মনোজ। আর আমিই ওর প্রথম স্ত্রী,কিন্তু মানে বড়ো ছেলের মা..." বলতে বলতে রামেশ্বরবাবুর স্ত্রী মলিনাদেবী মাথাটা নিচু করে মুখে আঁচল টেনে চুপ করে গেলেন।

"কী হলো বলুন,থামলেন কেন?" আগ্রহী গলায় বললেন প্রিয়তোষ দারোগা।
ডুকরে উঠলেন মলিনাদেবী,"সেসব লজ্জার কথা কোন মুখে বলবো নিজের হাসব্যান্ড সম্পর্কে।বিয়ের আগে জানতে পারলে এই বিয়ে হতো না কোনোদিন। ওই রিলেশনশিপ থাকতেও কেন আমায় বিয়ে করেছিল বুঝিনা বাবা।আমি প্রেগন্যান্ট সেসময় হঠাৎ একদিন বাড়িতে ও নিয়ে এলো বড়ো ছেলে রাতুলকে, কোথাকার কোন মেয়েছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টির ফল। সেই বেশ্যা মেয়েমানুষটা তো রোগভোগে মরল আর অবৈধ ওই বাচ্চাকে আমার সংসারে এনে তুললো আমার সৎ চরিত্রবান স্বামী। মনোজ তখন গর্ভে না এলে আমি এই অনাচার সহ্য না করে ডিভোর্স দিতাম।"

"বুঝলাম এরকম ব্যাপার। দুই ছেলের মধ্যে তো ভীষণ ভাব মনে হলো, একসাথে বসে বাইরের বারান্দায় গল্প করছে।"

"হ্যাঁ ওদের আর কী দোষ, আর এখন অত কিছু ওদের জানানো হয়নি। রাতুল পরে সব জানতে পারলে যে তখন কী হবে..."

"আচ্ছা আজ তবে আসি। পরে দরকার পড়লে আসবো আবার। সাবধানে থাকবেন।"

"হুমম, আর কীই বা জানার আছে। আপদ নিজে মরল আমার ঘাড়ে এত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে। এখন এই জেরার উটকো ঝামেলা কদ্দিন যে পোয়াতে হবে কী জানি!"

"ধন্যবাদ এতো ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য। আসছি।"



"কিহে সত্য, কী বুঝলে কালকে মলিনা ভট্টাচার্যর কথা শুনে? ভদ্রমহিলা বেশ চটে আছেন হাসব্যান্ড-এর ওপরে।খুন করাটাও অস্বাভাবিক নয়।"

"হুমম সম্পত্তির ভাগ রাতুলকে না দেওয়ার জন্য হয়তো স্বামীকে সরিয়ে দিলেন যাতে করে সৎ ছেলেকে সরানোর পথ সহজ হয়।"

"তাহলে কি আরেকটা খুন হতে চলেছে ওই পরিবারে?"

"কিন্তু তাও অতোটাও উগ্র বলে মনে হলোনা মহিলাকে। এখন ওই রাতুলের মা কে, কোথায় বাড়ি সেসব একটু জানাটাও জরুরি আমার,যদি কিছু ক্লু পাই।"

"জসীমউদ্দীনের বাড়ি যাবে তো আজ?"

"হ্যাঁ এখনি চলুন। হতেও পারে দুটো মৃত্যুই খুন আর দুটোর মাঝে কোনো লিংক আছে !"


"বাড়িতে কেউ আছেন ,থানা থেকে আসছি!"--- জসীমউদ্দীনের বাড়ির সামনে জিপ থেকে নেমে হাঁক পাড়লেন প্রিয়তোষবাবু ।
"দরজা খোলাই আছে ভেতরে গিয়ে দেখি চলুন।"

"হ্যাঁ সত্য,তাই চলো।"
ভিতরে ঢুকতেই মুখোমুখি হলেন এক ভদ্রলোক।

"কে আপনারা?... ওউ দারোগাবাবু আপনি।"
"হ্যাঁ আর সঙ্গে ও সত্য বিশ্বাস,টুকটাক গোয়েন্দাগিরি করে। কিন্তু আপনি?"

