শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস

মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। কারণ তার ভাষা আছে। ভাষাহীন মানুষ বোবা প্রাণীর সমতুল্য। কালে কালে ভাষা হয়ে উঠে অর্থবহ। তাই মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ভাষা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মানব জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র জীবনে।

শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস
শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস


আমরা বাঙ্গালি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলনে যারা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তারাই হয়েছেন শহিদ। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভাষা শহিদদের স্মরণ করে পালিত হয় শহিদ দিবস। 


ভাষা আন্দোলনের পটভূমি 

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। A red letter day. এ দিনটির ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মলাভের ইতিহাস। এ দিন বাংলা ভাষার জন্য নবজীবনের দিন। 


বাংলাদেশ আর পাকিস্তান এ দুটি দেশ একসময় একদেশ ছিল। তখন পাকিস্তানকে বলা হতো পশ্চিম পাকিস্তান। বাংলাদেশকে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান। গোটা দেশের নাম ছিলো পাকিস্তান। দেশটির রাজধানী ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে।শাসন ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতেই ছিল। সেদিনের শাসকরা বল্ ল,- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। বাঙালিরা তখন প্রতিবাদ জানালো।


তারা দাবী করলো বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। শাসকরা তা মানলো না। শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলো ছাত্ররা। এ আন্দোলন চরম আকার ধারণ করলো ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। ঐ দিন ছাত্ররা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে প্রতিবাদ সভা করলো। পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলি চালালো। শহিদ হলো - সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার আরো অনেক। 


বাংলাদেশের স্বাধীনতা অমর একুশে ফেব্রুয়ারির দান। এ পবিত্র দিনকে বলি আমরা শহিদ দিবস। তাই বাংলা ০৮ ই ফাল্গুন,ইংরেজি ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবসে খালি পায়ে হাতে ফুল নিয়ে নিরবে প্রভাত ফেরিতে অংশগ্রহণ করি। এবং শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। তখন সকলের কন্ঠে সুর ভেসে ওঠে -

"আমার ভাই এর রক্তে রাঙানো 

একুশে ফেব্রুয়ারি, 

আমি কি ভুলিতে পারি? "


ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা 

ভাষা শহিদরা দেশকে ভালোবাসতেন। মাতৃভাষাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। তাঁরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষা করেছেন। তাঁদের আত্মত্যাগের ফলে 'বাংলা ' রাষ্ট্র ভাষা হয়েছে।


আমরা স্বাধীন ভাবে বাংলায় কথা বলতে পারছি। লেখতে পারছি। তাঁদের আত্মত্যাগের কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। তাই দেশকে ভালোবাসলে, মাতৃভাষাকে ভালোবাসলে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। 


নতুন রূপের এক দেশের সূচনা 

শহিদদের রক্তদান বৃথা যায়নি। শাসকরা পরে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নিল। আর সেই ভাষা আন্দোলন পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নিলো।


পৃথিবীর মানচিত্রে এল এক নতুন দেশ বাংলাদেশ। সুজলা, সুফলা -শস্যশ্যামলা অরণ্যকুন্তলা, সাগর বনানীঘেরা আমাদের এই বাংলাদেশ। 


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সূত্রপাত 

১৯৯৮ সালে কানাডায় বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান কাছে।


তখন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে এ চিঠিটি আসে। ১৯৯৮ সালের ২০ শে জানুয়ারি রফিককে অনুরোধ করা হয় যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্হা করেন।


পরে রফিক, আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে " মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্যা ওয়াল্ড" নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এ সংগঠন থেকে তারা আবার কফি আনানকে চিঠি লেখেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে তারা ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন।


তাঁর পরামর্শে প্রস্তাবিত ০৫ টি সদস্য দেশ যথা - কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা বিভিন্ন প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দানে ২৯ টি দেশ অনুরোধ জানাতে কাজ করেন। 


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণা 

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং এতে ১৮৮ টি দেশ সমর্থন জানালে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। 


২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের ৬৫ তম অধিবেশনে প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। তারপর থেকে প্রতি বছরের ন্যায় আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে। 


সত্যি কথা বলতে, জানামতে আর কোন দেশ নেই পৃথিবীতে যেখানে কোন জাতি নিজ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। বাঙালি জাতি হিসেবে, বাংলাদেশি হিসেবে আমরা গবির্ত ও ধন্য নিজ দেশের জন্য।  


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা 

১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অমর কাব্য 'গীতাঞ্জলি ' তাঁকে এনে দেয় নোবেল পুরস্কার আর এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলা ভাষার কথা, শুরু হয় বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে সত্যিকার অর্থে বিশ্বায়নের পূর্ণরূপ দেয়ার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ গ্রহণ করেন।


তার এই উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। জাতিসংঘের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ০৫টি ভাষায়। একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলায় ভাষণদান করার ফলে বিশ্ববাসী জানতে পারে বাংলা ভাষার মহত্ত্ব। 


বাংলা ভাষা বিশ্বের কাছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টিকারী পরিচিত ভাষা। এ ভাষা শুধু বাংলাদেশের ভাষাই নয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা প্রদেশ, আসাম প্রদেশের বরাক উপত্যকার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। ফলে ভারতের ক্ষেত্রে বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা। ভারত উপমহাদেশের বাইরে একমাত্র আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। 


বাংলা ভাষার প্রসারতা 

বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চীন,জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। 


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠান স্হাপন 

২০০১ সালের ১৫ মার্চ বিশ্বের সব মাতৃভাষার গবেষণা, উন্নয়ন ও সংরক্ষণে কাজ করার উদ্যোগে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই) এর ভিত্তি প্রস্তর স্হাপন করেন ঢাকার সেগুনবাগিচায়।


বর্তমানে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা, ভাষা সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এটি ভাষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে যা বাংলা ভাষাকে বিশ্ব মর্যাদায় আসীন করতে ভূমিকা রাখছে। 


পরিশেষে বলা যায়, একুশের মাধ্যমে আমাদের আজকের এই অর্জন। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এখন সারাবিশ্বের ভাষা ও অধিকারজনিত সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অহংকার "শহীদ মিনার"।