"আচ্ছা মেজ'দার মৃত্যুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ কত্তে এসচেন ।আমি ছোট ভাই, শাকিব শাহ। আসেন ভেতরে।"

"আপনাকেই প্রথমে তাহলে জিজ্ঞাসা করি কিছু। এই মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার কী মত এটা কি খুন? কাউকে সন্দেহ করেন?"--- তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে সত্য প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিলো ।
"আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। বাড়ির অন্যরা আছে ওদের জিজ্ঞাসা করেন ওরা চাইলে উত্তর করুক। এসবে কিন্তু আমায় জড়াবেন না দারোগাবাবু। আমায় যেতে দিন আমার তাড়া রইচে।"--- এই বলে প্রায় ঝড়ের বেগে জসীমউদ্দীনের ছোটভাই বাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে গেলো।

"অদ্ভুত আচরণ!",মনে মনে বললো সত্য। ওরা দু'জন ভিতরের দিকে এগিয়ে গেল। লম্বা বারান্দা পার হয়ে সামনে পড়লো বৈঠকখানা,ডানদিকে  সিঁড়ি। সিঁড়ির দিকে এগোতেই চোখে পড়লো সিঁড়ির মুখের ঘরের দরজা খোলা,ভিতরে যিনি বসে পান সাজছেন উনিই মৃতের স্ত্রী।

"শুনছেন,বলছি একবার বাইরে আসবেন,দরকার আছে!"--- গলা তুলে ডাকলেন দারোগাবাবু।

"হ্যাঁ যাই, বসুন ও ঘরে।"--- সাড়া দিলেন জাহানারা বিবি।
সত্যরা বৈঠকখানার সোফায় গিয়ে বসলো। মিনিট পনেরো পরে জসীমউদ্দীনের স্ত্রী এলেন কিছু মিষ্টি আর চা নিয়ে। মুখ চোখে দুঃখের লেশমাত্র নেই, রিল্যাক্সড মুডে রয়েছেন মহিলা।
সত্য কাজ শুরু করে দিল,"আচ্ছা আপনার হাসব্যান্ড-এর এই মৃত্যু নিয়ে আপনার কী অভিমত?"

"এটা তো হওয়ারই ছিল।"
"মানে?"
"কিছুনা। অতি লোভে তাঁতী নষ্ট হয়,হয়েছে। প্লিজ, এসব নিয়ে আমায় বিব্রত করবেন না।"
"না না একটু ক্লিয়ার করে বলুন এখুনি বললেন এটা হবার ছিল। কেন বললেন?"
"দেখুন মিষ্টি দিলুম,খান,অন্য কথা থাকলে বলুন নাহলে আসুন।"

"ভায়া, এই মহিলার থেকে কিছু লাভ হবে বলে মনে হচ্ছেনা। চলো উঠি। মৃতের বড়ো ভাইকে খুঁচিয়ে কিছু মেলে কি না দেখি চলো",ফিসফিস করে বললেন দারোগা,সত্যর কানে কানে।

"আপনার ছেলেকে দেখছিনা? কীসে পড়ে ও?"

"কলেজে সেকেন্ড ইয়ার চলছে। ও টিউশন পড়তে গেছে। ওকেও দরকার আপনাদের?"--- ঝাঁঝালো গলায় উত্তর এলো।

"আচ্ছা আমরা আসি তাহলে। বলছি আপনার হাসব্যান্ড-এর বড়ো ভাই কোথায়? একটু ডেকে দিন না।"
"বাড়িতে নেই এখন। বাইরে একটু বেরোলো। ওঁকে কী দরকার ?"

"ওকে থ্যাংকস। এলাম।"
বাড়ি থেকে বেরিয়ে জিপে উঠে জিপ স্টার্ট করতেই একজন ভদ্রলোককে বাড়িতে ঢুকতে দেখে জিপ থামিয়ে সত্য তড়িঘড়ি নেমে বাড়ির দিকে ছুটে গেলো।

"বলি শুনছেন?"
"হ্যাঁ কে কে?"--- গেট খুলে ঢুকতে গিয়ে থমকে পিছন ফিরে সাড়া দিলেন ভদ্রলোক।

"আমি সত্য বিশ্বাস, দারোগা বাবুর সাথে এসেছি। গোয়েন্দাগিরি করি টুকটাক। জসীমউদ্দীন শাহ মৃত্যু নিয়ে তদন্তের ব্যাপারে এসেছিলাম আপনি ওনার বড়ভাই তো?কিছু হেল্প করবেন?এই বাড়ির কেউ কিছুই হেল্প করেননি আমাদের এখনো অব্দি।"

"হ্যাঁ হ্যাঁ ,করব তবে এখানে নয়। থানায় নিয়ে যাবেন আমায়? বাড়ির কেচ্চা বাড়ির লোকের সামনে  আর না বলাই ভালো।"
" নো প্রব্লেম। চলে আসুন জিপে।"
সারা রাস্তায় জিপে কোনো কথা হলো না। সত্য চোখ বুজে কপালে ভাঁজ ফেলে হিসেব মেলানোর চেষ্টায় মগ্ন ছিল।


মাঝরাতে ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন ধনঞ্জয় মিত্র,ঘুম আসছে না সকালের নিউজপেপারটা পড়ার পর থেকে। বারবার ভাবছেন,"এমনটা সত্যিই ঘটেছে?" কোনোদিন এরকম হবে ভাবেননি উনি। আনন্দও হচ্ছে এই ভেবে---যে কাজটা,যে প্রতিশোধটা উনি মন থেকে চাইলেও নিতে পারেননি,বিবেকবোধ তাঁকে আটকে দিয়েছে,সেই প্রতিশোধটা আজ তাঁর হয়ে কেউ যেন নিয়ে নিল। "কিন্তু কে নিল?"


ধনঞ্জয় মিত্রের এককালে অনেক রমরমা ছিল। সে প্রায় বছর কুড়ি আগের কথা। তখন উনি কাঠের ব্যবসায়ী ছিলেন। ৩টে কাঠের গোলা ছিল। পাশাপাশি ছিল জুয়েলারি শোরুম। স্ত্রী মধুলিকা আর মেয়ে মঞ্জুলিকাকে নিয়ে সুখেই কাটত দিনগুলো। হঠাৎ সুখের সংসারে ঘটে গেলো এক ঘোরতর অঘটন। তারপর থেকেই একা একা দিন কাটছে এই ৩ তলা বড়ো বাড়িতে। বাড়িটা যেন মাঝে মাঝে বিকট দানবের মত মনে হয় গিলে খেতে আসে ধনঞ্জয়বাবুকে।
 

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘরের ভিতরে ঢুকে জলের বোতল নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই টেবিলে একটা কাগজ ঠেকলো হাতে। খাট থেকে টর্চটা নিয়ে জ্বালিয়ে ধনঞ্জয়বাবু দেখলেন একটা কাগজের ছোট টুকরোতে লাল পেন্সিলে লেখা তিনটে শব্দ,
"তুমি খুশি হয়েছ?"

চমকে উঠলেন তিনি,"তবে কি ও ফিরে এসেছে? ও যে আমায় কথা দিয়েছিল... তাহলে কি সত্যিই!"



দুপুরবেলা, থানায় ভিড়টা কম এখন। চায়ের কাপ নিয়ে সত্য ,দারোগাবাবু আর সোহরাব শাহ অর্থাৎ জসীমউদ্দীন শাহর বড়ভাই বসলেন।
"বলুন কীভাবে হেল্প করতে পারি আপনাদের?"

"আপনার ভাইয়ের ওয়াইফ বলছিলেন এই মৃত্যুটা নাকি হবারই কথা ছিল,কিন্তু কিছু ক্লিয়ার করলেন না। আপনি কি জানেন উনি কেন এমন বলছেন?"

"হুমম। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলনা। চাষাবাদের ওপরেই ডিপেন্ডেন্ট আমরা। আমি আর জসীম স্কুলে কিছুদূর পড়াশোনা করলেও, ছোট কোনোদিন স্কুলমুখো হলোনা,সেই ছোটবেলা থেকেই জমিজমা নিয়ে পড়ে আছে আজ অব্দি। আল্লাহর কৃপায় ওই জমি থেকেই আজ আমাদের কোনো অভাব নেই, বলতে গেলে প্রয়োজনের তুলনায় বেশীই সম্পত্তি হয়েছে।

জসীম চাষবাসের ওপরে পুরোপুরি নির্ভর করতে চাইত না। তাই একটা জুয়েলারির শোরুমে কাজ করতো। মালিক ধনঞ্জয় মিত্র খুব ভালোমানুষ। আমাদের বাড়িতেও যাওয়া আসা করতেন মাঝে মাঝে। জসীমকে খুব বিশ্বাস করতেন। কিন্তু বেইমান জসীম বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে জানত না।"--- কথাগুলো বলে লম্বা শ্বাস ফেলে থামলেন সোহরাব।

"তারপর?"--- একসাথে জিজ্ঞাসু গলায় বলে উঠলেন দারোগা বাবু আর সত্য।

"সে প্রায় উনিশ-কুড়ি বছর আগের ঘটনা। ধনঞ্জয়বাবু ব্যবসার কাজে একমাসের জন্য বাইরে গেলেন অনেকদিনের পরিচিত বিশ্বস্ত জসীমকে শোরুমের দায়িত্ব দিয়ে। ও আহাম্মক জুয়েলারির ব্যবসাটাই গ্রাস করে নিল। কাগজে কলমে বেআইনিভাবে মালিক হয়ে গেলো জসীম। ধনঞ্জয় মিত্তির, জানেন,মাটির মানুষ পুরো। এত বড়ো ধাক্কা এত বেইমানির পরেও প্রতিশোধ নেননি শুধু আমাদের সাথে যে আত্মীয়ের মত রিলেশনটা হয়েছিল তা শেষ করে দিলেন। আর কোন ভরসাতেই বা সম্পর্ক রাখবেন বলুন। জাহানারা মেনে নিতে পারেনি এই অপকর্ম। ও নামেই এই বাড়িতে থাকে,সারাদিন গম্ভীর মুখেই থাকে, জসীমকে স্বামীর পরিচয় দিতে ওর ঘেন্না লাগে। ছেলেটাকে মানুষ করতে চায় ভালোভাবে, যেন বাপের মত অমানুষ না তৈরি হয় সেই চেষ্টা করে ও। জসীম মরার খবরে ও যেন একটা বড়ো বোঝামুক্ত হয়েছে। মনমরা গম্ভীর ভাবটা কেটে গেছে। আর ওকে কী বলবো আমার নিজের সহোদর ভাই পরিচয় দিতে আমার গা হাত রি-রি করে।"

"তাহলে বলছেন ধনঞ্জয়বাবু প্রতিশোধ নেননি এসবের পরেও! আচ্ছা, এরকম নয় তো যে উনিই এখন প্রতিশোধ নিচ্ছেন ওনার জীবনে ঘটে যাওয়া এই  বিশ্বাসঘাতকতার?"

"নিতেই পারেন। নিলে নিক,বেশ করেছেন।"
"ওনার স্ত্রী তো বললেন ওনাকে ঘেন্না করেন। উনি কি..."
"না না ও স্বামীকে ঘেন্না করতে পারে কিন্তু খুন,না না।"

"দেখুন আমার কাজটা এমনই সবাইকে সন্দেহ করতেই হয় সে দোষ করুক আর নাই করুক। আচ্ছা ধন্যবাদ আপনাকে। এখন আসতে পারেন,আপাতত আর কিছু লাগবেনা। পরে ডাকতে পারি প্রয়োজনে।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। আসছি।"


"তাহলে আমাদের সাসপেক্ট এখন ধনঞ্জয় মিত্র। ওর ব্যাপারে খোঁজ করুন ইমিডিয়েটলি। মনে হচ্ছে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।"



রবিবারের অলস সকাল,ঘড়িতে ৯টা ৪০,ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে আছে সত্য। আশার আলো দেখতে পাওয়ার কথা ও বললো ঠিকই কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন সব কিছু হিসাবে গরমিল হয়ে যাচ্ছে। এযাবৎ যা ইনভেস্টিগেশন করেছে এমনটা কখনো হয়নি।  তাহলে গলদটা কোথায় হচ্ছে? আগেতো খুব সহজেই সলভ করেছে প্রতিটা কেস।

ধনঞ্জয়বাবুর বাড়িতে ও গতকাল গিয়েছিল। ওনার সাথে কথা বলে সত্য বুঝেছে মানুষটা সত্যিই মাটির মানুষই বটে--- এত বড়ো ঝড় বয়ে গেছে জীবনের ওপর দিয়ে কিন্তু শয়তানের ওপরে কোনো রিভেঞ্জ নেওয়ার এতটুকু ইচ্ছে নেই ওঁর। যতবার সত্য জিজ্ঞাসা করেছে"কেন ছেড়ে দিলেন শত্রুদের এভাবে?" উনি উত্তরে বলেছেন,"যা যাবার সব চলে গেলো আমার এরপরে আর কার জন্য করবো বলতে পারেন? ওই পুলিশ কোর্ট কেস ওসবের অত ঝক্কি কি আর একা একা সামলাতে পারতাম? একটা বইয়ের দোকান করেছি ছোটখাটো, ওতেই একটা পেট চালিয়ে নিই যদ্দিন আছি বেঁচে। ভগবান যে কেন বাঁচিয়ে রেখেছে আমায়!একটুও ভালো লাগেনা কিচ্ছু। স্ত্রী বেইমানি করলো,অমন ফুলের মত মেয়েটা খুন হলো,আমি এই অভিশপ্ত বাড়িতে একা পড়ে এখনো।"

এতটা বলেও ধনঞ্জয়বাবু অবশ্য রাত্রের ওই ৩শব্দের ছোট্ট চিরকুটের কথাটা সম্পূর্ণ চেপে গেলেন সত্যর কাছে। সত্য জিজ্ঞাসা করেছিল,"আপনার স্ত্রী বেইমানি করেছিল?"

"হ্যাঁ,আমার কাঠের গোলা ছিল জানেন। কাঠের ব্যবসাটা আমার বাবার আমলে শুরু হয়েছিল। বাবার বিজনেস পার্টনার ছিলেন বটুকেশ্বর ভট্টাচার্য। ওঁর ছেলে রামেশ্বর আমার ক্লাসমেট ছিল। পরে যখন বাবা ব্যবসার দায়দায়িত্ব সব আমার  হাতে তুলে দিলেন আমি রামেশ্বর-এর সাথে পার্টনারশিপ করি। ও আমাদের বাড়িতে সেই ছোটবেলা থেকেই যাতায়াত করতো,বন্ধু হিসাবে খুব বিশ্বাস করতাম আর সেই সুযোগে কখন যে আমার স্ত্রীয়ের সঙ্গে অতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছিলো বুঝতে পারিনি। একবার ব্যবসার কাজে একমাসের জন্য বাইরে যেতে হয় আমায়। আমার স্ত্রী মধু , আর উনিশ বছরের মেয়ে মঞ্জু বাড়িতে ছিল। আমার না থাকার সুযোগে আমার সিগনেচার জাল করে পরিচিত উকিলের সাহায্য নিয়ে আমায় ডিভোর্স দেয় মধু আর বিজনেসের পার্টনারশিপ নিয়ে নেয় রামেশ্বর আর মধু। 

মঞ্জু ওই ডিভোর্স পেপারটা ওর মায়ের ঘরের টেবিলে দেখতে পেয়ে গেছিলো। সেই নিয়ে তুমুল অশান্তি হয় মা-মেয়ের মধ্যে, ইভেন মধু ওকে খুনের হুমকিও দেয়। এসবের সাথে আমার জুয়েলারীর বিজনেসের মালিকানাও হাতছাড়া হয়ে যায়...শয়তান জসীম..."

"হ্যাঁ ওই ঘটনাটা শুনেছি। তারপরে কী হলো বলুন?"

"আমি ফিরে এসে এসব কিছু শুনি মঞ্জুর মুখে। চেষ্টাও করেছিলাম অনেক মধুকে শোধরানোর,কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো, শুনলাম ফ্ল্যাট কিনেছে ওখানেই ও থাকে রামেশ্বর-এর সাথে। এক সন্তানও হয়েছিলো...ওই যে কী নাম বলছিলেন আপনি,রা...তুল, হ্যাঁ হ্যাঁ ওই রাতুল। এরপরে একটা অ্যান্টিক শপ খুলেছে দেখলাম, মধুই থাকতো শপে। আমি একটা বইয়ের দোকান চালু করলাম, বাঁচতে হলে দানাপানি তো দিতে হবে পেটে। ওই দোকানেই যা যেটুকু লাভ হতো ওতেই দুটো পেট চলছিল।

আমার মেয়েটা খুব ভেঙে পড়েছিল মানসিকভাবে। বাইরে মুখ দেখাতে লজ্জা পেত। মনমরা হয়ে নিজের ঘরেই কাটাত বেশিরভাগ সময়টা।"
"ওকে খুন কে করলো?"

"বলছি বলছি... মেয়েটা মানসিক চাপ নিতে পারেনি এতটাই অসহ্য হয়ে গিয়েছিল। একদিন দুপুরে দোকান থেকে ফিরে দেখি সারা বাড়িটা কেমন থমথম করছে যেন। মঞ্জু মঞ্জু করে হাঁক দিলাম ওকে দেখতে না পেয়ে। কিন্তু তখন আর কে সাড়া দেবে। ওর ঘরে গিয়ে দেখি ওখানে নেই ও। ছুটে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গিয়ে ছাদের ঘরে দেখি ওর মায়ের একটা শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলছে..."

"সামলে নিন নিজেকে। আর বলতে হবে না। দুঃখিত আমি, আপনাকে এসব জিজ্ঞাসা করে আঘাত দিয়ে ফেললাম।"

"আর ওর হাতে একটা কাগজ তখনও ধরেছিল শক্ত করে। কাগজটা নিয়ে দেখি ওতে ও লিখেছে ' বাবা আমি শত্রুদের শাস্তি দেবই একদিন দেখো।'
এটা সুইসাইড হলেও আমি মানিনা। এটা একটা খুন, মানসিক নির্যাতনের ফল ।"


ক্রিং ক্রিং...ক্রিং ক্রিং... ক্রিং
মোবাইলটা বাজছে বেডরুমে।সত্যর গভীর চিন্তায় ছেদ পড়লো। প্রিয়তোষ বাবুর ফোন।
"হ্যাঁ হ্যালো"

"কদ্দুর এগোলে ভায়া?"
"দুটো মৃত্যুর মধ্যে লিংক রয়েছে।"
"সেকী তাই নাকি?"

"হুমম আর দুটোই খুন আর প্রবাবলি একজনই করেছে।"
"কে সে ফোর্স নিয়ে যাবো নাকি?"
"উম হুমম এখুনি অত রণসাজের প্রয়োজন নেই। খুনির সাথে মুখোমুখি হইনি এখনো।"
"মানে কী? কে সে?"
"সেটাই তো রহস্য,এখনো জানিনা। তবে খুব শিগগির জানবো।"



ঠক ঠক --- ঠক --- ঠক ঠক ঠক

"এখন এই রাত্রে কে এলো?" ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে তাকালো সত্য,সাড়ে ১১টা ছুঁই ছুঁই করছে ঘড়ির কাঁটা। দরজা খুলতেই দেখে এক অপরিচিত যুবতী। পরনে হোয়াইট শর্ট কুর্তি আর ব্লু জিন্স। মুখটা খুব খুব চেনা চেনা লাগছে সত্যর কিন্তু মনে করতে পারলো না কোথায় দেখেছে এর আগে।

"আপনি ডিটেকটিভ সত্যজিৎ বিশ্বাস?"
"হ্যাঁ আমিই।"
"আপনার সাথে বিশেষ কথা ছিল কিছু প্লিজ যদি ভিতরে আসতে দেন।"
"তুমি মানে...কে আপনি এই রাত্রে একা...মানে?"
"সব বলছি। আগে বলুন ভিতরে আসব?"
"হ্যাঁ আসুন তাহলে।"

ভিতরে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো অচেনা যুবতী,"থ্যাংকস,একটু জল খাওয়াবেন কাইন্ডলি!"
সত্য ফ্রিজ থেকে বোতল নিয়ে এসে বসলো মুখোমুখি।

ঢক ঢক করে হাফ বোতল জল শেষ করে মেয়েটা একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লো। তারপর সত্যকে বললো,"আচ্ছা আপনি ওই জোড়া খুনের কেসটা ইনভেস্টিগেশন করছেন তাই না?"

"খুন কে বললো আপনাকে?পেপারে মিডিয়ায় তো খুন বলা হয়নি কোথাও, অস্বাভাবিক মৃত্যুই বলা হচ্ছে?"
"উফফ সব কি আর নিউজ পেপারে বলে দেবে নাকি,নিজেরও ঘটে কিছু থাকতে হয়।"
"ওহ রিয়েলি?"

"হুমম আর দুটো খুন একজনই করেছে জানেন। কী হলো অবাক হলেন নাকি? আরে আরে বুদ্ধি কি শুধু একচেটিয়া আপনারই আছে নাকি,আমিও মাথা খাটাতে জানি ভালোই।"
"তা কে করলো খুন?"

"বলছি, অত অধৈর্য মানুষ কেন আপনি? ডিটেকটিভদের এত তাড়া মানায় না জানেন। সবুর করুন না,বলতেই তো এসেছি এখানে। নাহলে এই রাতবিরেতে এলাম কী জন্য?"
"দেখুন বেশি গৌরচন্দ্রিকা শোনার ইচ্ছা আর সময় কোনোটাই নেই আমার।"
"আমি আপনাকে হেল্প করতে চাই। আপনি কি কিছু জানতে চান?"

"আজব কান্ড! বাড়িতে এসে যেচে হেল্প করতে চাইছেন, এ কেমন মহিলা?",মনে মনে ভাবলো সত্য।

"আচ্ছা আপনি এরকম গায়ে পড়ে হেল্প করবেন কেন? এতে আপনার কী লাভ?"

"জানেন ধনঞ্জয়বাবুর সাথে যেটা হয়েছে ঠিক হয়নি। শয়তানগুলোর উচিত শাস্তি দরকার ছিল আর ওটা হয়েছেও। ওনার স্ত্রী বাড়ি ছাড়ার পরে বেশিদিন চুরি করা সম্পত্তি ভোগ করতে পারেনি। নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার ২বছর পরে ছেলে হলো। তার ৪ বছর পরে ক্যান্সারে মারা গেলো। পাপের শাস্তি বুঝলেন। রামেশ্বর ভট্টাচার্যর শাস্তি বাকি থাকবে কেন শুধু শুধু। ওর সাজাটাও কমপ্লিট করে দিলাম।"

"করে দিলাম মানে?"

"মানে এসব পাপী কীট বেঁচে থাকুক একদম পছন্দ করিনা আমি। আমার সামনেই তো হলো খুনটা সেদিন। কি যে তৃপ্তি আহা সে বলে বোঝাতে পারবো না।"
"আপনি দেখলেন মানে কী বলছেন আপনি খুনিকে দেখেছেন?"
"আলবাত দেখেছি।"
"বলুন তাহলে কে?"

"আর ঐযে সেকেন্ড খুনটা ওটাও দেখেছি আমি, একদম সামনে থেকে। দ্বিগুণ আনন্দ হয়েছিল ওদিন, সত্যি বলছি জানেন,অতটা আনন্দ কোনোদিন পাইনি আমি।"

"কে ,কে করেছে খুন?"

"এখনো ধরতে পারলেন না,কেমন ডিটেকটিভ বলুন তো! খুনি আপনার সামনে হাজির,ডাকুন দারোগাবাবুকে।"--- মহিলাকণ্ঠের ঠাট্টার সুরে কথাগুলো সত্যকে,ওর গোয়েন্দাগিরিকে যেন খোঁচা দিল।
"আ...আপ...আপনি খুনি?"

"আমি ওদের নিজেদের সন্তান নই জানেন। ধনঞ্জয় মিত্র আর মধুলিকা মিত্র অনাথ আশ্রম থেকে আমায় দত্তক নিয়েছিল। মা ফার্স্ট ফার্স্ট খুব ভালোবাসতো আমায়। তারপরে আসতে আসতে কেমন পাল্টে গেলো। রামেশ্বর ভট্টাচার্যর সাথে বেশি টাইম স্পেন্ড করতে লাগলো। বাবা তখন থেকে  আরো  আগলে রাখতে শুরু করে আমায়। বাবার মতো ভালোমানুষটার সাথে এই অন্যায়টা মেনে নিতে পারিনি। এত ভরসা এত বিশ্বাসের মূল্য দিলোনা সবথেকে কাছের মানুষরা। বেঁচে থাকতে প্রতিশোধ নিতে পারিনি বাবার হয়ে। তাই সুইসাইডের ডিসিশনটা নিলাম,রোজ রোজ মরার চেয়ে একেবারে মরে যাই। বেঁচে থাকতে যেটা পারিনি,মরে গিয়ে অন্তত সেটা করতে অনেক সুবিধা হবে। কাজও হাসিল হবে আর জেল-জরিমানার হ্যাপাও থাকবে না, খুন হয়েছে বুঝলেও তদন্তে খুনিকে না পেয়ে অ্যাট দ্যা এন্ড অলৌকিক, অস্বাভাবিক বলে সবাই মেনে নেবে।"

"মঞ্জুলিকা আ...আপনি!"

"হ্যাঁ এইবার এই মঞ্জুলিকার ছুটি। বাবাকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। শান্তিতে থাকতে দিন জীবনের বাকি ক'টা দিন।চলি।"--- বলতে বলতে মঞ্জুলিকার সোফায় বসা শরীরটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যেতে থাকলো।

সত্য চশমাটা খুলে চোখ কচলে অবাক হয়ে সেইদিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,"অ্যাডভান্টেজ অফ্ অলৌকিকতা ||"